ছবি: সংগৃহিত।

আল্লাহ তাআলা এই মহাবিশ্ব মানুষের কল্যাণেই সৃষ্টি করেছেন। তাই মানুষের বসবাসের উপযোগী করতে যেসব উপাদান আবশ্যক, সবই তিনি সৃষ্টি করেছেন। আসমান-জমিন, পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, খাল-বিল, বনাঞ্চল, গাছপালা, পশুপাখি, আবহাওয়া-বায়ুমণ্ডল—সবই পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের প্রকৃতিবিরুদ্ধ অপকর্মের ফলে বায়ুমণ্ডলে ক্ষতিকারক গ্যাস, বিশেষ করে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যাওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ। তাই বলা হয়, জলে-স্থলে আবহাওয়ার যে পরিবর্তন আসে, তা মানুষেরই কৃতকর্মের ফসল। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের কারণেই জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে তাদের কোনো কোনো কর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সুরা রুম: ৪১)

পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল একসময় গাছপালা ও বনাঞ্চলে পূর্ণ ছিল। ব্যাপক হারে গাছ নিধন করে নির্বিচারে বন-জঙ্গল উজাড় করছে মানুষই। সেসব জায়গায় গড়ে উঠছে বিভিন্ন কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ি। ফলে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমছে। কার্বনের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।


পরিণামে দেশে প্রায়ই দেখা দিচ্ছে বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, সিডর, সাইক্লোনের মতো পরিবেশবিধ্বংসী বিভিন্ন বিপর্যয়। পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব বয়ান করে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি আকাশসমূহ ও পৃথিবী এবং এ দুইয়ের মধ্যবর্তী কোনো কিছুই খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। আমি এগুলো যথাযথ উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করেছি, কিন্তু এদের অধিকাংশই এটা জানে না।’ (সুরা দুখান: ৩৮-৩৯)

সুতরাং কেউ যখন সৃষ্টিজগতের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে কৃত্রিম উপায়ে বাধাগ্রস্ত করতে চায়, তখনই নেমে আসে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আগামীর বিশ্বে যে মহাদুর্যোগের সূত্রপাত ঘটতে দেখা যাচ্ছে, তা মানবজাতির জন্য বিরাট অভিশাপ। প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের নির্মমতা ও নির্দয়তার প্রতিশোধ নিতে যেন খেপে উঠেছে প্রকৃতি স্বয়ং। অতীতে অনেক সম্প্রদায় জলবায়ুর বিবর্তনেই শেষ হয়ে গেছে; কওমে আদ, কওমে সামুদ, কওমে নুহ ও কওমে লুত ধ্বংস হয়ে গেছে।

ধর্মপ্রাণ মানুষকে পরিবেশ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে। নির্বিচারে গাছ নিধনের মতো পরিবেশবিনাশী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। কোনো প্রয়োজনে গাছ কাটা হলে এর পরিবর্তে বেশি করে গাছের চারা রোপণ করতে হবে। প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করে মহানবী (সা.) বলেন, ‘যদি কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার মুহূর্তেও তোমাদের কারও হাতে একটি চারা গাছ থাকে, তাহলে সে যেন ওই মুহূর্তেও তা রোপণ করে দেয়।’ (মুসনাদে আহমদ) বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটতে নিরুৎসাহিত করেছেন মহানবী (সা.)। মুতার যুদ্ধে সেনাপতিকে লক্ষ্য করে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা কোনো খেজুরগাছ জ্বালিয়ে দেবে না এবং কোনো গাছ কাটবে না।’ অপর এক হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে কাঁটাযুক্ত কোনো গাছ কাটবে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।’ (আবু দাউদ)

ইসলামে পশুপাখির প্রতি মমতা দেখানো ইবাদতের পর্যায়ভুক্ত এবং যেকোনো প্রাণীর ওপর দয়া করার মধ্যেও সওয়াব আছে। পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে প্রকৃতিবিরুদ্ধ সব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা ও মানুষকে বিরত রাখার ব্যাপারে আমাদের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। পুরো সৃষ্টিজগৎ মহান আল্লাহ তাআলার পরিবার। তার মধ্যে মানুষই আল্লাহ তাআলার সেরা সৃষ্টি। তাই মানুষকে পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।

ইসলাম পৃথিবীর সুরক্ষার কথা বলে। মুসলমান মাত্রই বিশ্বাস করে, মানুষই পৃথিবীর অভিভাবক বা পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি। আর এ কারণেই কৃতকর্মের জন্য তাদের আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। জবাবদিহির এ বিশ্বাস খুব শক্তিশালী ও ফলদায়ক। মুসলিম বিশ্বের পরিবেশনীতিতে পরিবর্তন আনতে এ বিশ্বাসই জলবায়ু পরিবর্তনের ইসলামি ঘোষণাপত্রে প্রয়োগ করা হয়। এ বিষয়ে মুসলমানদের কোরআন ছাড়া অন্য কোনো নির্দেশনার দরকারই পড়ে না। খোদ কোরআনেই পরিবেশ সচেতনতাবিষয়ক অন্তত ২০০ আয়াত রয়েছে। বাস্তবতা হলো, মানুষের চারণভূমি, আল্লাহর সবচেয়ে মূল্যবান সৃষ্টি পৃথিবী রক্ষা করার চেয়ে বড় ইসলামি কাজ আর কোনোটিই হতে পারে না।

তাই এ দৃষ্টিভঙ্গি মুসলমানদেরই সবার আগে লালন করতে হবে। প্রকৃতির ওপর মানুষের বিরূপ আচরণ বন্ধ করতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা না করলে অচিরেই পৃথিবীতে নেমে আসবে কল্পনাতীত বিপর্যয়। আমাদের উচিত, পৃথিবীর পরিবেশ নিরাপদ রাখতে সবাইকে সজাগ ও সচেতন করা, সবুজায়ন-বনায়ন করা এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা। পাশাপাশি আরও যত প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, সবকিছুর যথাযথ ব্যবহার, পরিচর্যা ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করা। কলকারখানায় কালো ধোঁয়া নির্গমন কমিয়ে আনতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির সন্ধান করতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তন রোধে মসজিদের ইমাম, খতিব ও ধর্মীয় বক্তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসচেতন সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা তৈরিতে মসজিদের মিম্বার ও ওয়াজের মঞ্চ হতে পারে চমৎকার ক্ষেত্র। কোরআন-হাদিসের আলোকে গঠনমূলক নির্দেশনা নিয়ে এ ক্ষেত্রে আলেমদেরই এগিয়ে আসতে হবে। পৃথিবীর ভারসাম্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে ইসলাম যে নীতিমালা দিয়েছে, তা যদি মুসলিম স্কলাররা ঐক্যবদ্ধভাবে বিশ্বমানবকে, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে তুলে ধরেন, তাহলে হয়তো পরিবেশ সংরক্ষণে মুসলমানেরা আরও বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

সিলেটভিউ২৪ডটকম/এনএম/আরআই-কে


সূত্র : আজকের পত্রিকা