হেপাটাইটিস বি-ভাইরাসের ওষুধ ‘ন্যাসভ্যাক’ উদ্ভাবক দেশের দুই বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর ও অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)।

 


হেপাটাইটিস বি-ভাইরাস লিভার প্রদাহের মুখ্য কারণ। বিশ্বের প্রায় দুইশত কোটি লোক কোনো না কোনো সময় হেপাটাইটিস বি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, এর মধ্যে প্রায় ত্রিশ কোটি লোক ক্রনিক হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত। এই ত্রিশ কোটি লোকের মাধ্যমে হেপাটাইিটস বি সুস্থ মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। অন্যদিকে এই ত্রিশ কোটি মানুষের মধ্যে অনেকেই লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বাংলাদেশেও প্রায় ৭০ শতাংশ লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের জন্য দায়ী এই হেপাটাইটিস বি ভাইরাস। প্রতিবছর এই ভাইরাসের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে লিভারের বিভিন্ন রোগে মারা যান ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ। মোটাদাগে ক্রনিক হেপাটাইটিস বি’র চিকিৎসা সম্ভব হলে লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করা অনেকাংশে সম্ভব। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশে^র অন্যান্য দেশেও হেপাটাইটিস বি’র চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের এন্টিভাইরাল ওষুধ পাওয়া যায়। কিন্তু এই সমস্ত ওষুধের নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা আশানুরুপ নয়। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের চিকিৎসকরা হেপাটাইটিস বি’র চিকিৎসায় অধিকতর নিরাপদ ও কার্যকর ওষুধ আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই ফলশ্রুতিতে কিউবা, জাপান ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে হেপাটাইটিস বি’র চিকিৎসায় আবিষ্কৃত ‘ন্যাসভ্যাক’ নামে নতুন ওষুধের সফল ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন করেছেন বাংলাদেশি দুই চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর ও অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)। এরই মধ্যে কিউবাসহ আরও কিছু দেশে ব্যবহার শুরু হয়েছে তাঁদের উদ্ভাবিত নতুন এই ওষুধ।

 

[৩] হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে জাপানের এহিমে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২০ বছর গবেষণা করছেন ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর। জাপানের সরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়টি গবেষণার জন্য বিশ্বে স্বীকৃত। প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশে ‘হেপাটাইটিস বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত প্রায় এক হাজার রোগী নিয়ে কাজ করেছেন অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল। ডা. আকবরের জাপানে গবেষণা ও অধ্যাপক স্বপ্নীলের বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি সংক্রান্ত ক্লিনিক্যাল বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় ন্যাসভ্যাক ব্যবহারের একটি সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে আসে ২০০৯ সালে।


 
[৪] ২০০৯ সালে ২০ জন ক্রনিক হেপাটাইটিস রোগীর ওপর ন্যাসভ্যাকের প্রথম ফেজ-১ ও ফেজ-২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনা করা হয়। ক্রনিক হেপাটাইটিস বি-এর চিকিৎসায় এটি নিরাপদ ওষুধ হিসেবে প্রমাণিত হয়। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা যায়, ন্যাসভ্যাক ব্যবহারে শতকরা ৫০ ভাগ ক্রনিক হেপাটাইটিস বি রোগীর রক্ত থেকে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস সম্পূর্ণ নির্মূল হয়েছে। ছয় মাস পরেও শতভাগ রোগীর লিভারের প্রদাহ পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলো। ন্যাসভ্যাকের এই সাফল্যের খবর এশিয়ান প্যাসিফিক লিভার অ্যাসোসিয়েশনের অফিসিয়াল জার্নাল ‘হেপাটোলজি ইন্টারন্যাশনাল’-এ প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালের নভেম্বর সংখ্যায়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে ১৬০ জন ক্রনিক  হেপাটাইিটস বি-তে আক্রান্ত রোগীর ওপর ন্যাসভ্যাকের ফেজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করা হয়। এই ট্রায়ালটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল গভ.  রেজিস্ট্রিও করা হয়। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল গভ. এফডিএ ও এনআএইচ কর্তৃক অনুমোদিত সংস্থা। এছাড়াও এই ট্রায়ালের জন্য বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসনের অনুমতি নেওয়া হয়। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের ‘ইথিক্যাল অ্যাপ্রুভাল’ও নেওয়া হয়।

 

[৫] ফেজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ৮০ জন ক্রনিক হেপাটাইটিস বি রোগীকে ১৫ বার ন্যাসভ্যাক দেওয়া হয়। বাকি ৮০ জনকে ৪৮ বার বর্তমান বিশ্বে হেপাটাইটিস বি চিকিৎসায় ব্যবহৃত অন্যতম কার্যকর ও সবচেয়ে দামি ওষুধ ‘পেগাইলেটেড ইন্টারফেরন’ দিয়ে চিকিৎসার জন্য মনোনিত করা হয়। চিকিৎসা শেষ হবার ৬ মাস পর দেখা যায়, পেগাইলেটেড ইন্টারফেরন ব্যবহারে ৩৮ শতাংশ রোগী উপকৃত হয়েছেন। এর বিপরীতে ন্যাসভ্যাকে আরোগ্য লাভ করেছেন ৫৯ শতাংশ রোগী। এক বছর পরও ন্যাসভ্যাক গ্রহণকারী রোগীদের তেমন কোনো পাশর্^প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি চিকিৎসা শেষ হবার দুই এবং তিন বছর পরও ন্যাসভ্যাক গ্রহণকারী রোগীদের কার্যকারিতা পরিলক্ষিত হয়। এই তিনটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, হেপাটাইটিস বি’র চিকিৎসায় প্রচলিত অন্য ওষুধগুলোর তুলনায় ন্যাসভ্যাক অনেক বেশি কার্যকর। 

 

[৬] হেপাটাইটিস বি-ভাইরাসের উদ্ভাবক দুই বাংলাদেশি চিকিৎসা বিজ্ঞানী সম্প্রতি মুখোমুখি হয়েছিলেন আমাদের নতুন সময়ের। ন্যাসভ্যাক আবিষ্কারের নেপথ্যে অনেক অজানা কথা তাঁরা বলেছেন আমাদের সঙ্গে। কোভিডের আগে ২০১৯ সালে ন্যাসভ্যাক দেশের বাজারে নিয়ে আসার সকল প্রস্তুতি থাকলেও বাস্তবতার কারণে সেটি সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে এখন থেকে ন্যাসভ্যাক ওষুধটি বাজারে নিয়ে আসার সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ন্যাসভ্যাক কবে আসবে, কীভাবে আসবে, কতোদূর কাজের অগ্রগতি, কীভাবে আজকে ন্যাসভ্যাক একটি সফল আবিষ্কার হলো জানিয়েছেন বিখ্যাত এই দুই বিজ্ঞানী। 

 

[৭] ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর : লিভারের প্রদাহ হচ্ছে একটা বড় সমস্যা, যাকে সাধারণত হেপাটাইটিস বলা হয়। কয়েক বছর পরে হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত রোগীর লিভার সিরোসিস এবং লিভার ক্যান্সার হতে পারে। লিভার সিরোসিস একটি বড় ধরনের জটিল অসুখ। এ ধরনের রোগীদের মুখ দিয়ে রক্ত আসতে পারে, পেট ফুলে যেতে পারে ও স্মৃতিভ্রম (হেপাটিক এনকেফালোথি) হতে পারে। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের অনেক ওষুধ বাজারে আছে, কিন্তু সেগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও আছে এবং দীর্ঘ সময় ব্যবহার করেও সেসব ওষুধের ফলাফল তেমন সন্তোষজনক নয়। পাশাপাশি এসব ওষুধের বিশেষ একটি সমস্যা হচ্ছে, এ ওষুধগুলো দীর্ঘদিন ধরে বিরতীহিনভাবে গ্রহণ করতে হয়। এর ব্যতয় ঘটলে অর্থাৎ মাঝপথে ওষুধ বন্ধ করে দিলে রোগীর লিভার ফেউলিওর হয়ে মৃত্যুও ঘটতে পারে। এককথায় হেপাটাইটিস বি’র চিকিৎসা, লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধ করবার জন্য এমন একটি ওষুধের প্রয়োজন যা রোগীর জন্য নিরাপদ, হেপাটাইটিসের সীমাকে কমিয়ে আনতে পারে ও হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের ডিএনএকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এসব গুণাগুন সম্বলিত ওষুধটিই হচ্ছে ন্যাসভ্যাক, যা দুই দশকের বেশি সময় ধরে কিউবা, জাপান ও বাংলাদেশের যৌথ গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক সহযোগিতায় আবিষ্কৃত হয়েছে। যদিও এ সম্বন্ধে বিশ^ব্যাপী আরও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

 

[৮] অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : হেপাটাইটিস বি ভাইরাস নিজে লিভারের কোনো ক্ষতি করে না। ভাইরাস যেটা করে তাহলো ভাইরাস লিভারের মধ্যে প্রবেশ করার পর ভাইরাসের যে ডিএনএ আছে, সেটা মানুষের লিভার সেলের ডিএনের সঙ্গে মিশে যায়। ফলে মানুষের রোগ প্রতিরোধ করার যে শক্তি বা ইমিউনিটি আছে, তা ভাইরাসকে মারতে গিয়ে লিভারকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। এক্ষেত্রে বি-ভাইরাস লিভারকে ধ্বংস করছে না বরং শরীরই লিভারকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফলে আমরা যদি ওষুধ তৈরি করতে চাই, আমাদের এমন একটি ওষুধ তৈরি করতে হবে, যা আমাদের ভাইরাসটাকেও ধ্বংস করে দেবে আর লিভারকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। তবে এ ধরনের ওষুধ তৈরি করা খুব কঠিন। এখন পর্যন্ত যে ওষুধগুলো আমরা ব্যবহার করি, সেগুলো হচ্ছে মোটামুটি ভাইরাসকে দমন করে রাখে, কিন্তু শরীর থেকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে না। এ কারণে যখন রোগীরা ওষুধ বন্ধ করে দেন তখন ভাইরাসটা আবারও ফিরে আসে।

 

অনেক সময় কেউ হয়তো জানেনই না তার বি ভাইরাস আছে। কেউ হয়তো ক্যান্সার রোগের ওষুধ খেলেন বা কারও কিডনি ফেইলিউর ডেভেলপ করলো বা ডায়াবেটিস কন্ট্রোলের বাইরে চলে গেলো বা কোনো কারণে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলো তখন দেখা যায় ভাইরাসটা হঠাৎ অ্যাক্টিভ হয়ে যায়। অর্থাৎ কোনো ভাইরাস বা ওষুধের কারণে ইমিউনিটি সিস্টেম কমে গেলে তখন বি-ভাইরাস শরীরে আবারও অ্যাক্টিভ হয়, তখন লিভার ফেইলিউর পর্যন্ত হতে পারে।

 

আমরা যদিও বলি বর্তমানে বাজারে যে ওষুধগুলো আছে তা নিরাপদ তবুও তার মধ্যে কিছু সমস্যা আছে। একদম প্রয়োজন না হলে বর্তমানে  হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে যেসব ওষুধ বাজারে পাওয়া যায় তা ব্যবহার করা ঠিক হবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লিভার সিরোসিস থাকলে এই ওষুধগুলো আমৃত্যু খেতে হয় এবং যদি লিভার সিরোসিস নাও থাকে, আমরা রোগীদের বলি দশ পনেরো বছর কমপক্ষে খেতে হবে। এই যে দশ পনেরো বছর ধরে ওষুধ খাওয়া এবং ওষুধ বন্ধ করলে রোগীর আবারও সমস্যা হওয়া, যা সমাধান করা খুব মুশকিল। তাছাড়া ওষুধগুলোর দামও কম নয়। এই বিবেচনায় সারা পৃথিবীতে একটা জোরদার গবেষণার তাগিদ আছে যে এমন একটা ওষুধ বের করা যায় কিনা, যা ভাইরাসটা নিষ্ক্রিয় করবে কিন্তু লিভারের তেমন কোনো ক্ষতি করবে না। যদি এমন ওষুধ বের করা যায়, তাহলে বি-ভাইরাসের চিকিৎসা পরিবর্তন সাধিত হতো, যেমনটা আমরা সি ভাইরাসের ক্ষেত্রে দেখেছি।

 

এখন আমরা জানি সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল হচ্ছে যে ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে হেপাটাইটিস বি-কে যতোদূর সম্ভব নির্মূল করা। আর একটা বড় ব্যাপার হচ্ছে, সকলের জন্য চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। ফলে আমাদের একটা সুনির্দিষ্ট মেয়াদে চিকিৎসা করতে হবে, যাতে ভাইরাসটা নির্মূল করা যায় ও রোগটা যে পর্যায়েই থাকুক না কেন, লিভার সিরোসিস যাতে না হয়। সেরকম একটা ওষুধ নিয়েই গবেষণা ও ‘ন্যাসভ্যাক’ সে ধরনেরই একটা ওষুধ। 

 

[৯] ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর : আমি আগেই বলেছি, লিভারের প্রদাহ বন্ধ করার জন্য একটা কার্যকর ওষুধ দরকার, যেটা একটা নির্দিষ্ট সময় ব্যবহার করলে ভাইরাসও কমতে পারে এবং প্রদাহও বন্ধ হতে পারে। ‘ন্যাসভ্যাক’ হচ্ছে এমন একটা ওষুধ যেটা মাত্র পাঁচ মাসে দশ থেকে পনেরো বার দেওয়া হয়, পৃথিবীর কোথাও দশবার দেওয়া হয়েছে, কোথাও পনেরোবার দেওয়া হয়েছে। ‘ন্যাসভ্যাক’ নাক দিয়ে দেওয়া যায় এবং ইনজেকশন দিয়েও দেওয়া সম্ভব। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বে ইনজেকশন দেওয়ার সমস্যা অনেক বেশি। ফলে নাক দিয়ে প্রয়োগের ক্ষেত্রে একজন রোগী খুব সহজেই নিজে তা নিতে পারবেন। ন্যাসভ্যাক একটা নির্দিষ্ট মেয়াদী ওষুধ, যা পাঁচ থেকে ছয় মাস নিতে হবে এবং বর্তমান ওষুধের যে সমস্যাগুলো আছে, ‘ন্যাসভ্যাক’ ব্যবহার করলে তা আর থাকবে না। ‘ন্যাসভ্যাক’ এমন একটা ওষুধ, যা বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকেরা মিলে তৈরি করেছেন।

 

যেকোনো ওষুধ তৈরি করার পর জীবজন্তুর ওপর আগে প্রয়োগ করা হয়, যদি দেখা যায় ভালো কিছু হতে পারে এবং বড় রকমের কোনো প্রতিক্রিয়া হবে না তখন এটাকে মানুষের ওপর তিনটি স্তরে প্রয়োগ করা হয়; এটাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ফেজ-১, ফেজ-২ ও ফেজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বলে। যদিও ‘ন্যাসভ্যাক’ ডেভেলপ করেছে কিউবা এবং জাপান মিলে। কিন্তু বাংলাদেশে সর্বপ্রথম হেপাটাইটিস আক্রান্ত রোগীদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে ন্যাসভ্যাক প্রয়োগ করা হয়েছে। ন্যাসভ্যাকের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ২০০৯ সালে শুরু হয়ে ২০১৪ সালে শেষ হয়েছে। আমরা এর ফলোআপ করেছি দীর্ঘ সময় ধরে এর প্রতিক্রিয়া কেমন হয় তা দেখার জন্য। ফলোআপ সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর আমরা আমাদের ওষুধ প্রশাসনের কাছে এর অনুমোদনের জন্য আবেদন করি। ২০১৭ সালে ওষুধ প্রশাসন ন্যাসভ্যাকের রেসিপে অনুমোদন করে।

 

ন্যাসভ্যাক এখন কিউবা থেকে আনতে হবে। প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ২০১৯ সালের দিকে যখন আমরা এগিয়ে যাই তখনই কোভিড চলে আসে। ফলে সবকিছু দুই বছরের জন্য পিছিয়ে যায়। ‘ন্যাসভ্যাক’ তৈরির জন্য কিউবা ও জাপানে অসংখ্য লোক কাজ করেছেন, বাংলাদেশেও বহু লোক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে সহায়তার জন্য কাজ করেছেন। বিশ্বে পাঁচটি দেশ ন্যাসভ্যাক বাজারে এনেছে। বাংলাদেশে কোভিডের জন্য এটা এখনো আনা সম্ভব হয়নি। তবে আমরা এই প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছি। আমরা আশা করছি এ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে ন্যাসভ্যাক বাজারে আনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারবো।

 

[১০] অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : এক বা একাধিক কোম্পানি ন্যাসভ্যাক বাজারে আনতে পারে। তবে একটি ওষুধ কোম্পানি তাদের ব্যয় বেনিফিট বিবেচনা করেই তা বাজারে আনবে। তবে আমাদের দেশে যখন কোনো ওষুধ তৈরি হয়, তার দাম বহু দেশের তুলনায় অনেক কম থাকে, সেই ব্যাপারটা আশা করি এখানেও প্রযোজ্য হবে। তবে ন্যাসভ্যাকের আকাশছোঁয়া দাম হবেÑ এমন আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। তবে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসায় যে খরচ হয়- যেমন নিয়মিত ওষুধ খাওয়া, বারবার পরীক্ষার খরচ ও নানা ভোগান্তি হয় তার তুলনায় ন্যাসভ্যাকের ছয়মাস মেয়াদী চিকিৎসায় খরচ অনেক কম হবে। সবকিছু বিবেচনা করে বলা যায়, ‘নাসভ্যাক’ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই থাকবে। অনেক কম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়েই এই ওষুধটি প্রয়োগ করা যাবে। আমরা আশা করছি আগামী বছর থেকে ওষুধটি আমরা রোগীকে খেতে পরামর্শ দিতে পারবো।

 

দেশের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর কোনো একটি ওষুধ কোম্পানিকে ন্যাসভ্যাক উৎপাদনে অনুমতি প্রদান করে। ড্রাগ কন্ট্রোল কমিটি কোভিডের আগেই ন্যাসভ্যাকের রেসিপি অনুমোদন করেছিলো ও ওষুধ তৈরি করার অনুমোদন দিয়েছিলো বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডকে। এখন ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরির কাছে বিকন ফার্মা নাসভ্যাকের স্যাম্পল জমা দেবে, সেখান থেকে যদি ভালো প্রমাণিত হয়, তখন সেটা কমার্শিয়াল ম্যানুফ্যাকচারে যাবে। তখন ওষুধের মূল্য নির্ধারণসহ আরও যা যা প্রক্রিয়া আছে, তা ওষুধ প্রশাসন সম্পন্ন করে দেবে।

 

সাধারণত নতুন কোনো ওষুধ ব্যবহারের জন্য বাজারে আনতে হলে আমরা বিশে^র কোনো একটি উন্নত দেশের অনুমোদনের প্রত্যাশায় থাকি যেমন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার। নাসভ্যাককে আমাদের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সরাসরি অনুমোদন দিয়েছে। এটি বাংলাদেশ থেকে যৌথভাবে উদ্ভাবিত একটি ওষুধ, যা ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর অনুমোদন দিয়েছে দেশের আইন-কানুন মেনে। ইদানীংকালে ভারত তাদের উদ্ভাবিত একটি ওষুধের অনুমোদন দিতে সক্ষম হয়েছে, যা ফ্যাটি লিভারের জন্য ব্যবহার করা হয়। ভারত ও চীন পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী ওষুধ উৎপাদনকারী দেশ অথচ তারাও কিন্তু তাদের নিজস্ব উদ্ভাবিত খুব কম ওষুধেরই নিজেদের দেশে অনুমোদন নিতে  পেরেছে। জাপানে কোভিডের আগে ন্যাসভ্যাকের একটি বড় ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছিলো প্রায় ৪টি বিশ^বিদ্যালয়ের সমন্বয়ে। কোভিডের কারণে প্রক্রিয়াটি থেমে গিয়েছিলো। তবে জাপানে আবারও এটি শুরু হয়েছে। জাপানের নাগরিকদের ওপর ফেজ-১ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ‘ন্যাসভ্যাক’ দিয়ে আমাদের দেশের মতো ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে এবং সে সমস্ত ডাটা আমেরিকায় গতবছর আমেরিকান লিভার মিটিংয়ে প্রেজেন্ট করা হয়েছে এবং এ বছরও প্রেজেন্ট করা হবে। আমেরিকান লিভার এসোসিয়েশন ‘ন্যাসভ্যাক’কে লিভার চিকিৎসায় কার্যকর ওষুধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাপানে নাগরিকদের ওপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালিত হচ্ছে, বাংলাদেশের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রাপ্ত ফলাফলের উপর ভিত্তি করে। এখন মোট ৭টি বিশ^বিদ্যালয় মিলে ব্যাপকভাবে জাপানি সরকারের অর্থায়নে একটি বড় ট্রায়াল শুরু করতে যাচ্ছে। এই ট্রায়ালে যদি আমাদের মতো বা জাপানে  ফেজ-১ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যেমন ফলাফল হয়েছে তেমন ফলাফল হয়, তাহলে আমরা আশা করছি দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে ‘ন্যাসভ্যাক’ জাপানেও অনুমোদন পেয়ে যাবে। ‘ন্যাসভ্যাক’ যদি জাপানে অনুমোদন পায়, তাহলে তা আমেরিকাসহ বিশে^র অন্যান্য দেশেও এর অনুমোদন পেয়ে যাবে।

 

[১১] ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর : বাংলাদেশে এই প্রথমবার কোনো ওষুধ ফেজ-১, ফেজ-২ ও ফেজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন করা হয়েছে। এর আগে আর কোনো ওষুধ বাংলাদেশে এমন করা হয়নি। ফলে আমরা একটা প্রক্রিয়া শুরু করলাম। এই প্রক্রিয়া হাতে নিয়ে আমরা এখন অনেক নতুন নতুন ওষুধ তৈরি করা শুরু করবো। এমন ওষুধ আমরা এখন তৈরি করবো, যা আমদের দেশে নেই। যেমন ক্যান্সারের অনেক ওষুধ, স্টেমসেলের অনেক ওষুধ তৈরি করতে পারবো। জাপানে যদি ন্যাসভ্যাকের অনুমোদন পেয়ে যায়, তাহলে পৃথিবীর কমপক্ষে একশোটির মতো দেশে এটা অনুমোদন পেয়ে যাবে। জাপান, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানের মতো আরও কয়েকটি দেশসহ মোট সাতটি দেশ থেকে অনুমোদন পেলে সেই ওষুধ সারা পৃথিবীতে গ্রহণযোগ্য হয়। আমরা বাংলাদেশে এখনও তেমন গবেষণাগার বা গবেষণা লেভেল তৈরি করতে পারিনি। এসব ব্যাপারে এখন আমাদের আরও বেশি করে সময় দিতে হবে, অর্থ দিতে হবে। আমাদের একটি বড় সুবিধা হলো আমাদের এখানে রোগী আছে, কিন্তু আমরা এগুলো ঠিকমতো ব্যবহার করে গবেষণা করতে পারছি না। 

 

[১২] অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : ন্যাসভ্যাকের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বাংলাদেশে হয়েছে। মানুষ এর ফলাফল দেখেছে। ফলে কোভিডকালীন সময়ে আমরা দেখেছি মানুষ কোভিড ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল নিয়ে ভয় পায়নি। একটা জিনিসের দীর্ঘ ও বিভিন্নমুখী প্রভাব থাকে। ‘ন্যাসভ্যাক’-এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন করার ফলে আমাদের মধ্যে একটা সাহস সঞ্চয় হয়ছে যে, আমরাও পারি। এরপর আমরা বাংলাদেশে অনেক কিছু শুরু করেছি বিএসএমএমইউ লিভার বিভাগের পক্ষ থেকে। যেমন আমরা বাংলাদেশে স্টেমসেল থেরাপি শুরু করেছি এবং ছয়-সাতটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রবন্ধ বের করেছি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমরা স্টেমসেল নিয়ে কথা বলছি। তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার স্টেমসেলের গাইডলাইন প্রণয়ন করেছে, সেখানে লিভার বিশেষজ্ঞরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

 

ইন্টার একাডেমি পার্টনারশিপ সারা পৃথিবীর বিজ্ঞান একাডেমিগুলোর যে সংগঠন তারা সারা পৃথিবী থেকে আমিসহ বারোজন স্টেমসেল বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি ডিক্লারেশন তৈরি করেছেন স্টেমসেল গবেষণার জন্য। এগুলো আমাদের ন্যাসভ্যাকেরই প্রভাব। আমরা বাংলাদেশে লিভারের চিকিৎসায় রেডিওফ্রিকোয়েন্সি এবলেশনের মতো আধুনিক চিকিৎসা শুরু করেছি সেই ভরসায়। ইদাীনং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আয়ুর্বেদিক ওষুধের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কোভিডকালীন সময়ে রাজশাহীর একদল গবেষক একটি স্থানীয় ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহার করে কোভিডের চিকিৎসা করা সম্ভব হতে পারে তা দেখিয়েছেন। এখন আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে আয়ুর্বেদ বিদ্যাকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণ করা, এটা লিভার রোগে কাজ করে কিনা তা নিয়ে গবেষণা করছি।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের বাইরে গিয়েও আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব বিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ফার্মাসি, বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে গিয়েও গবেষণা করছি। আমরা দেখতে চাচ্ছি, ফ্যাটি লিভারে কোনো জেনেটিক সমস্যা আছে কিনা, যে ওষুধ দিয়ে কিডনি রোগীর রক্ত শূন্যতার  কারেকশন করা হয়, সেটা আমরা লিভার রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারি কিনা। আমাদের এই ক্ষুদ্র সামর্থ্যরে মধ্যেও বিভিন্ন উদ্যোগ যে একটি ওষুধকে অন্য উদ্দেশে ব্যবহার করা, আয়ুর্বেদকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ফিরিয়ে আনা, স্টেমসেল থেরাপির মতো চিকিৎসা পদ্ধতি বাংলাদশে সম্প্রসারিত করা, এই যে প্রচার প্রচারণার কারণে মানুষের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হওয়াতে ভ্যাকসিন সাফল্যে কিছুটা হলেও অবদান আছে। এসবের মধ্যে ন্যাসভ্যাকেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে বলে আমি মনে করি। কাজেই আমার মনে হয়, যদি একটি বিজ্ঞানমনস্ক পরিবেশ তৈরি হয়, তাহলে এর গুরুত্ব অপরিসীম, যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবসময় বিজ্ঞান গবেষণায় গুরুত্বারোপ করেছেন। বিশ^বিদ্যালয়গুলোরও লক্ষ্য প্রথমে বলা হয়েছে, শিক্ষা তারপর গবেষণা, তারপর চিকিৎসা। অর্থাৎ, শিক্ষাকে সমর্থন দেবে গবেষণা আর শিক্ষা ও গবেষণাকে সমর্থন দেওয়ার জন্য চিকিৎসা।

 

আমি ব্যক্তিগতভাবে ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবরের কাছে অত্যন্ত ঋণী। কৃতজ্ঞ। এটা আমাকে স্বীকার করতেই হবে। কারণ ব্যক্তিগতভাবে কখনো ভাবিনি, আমি বিজ্ঞানচর্চা করবো। বিজ্ঞান বিষয়ে আমি যা কিছু শিখেছি, ফজলে আকবরের কাছ থেকে শিখেছি। এতে আমার প্রাপ্তিও কম না। আমি কিউবান একাডেমি অব সায়েন্স থেকে ২০১৯ সালে তাদের সর্বোচ্চ পদকটি পেয়েছি। তার চেয়েও বড় কথা, যে পদকটি আমি পেয়েছি ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবরের সঙ্গে যৌথভাবে পেয়েছি। বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস আমাকে ‘বাস-গোল্ড মেডেল এওয়ার্ড’-২০২২ দিয়েছে। আমি মনে করি, এটি আকবর ভাইয়েরই প্রাপ্য। আমার ব্যক্তি জীবনের প্রাপ্তি, আমার রোগীদের প্রাপ্তি, আমার বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাপ্তি সবকিছুর পেছনে ন্যাসভ্যাকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ফলে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর ও ন্যাসভ্যাকের কাছে আমি জীবনভর ঋণী থাকবো। এই ঋণ শোধ করার মতো নয়। 

 

শ্রুতিলিখন : জান্নাতুল ফেরদৌস


সূত্র : আমাদের নতুন সময়