পত্রিকার পাতা খুললে কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দিকে তাকালে ইদানীং ডিম নিয়ে, ডিমের দাম নিয়ে বাজারে যে অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে তা প্রতিনিয়তই চোখে পড়ছে। কেউ বেশি দামে আবার কেউ ডিম না কেনার পক্ষপাতমূলক পরামর্শ দিচ্ছেন। দামের যে উর্ধ্বগতি তাতে আমাদের স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ যে অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই ।

পরিসংখ্যান আনুযায়ী, আমাদের দেশে একজন মানুষ গড়ে বছরে প্রায় ১০৫টি ডিম খেয়ে থাকে, যা খুব বেশি নয়। কারণ একজন মানুষ দিনে ১-২ টি ডিম খেতে পারে এবং পুষ্টি বিবেচনায় ও কর্মক্ষম থাকতে তা একান্ত প্রয়োজনীয়। উন্নত বিশ্বে যেমন জাপানে একজন মানুষ গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৩১০টি ডিম খেয়ে থাকে।


আমাদের এই পুষ্টির উৎস মূলত নিজস্ব কিংবা ক্ষুদ্র পোল্ট্রি খামার । অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এখনও আমরা আমাদের খামারিদের বড় একটা অংশ প্রান্তিক পর্যায়ের যেখানে প্রযুক্তির ব্যবহার কিংবা ব্যবহারের উপযুক্ত পরিবেশ অত্যন্ত নাজুক। প্রযুক্তি ও প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতার অভাবে বেশির ভাগ খামারিরা উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা ও রোগের প্রকোপ সামাল দিতে না পারায় বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। ফলে ডিমের বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তাই পোল্ট্রি খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এ শিল্পকে টেকসই করতে পারে। উপরন্ত, খরচ কমানো, ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধি, গুণগতমান বৃদ্ধি ও নিশ্চিত করার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ক্রমাগত সরবরাহ নিশ্চিত করে ডিমের বাজার এর স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারে।

বর্তমান বিশ্বে মাংস উৎপাদনের সবচেয়ে বড় উৎস হল পোল্ট্রি যা ২০১৭ সাল থেকে প্রথম স্থান দখল করে রয়েছে এর সহজলভ্যতা, সহনীয় মূল্য এবং কোন ধর্মীয়গুষ্টির জন্য  বিধিনিষেধ না থাকায় । এছাড়াও, এ মাংসকে চর্বিহীন/কম চর্বিযুক্ত মাংস হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং এতে কোন জটিল কাঠামোগত প্রোটিন থাকে না, তাই ডায়াবেটিক রোগী এবং শিশুদের জন্য ভাল। তাছাড়া ডিম ও পোল্ট্রি পণ্যের বায়োলজিক্যাল ভ্যালু অনেক বেশি। তাই, পোল্ট্রি খাত খাদ্য নিরাপত্তার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এছাড়াও, ডিম বিশ্বব্যাপী সব শ্রেণির মানুষের জন্য প্রোটিনের একটি বড় উৎস এবং প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় এটি একটি সাধারণ আইটেম। অন্যান্য গবাদি পশুর তুলনায় এটি উৎপাদনের জন্য কম জায়গার প্রয়োজন এবং সেইসাথে কম মিথেন উৎপাদন করার ফলে পরিবেশের উপর প্রভাব কম।

বাংলাদেশ মুরগি ও ডিম উৎপাদন খাতে প্রযুক্তি প্রয়োগে অনেক পিছিয়ে রয়েছে যেমন অভ্যন্তরীণ গুণ নির্ণয়ভিত্তিক ডিমের গ্রেডিং, পোল্ট্রি ওয়েলফেয়ার , ডিম ও মুরগি উৎপাদন ব্যবস্থায় তথ্যবিজ্ঞানের অভাব ইত্যাদি। প্রচলিত পদ্ধতিতে ডিমের গ্রেডিং করা হয় আকার, ওজন এবং মা পাখির বয়সের উপর ভিত্তি করে। প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে, বিভিন্ন সেন্সিং সিস্টেম ব্যবহার করে ডিমের অভ্যন্তরীণ ও পুষ্টি উপাদান, উর্বরতা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে ডিমের গ্রেডিং করা যেতে পারে। প্রযুক্তির এই যুগে, আমরা আমাদের পোল্ট্রি সেক্টরে উন্নত প্রযুক্তির (যেমন অটোমেশন, অপ্টিকাল সেন্সিং এবং ইনফরমেটিক্স) প্রবর্তন এবং গ্রহণ না করে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কিংবা দেশীয় বাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। প্রযুক্তির ব্যবহার কম খরচে উৎপাদন বৃদ্ধি ও  বাজারে ডিম ও পোল্ট্রি পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারে। শুধু পর্যাপ্ত উৎপাদন (mass production) নিশ্চিতকরণ নয় উপরন্ত আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এর গুণমান বজায় রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে । প্রযুক্তির অনুপস্থিতিতে আমাদের অবশ্যই দুর্বল ব্যবস্থাপনা, সময়সাপেক্ষ ও কম দক্ষতা, বারবার বার্ড ফ্লু/অসুখের কারণে উৎপাদনহীনতায় ভুগতে হবে। প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে আমরা ভোক্তাভেদে পুষ্টির চাহিদা এমনকি এস্থেটিক ভ্যালু এর চাহিদা নিশ্চিত করতে সক্ষম হব।

শুধু উৎপাদন বৃদ্ধির ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে এখন আর চলবে না, যা এখন অতীত। আমাদের জৈব নিরাপত্তা (বায়ো সিকিউরিটি)  নিশ্চিত করতে অটোমেশন এবং স্মার্ট ফার্মিং সিস্টেম (শিল্প বিপ্লব ৩ -৪ ) এর চিন্তা করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, একটি স্মার্ট ইনকিউবেটরের ভিতরে ডিম ফুটানোর রিয়েল টাইম গ্রেডিং করতে সক্ষম যা অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে এবং পোল্ট্রি হ্যাচারি র জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। স্মার্ট পোল্ট্রি ফার্মিং মানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ (AI) যা প্রযুক্তি এবং সিস্টেমকে বোঝায় যা বিভিন্ন ডিভাইসকে কম্পিউটারে মানুষের মতো জটিল সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম করে। বর্তমান সময়টিকে তৃতীয় AI বুম হিসাবে বিবেচনা করা হয় যেখানে অন্তর্নির্মিত AI ফাংশনগুলি যানবাহন, নজরদারি ক্যামেরা, রোবট থেকে শুরু করে হোম অ্যাপ্লায়েন্স পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিকাশ ও বাজারজাত করা হয়েছে। এই AI-এর বিকাশ আইওটি (ইন্টারনেট অফ থিংস) প্রযুক্তির বিকাশের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। তাপীয় আরাম নিশ্চিত করতে প্রযুক্তি ব্যবহার হ্যাচারি ও পোল্ট্রি খামারে বিভিন্ন ঝুঁকি কমাতে পারে। এটি পাখির ঘনত্বের অনুমান এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা, স্বয়ংক্রিয়ভাবে খাবার বাবস্থাপনা, রোগ সংক্রমণ রোধে মানুষের হস্তক্ষেপ হ্রাস এবং দূষণ প্রতিরোধের জন্য অভ্যন্তরীণ পরিবেশ নিয়ন্ত্রক সেন্সর ব্যবহার করা যেতে পারে।

উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, অসুস্থতা এবং মৃত্যুহার হ্রাস, রোগের সূত্রপাত এবং বিস্তারের সম্ভাবনা হ্রাস, পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাস, স্থান এবং অন্যান্য ইনপুটগুলির দক্ষ ব্যবহার এবং ব্যবস্থাপনার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করা প্রয়োজন। এছাড়া, এ শিল্পে প্রযুক্তির ব্যবহার ডিমের অভ্যন্তরীণ গুণগতমান নিশ্চিত করতে পারে যেমন কুসুমের রঙ, কুসুমের অনুপাত, পুষ্টি ইত্যাদি। শব্দ সেন্সর ব্যবহার করে খোসা এর ফাটল সনাক্তকরণ, অপটিক্যাল সেন্সর ব্যবহার করে ত্রুটি, উর্বরতা ইত্যাদি নির্ণয় করা সম্ভব।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে, আমরা এখন আর শুধু চাহিদা মেটাতে উৎপাদন (খাদ্য সরবরাহ) গণনার সীমারেখার মধ্যে নেই। আমাদের বর্তমান ও নতুন প্রজন্মের জন্য সুস্থ ও সমৃদ্ধ জীবনযাপনের জন্য পুষ্টি ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার কথা ভাবতে হবে। আর এ জায়গাটায় আধুনিক প্রযুক্তি প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে। পোল্ট্রি শিল্পের দ্রুত উন্নতি ও বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রযুক্তিকে সাদরে গ্রহণ করতে হবে। আমাদের খামারির বড় একটা অংশ প্রান্তিক পর্যায়ের, এ খাতে কিভাবে প্রযুক্তিগুলি প্রান্তিক পর্যায়ে পৌছনো যাবে সে বিষয়ে ভাবতে হবে, কাজ করতে হবে।


লেখক: ড. খালিদুজ্জামান এলিন, শিক্ষক, খাদ্য প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।