অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নেওয়ার অনুমতি দেওয়া নিয়ে পর্দার আড়ালে চলছে নানামুখী তৎপরতা। সরকার চায় রাজনৈতিক সমঝোতা, আর নিঃশর্ত বিদেশ গমন চায় বিএনপি। সাজাপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে সহজেই ‘বিশেষ বিবেচনায় ছাড়’ দিতে নারাজ ক্ষমতাসীন দল। নির্বাহী আদেশের সুবিধা পেতে খালেদা জিয়া তথা বিএনপিকেও কিছুটা রাজনৈতিক ছাড় দেওয়ার শর্ত সামনে আনছে সরকারপক্ষ।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, সরকারি মহল থেকে পাসপোর্টে খালেদা জিয়ার ১৫ আগস্ট জন্ম তারিখটি পরিবর্তন, দুর্নীতির দায় স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা এবং রাজনীতি থেকে ইস্তফা নেওয়ার শর্তারোপ করা হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় এমন ছাড় দিয়ে কঠিন শর্ত তিনটিতে কোনোভাবেই রাজি নয় বিএনপি এবং খালেদা জিয়া। দু’পক্ষের এই অনড় অবস্থানের কারণে ঝুলে আছে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার অনুমতি পাওয়ার সিদ্ধান্ত। অবশ্য এই স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষপর্যায়ে নেতারা।


বিএনপি হাইকমান্ড আশা করেন, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার ইস্যুতে এরই মধ্যে দেশি-বিদেশিদের সমর্থন বাড়ায় সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে; পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে বিএনপির লাগাতার কর্মসূচিতে জনমত আরও পক্ষে আসবে এবং এ অবস্থায় বাধ্য হয়েই সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেবে সরকার।

অন্যদিকে সরকারি দলের নীতিনির্ধারক মহল মনে করেন, বিএনপি খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে রাজনীতি করছে। তারা আসলে খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা চায় না। মানবিক তথা বিশেষ বিবেচনায় রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতাবলে সাজা মওকুফ পেতে হলে বিএনপিকেই এগিয়ে আসতে হবে। নেত্রীর সুচিকিৎসার কথা বিবেচনায় এনে ‘কিছু পেতে’ বিএনপিরও ‘কিছু ছাড়’ দেওয়া উচিত।

যোগাযোগ করা হলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এ মুহূর্তে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় প্রয়োজন উন্নত চিকিৎসা পাওয়া। এটা তার সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার। সে অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তিনি। বিএনপি চেয়ারপারসন সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। বিষয়টিতে আমরা বারবার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছি।’

রাজনৈতিক সমঝোতার শর্তের বেড়াজালে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি আটকে আছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন,‘ তাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে সাজা দেওয়া হয়েছে। তারপরও ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় সরকার খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দিতে পারে। বিএনপি ও খালেদা জিয়ার পরিবার সব রকম চেষ্টা চালিয়ে আসছে। এখানে শর্তের বিষয় কেন আসবে?’ তিনি বলেন, ‘তারপরও আমরা আশা করছি, দেরিতে হলেও সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে, খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার সুযোগ দেবে।’

অন্যদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেওয়ার আবেদনটি গুরুত্বসহকারে সরকার পর্যালোচনা করছে। আলাপ-আলোচনা করে যতটুকু সম্ভব সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, তা নেওয়া হবে।
খালেদা জিয়ার বিষয়ে রাজনৈতিক কোনো সমঝোতার প্রক্রিয়া চলছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চান না বলে জানান।

উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতা এবং বিএনপির শীর্ষ নেতারা এ নিয়ে আইনি ব্যাখ্যা দিয়ে বাগ্‌যুদ্ধ চালালেও পর্দার আড়ালে রয়েছে ভিন্ন চিত্র। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেওয়া বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতা প্রত্যাশা করছে সরকারের উচ্চ মহল। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির কাছে দুর্নীতির দায় স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের নেতারা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনাও করেছেন। তবে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নষ্ট করে কোনো সমঝোতার মাধ্যমে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নেওয়ার পক্ষে সায় নেই স্বয়ং খালেদা জিয়ার। কিছুটা সুস্থ থাকার সময়ে তিনি সাফ জানিয়েছেন- কোনো মিথ্যা অভিযোগের কাছে নতি স্বীকার করবেন না। বিদেশে চিকিৎসা তার মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার।

চেয়ারপারসনের এমন কঠোর মনোভাবে দলের শীর্ষ নেতারাও ঐকমত্য পোষণ করেন। তারা এখন নিঃশর্তে খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর ব্যাপারে অনমনীয় মনোভাব প্রকাশ করছেন।

সূত্র জানায়, রাজনৈতিক বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলেও খালেদা জিয়াকে বিদেশে যেতে অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্তটি আটকে আছে। বর্তমানে নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে যেভাবে তিনি জামিনে মুক্ত থাকছেন, বিদেশে গিয়ে সে শর্ত কতটুকু মানবেন- তা নিয়ে চিন্তিত সরকারপক্ষ। অতীতে বিদেশে গিয়ে অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণের বাইরে অনেক নেতা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। বিদেশিদের সঙ্গে প্রকাশ্যে বৈঠক ও সরকারের বিরুদ্ধে নানা গুরুতর অভিযোগ এনে বহির্বিশ্বের জনমত অনুকূলে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

সূত্রমতে, এ ধরনের আশঙ্কা থেকে সরকারের উচ্চ মহল বিএনপির পক্ষ থেকে খালেদা জিয়া দলীয় পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে রাজনীতি করবেন না- এমন ঘোষণা দেওয়ারও প্রত্যাশা করছে। এ বিষয়টিও কোনোভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয় বলে স্পষ্ট জানিয়েছে বিএনপির শীর্ষ মহল। দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়া তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তিনি দেশের প্রচলিত আইন-কানুন মেনে চলছেন। আমৃত্যু তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন। এখানে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার মতো কোনো ঘোষণা আপসহীন নেত্রীর পরিচয়ে খ্যাতি পাওয়া খালেদা জিয়ার পক্ষে সম্ভব নয়।

সূত্র আরও জানায়, খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার পথে আরও একটি ইস্যু সামনে আনা হয়েছে। তা হচ্ছে খালেদা জিয়ার জন্মদিন ১৫ আগস্ট হিসেবে উল্লেখ করে পাসপোর্ট নবায়ন না করা। ২০১৯ সালে তার পাসপোর্ট মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। গত ৫ মে নবায়ন করতে তা পাসপোর্ট অধিদপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে। জন্মতারিখ প্রশ্নেই সাত মাসেও পাসপোর্টটি নবায়ন করে ফেরত দেওয়া হয়নি।

সংশ্নিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ মনে করে, খালেদা জিয়ার প্রকৃত জন্মদিন ১৫ আগস্ট নয়। হাতে সুযোগ আসায় সরকারপক্ষ ১৫ আগস্ট জন্মতারিখটি পরিবর্তন করে প্রকৃত জন্মদিন উল্লেখ করে পাসপোর্ট নবায়ন করতে চাপে রেখেছে। তবে এ বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নিচ্ছে না বিএনপি। দলীয় নেতারা মনে করেন, ব্যক্তিগত বিষয়ে এরূপ চাপ সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণ।

উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার আবেদন জানিয়ে তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার গত ১১ নভেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর আবেদন করেন। পরদিন আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনগত মতামতের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর মতামতের অপেক্ষায়।

প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তাকে (শেখ হাসিনা) গ্রেনেড মেরে হত্যা করার চেষ্টা করেছেন খালেদা জিয়া। এর পর দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও মানবিকভাবে যতটুকু করার, সবই করা হয়েছে। খালেদা জিয়াকে বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। আইনগত কারণে এর চেয়ে বেশি কিছু করা সম্ভব নয়।

২৩ নভেম্বর বিএনপির আইনজীবীরা আইনমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে একটি স্মারকলিপি দিয়ে আসেন। সে সময় আইনমন্ত্রী বলেছেন, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

চাপ বাড়ছে, আশাবাদী বিএনপি>>
পর্দার আড়ালে সমঝোতার তৎপরতা চললেও প্রকাশ্যে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করার কৌশল নিয়েও এগোচ্ছে বিএনপি। মাঠে লাগাতার রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে জনমত তৈরি এবং বিদেশিদের সমর্থন পেতে কূটনীতিকদের সঙ্গেও দেখা-সাক্ষাৎ চলছে। দলের নেতারা বলছেন, সরকার খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার প্রতি গুরুত্ব না দিলেও ইতোমধ্যে দেশি-বিদেশিদের অনেকে সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এবং আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন। ক্ষমতাসীন জোটের বাইরে সব রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং বিশিষ্ট নাগরিকরা খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসা করতে বিদেশে পাঠানোর আহ্বান জানিয়ে পৃথক বিবৃতি দিয়েছেন।

বিএনপি নেতারা জানান, ক্রমেই সরকারের ওপর কূটনৈতিক চাপ স্পষ্ট হচ্ছে। ঢাকায় কর্মরত প্রায় সব দেশের কূটনীতিক গত ৪ ডিসেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসার খোঁজ নিয়েছেন। এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বিএনপি চেয়ারপারসনের বিদেশে চিকিৎসা বিষয়ে সরকারের অবস্থান কূটনীতিকদের অবহিত করেন।

সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টে ডেপুটি স্পিকার সংসদ সদস্য হিসেবে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে তার দেশের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানোর অনুরোধ করেন।

আবার যুক্তরাষ্ট্রে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি বলেছেন, জাতীয় নিরাপত্তা টিম ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি এ বিষয়ে জানাবেন।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে


সূত্র : সমকাল