বায়ে হারিছ চৌধুরী, ডানে তার মেয়ে। মধ্যখানে আশিক চৌধুরী।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা আবুল হারিছ চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা তানজিন চৌধুরীকে ‘গলাটিপে মারবেন’ বলে হুমকি দিয়েছেন তার চাচা আশিক উদ্দিন চৌধুরী। সিলেটের কানাইঘাটে একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এই হুমকি প্রদান করেন তিনি।

আশিক উদ্দিন চৌধুরী সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ও কানাইঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি প্রয়াত আবুল হারিছ চৌধুরীর আপন চাচাতো ভাই।


হারিছ চৌধুরীদের গ্রামের বাড়ি কানাইঘাটের দিঘিরপাড় পূর্ব ইউনিয়নের দর্পনগর গ্রামে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় থেকে পলাতক ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্য, ইরান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আছেন বলে গুজব ছিল। তবে গত বছরের শুরুর দিকে জানা যায়, ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকাতেই মারা গেছেন হারিছ চৌধুরী। তিনি করোনাক্রান্ত ছিলেন। এও বেরিয়ে আসে, হারিছ চৌধুরী দেশ ছেড়ে কখনোই যাননি। ঢাকাতেই আত্মগোপন করে ছিলেন তিনি।

গত ১৭ জানুয়ারি সকালে আশিক উদ্দিন চৌধুরীর বাবার নামে ‘রফিকুল হক চৌধুরী স্মৃতি পরিষদ’ এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেদিন আত্মপ্রকাশ ও শীতবস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে সামিরা তানজিন চৌধুরীকে ‘গলাটিপে মারার’ হুমকি দেন আশিক চৌধুরী। এ ছাড়া হারিছ চৌধুরীর স্বজনদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারও করেন তিনি।

আশিক চৌধুরীর এমন হুমকি ও গালাগালির প্রেক্ষিতে গতকাল সোমবার রাতে কানাইঘাট থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন সামিরা চৌধুরীর চাচাতো ভাই রাহাত চৌধুরী। এই রাহাত হচ্ছেন হারিছ চৌধুরীর আপন ভাই কামাল চৌধুরীর ছেলে।

অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি সিলেটভিউকে নিশ্চিত করেছেন কানাইঘাট থানার এসআই ও তদন্ত কর্মকর্তা পিযুষ চন্দ্র সিংহ।

জানা গেছে, হারিছ চৌধুরীর বাবার নামে  এলাকায় ‘শফিকুল হক চৌধুরী মেমোরিয়াল এতিমখানা’ আছে। ২০০৩ সালে এই এতিমখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এতিমখানাটি নিবন্ধিত (নং ৮১১/২০০৩) হয়।

হারিছ চৌধুরী মারা যাওয়ার পর তার মেয়ে সামিরা চৌধুরী এই এতিমখানার বিষয়ে খোঁজখবর রাখতে শুরু করেন। চাচা কামাল উদ্দিন চৌধুরী ও চাচাতো ভাইদের সঙ্গে এতিমখানার বিষয়ে কথাবার্তা বলেন সামিরা। এতে ক্ষুব্ধ হন আশিক চৌধুরী। তাকে পাশ কাটিয়ে অন্যদের সাথে এতিমখানার বিষয়ে কথাবার্তা বলায় রেগে যান তিনি।

আশিক চৌধুরীর রাগ আর ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে গত ১৭ জানুয়ারি। সেদিন হারিছ চৌধুরীর স্বজনদের গালাগাল ও হুমকিধামকি দেন তিনি। একপর্যায়ে সামিনা চৌধুরীকে ‘গলাটিপে মেরে ফেলার’ হুমকি দেন।

সেদিনকার অনুষ্ঠানের একটি ভিডিওচিত্র পেয়েছে সিলেটভিউ২৪ডটকম। ভিডিওতে দেখা যায় আশিক উদ্দিন চৌধুরী বলছেন, “এতিমখানা টিকিয়ে রাখতে আমার যতো শক্তি নিয়োগ করা লাগে, আমি করবো ইনশা আল্লাহ! কোনো বাজে মানুষ এতিমখানায় ঢুকবে, এতিমখানাকে নষ্ট করবে, তাদেরকে ঢুকতে দেব না। মোটেও ঢুকতে পারবে না....। এতিমখানার কোনো রুজি (আয়) নাই। যে কজন মানুষ এতিমখানায় সহযোগিতা করছেন, নিজের খেয়ে করছেন। এতিমখানায় বছরে সরকার কিছু টাকা দেয় আর বাকি টাকা পরিবার থেকে ও মানুষে সহযোগিতা করেন। হারিছ চৌধুরী আজ দুনিয়ান নেই, তিনি থাকলে....কাল (১৬ জানুয়ারি) রাতে আমি আমার ঘরে সেলিম, ফখর, ফজইসহ কয়েকজন গল্প করেছি। তখন আমি বলেছি, যেভাবে পারি একটা বছর আমরা এতিমখানাকে চালিয়ে নিই। এরপরে আমার বিশ্বাস, আওয়ামী লীগের পতন হবে.....আর আওয়ামী লীগের পতন হলে বিএনপি আসবে, বিএনপি এলে তাদের কাঁধে এই এতিমখানা তুলে দিতে পারবো। হারিছ চৌধুরী আর কিছু রেখে যাননি, এই এতিমখানা রেখে গেছেন, এটা তার স্মৃতি, এরা (বিএনপির) কেউ না কেউ কাঁদে নিয়ে নেবেন।”

গালাগাল দিয়ে আর ব্যঙ্গ করে আশিক চৌধুরী বলেন, “এখন কয়েকজন এতিমখানায় ঢুকে, বের হয়। এতিমখানায় কি হয় না হয় দেখে। টাউট বাটপার কয়টা, ***রের বাচ্চা কয়টা..আমার কথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, না? আল্লাহ মাফ করুন। এই এতিমখানা ধ্বংস করার জন্য তারা লেগেছে....এই এতিমখানা হারিছ চৌধুরীর স্মৃতি, এটা মিটিয়ে ফেলি। হারিছ চৌধুরীর নাম জীবনে মুখে শুনলাম না, একটা দিন হারিছ চৌধুরী সম্পর্কে ফেসবুকে লিখতে দেখলাম না, আজ ***র বাচ্চারা হয়ে গেছে লেখক! ***র বাচ্চারা আজ হয়ে গেছে এতিমখানার দরদি! হারিছ চৌধুরীর দরদি! ***রের বাচ্চারা.. আমার চেয়ে বেশি হারিছ চৌধুরীর দরদি কোন ***রের বাচ্চা?”

একপর্যায়ে তিনি বলেন, “আমার রাগে গালি দিয়েছি, আবারও বলছি ***রের বাচ্চা, মানুষের বাচ্চা নয়, ***রের বাচ্চা। না হলে এই চিন্তা করা উচিত ছিল, হারিছ চৌধুরী দুনিয়ায় নেই, এই এতিমখানা কিভাবে টিকিয়ে রাখা যায়, প্রথমে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত ছিল...>আজ হারিছ চৌধুরীর ভাই সেলিম চৌধুরী দুনিয়ায় নেই, হাসনাত চৌধুরী দুনিয়ায় নেই, মুকিত চৌধুরী থেকেও নাই, কামাল তো কোনো **ল জানে না, **ল সে কী জানে? আমার বাড়িতে অথর্ব কেউ যদি থাকে, তবে কামাল আছে। তার সঙ্গে কানাকানি করছেন, আর তার সঙ্গে কানাকানি করে কিভাবে এতিমখানাকে ধ্বংস করা যায়....”

ব্যঙ্গ করে আশিক চৌধুরী বলেন, “এতিমখানার সভাপতি হবেন! তাদের মাকে বিয়ে দেব.....এতিমখানার সেক্রেটারি হবেন! তাদের মাকে হাঙ্গা দেব...আমি বেঁচে থাকতে এতিমখানার সভাপতি-সেক্রেটারি কিভাবে হয়, দেখব।”

বক্তব্যের সময় আশিক উদ্দিন চৌধুরীকে একজন তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। তখন আশিক চৌধুরী আরও ফুঁসে ওঠে বলেন, “আমার রাগ ওঠে গেছে, **ল ছিঁড়লে যেন ছিঁড়ে ফেলে...***য়েরর বাচ্চা।”

এরপরই তিনি বলেন, “মনে কিছু নিও না, তোমরা মনে করবে চেয়ারম্যান কমিন্ধ (খারাপ)। আসলে ইলিয়াস আলীর কাছ থেকে গালমন্দ ওগুলো কিছু শিখেছি। আমি দেখেছি, কোনো কোনো সময় গালি না দিলে ঠিক হয় না। ইলিয়াস আলী..আল্লাহ তাকে হায়াত দান করুন; দোয়া করি তিনি আবার আমাদের মধ্যে ফিরে আসুন। কোনো কোনো জায়গায় আমি দেখতাম, আগুনের মতো গরম হতেন (ইলিয়াস), এর পরে সবকিছু ঠিক হতো।”

বিভিন্নজনের কাছ থেকে এতিমখানার জন্য অর্থ ও সহযোগিতা এনেছেন বলেও উল্লেখ করেন আশিক চৌধুরী। হারিছ চৌধুরীর অন্তরে সবসময় এতিমখানা ছিল বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

আশিক চৌধুরী বলেন, “এই **লরা আমার ***ল একটা ছিঁড়তে পারবে না। আশিক চৌধুরী মরে গেলেও আশিক চৌধুরী, চেয়ারম্যান না থাকলেও আশিক চৌধুরী, এমপি-সেমপি কোনো ***ল না হলেও আশিক চৌধুরী...আমার ***ল এরা জীবনেও ছিঁড়তে পারবে না। লম্বা লম্বা কথা বলে লাভ নাই, এখন যাদেরকে খাইয়ে-পরিয়ে রাখছি, ওদেরকে দিয়ে পিটিয়ে গুড়ো করে দেব...”

ওই সময় শামীম নামের একজনের দিকে আঙ্গুল তাঁক করে আশিক চৌধুরী বলেন, “কিরে শামীম, পিটবে না?” তখন উপস্থিত লোকদের মধ্য থেকে‘ঠিক’ বলে শোরগোল ওঠে। পরে আশিক চৌধুরী বলেন, “আমার ওদের দিয়ে পিটিয়ে ***র বাচ্চাদের শেষ করে ফেলবো।”

তিনি বলেন, “হারিছ চৌধুরীর পরিবার ধ্বংস করে ফেলবে তারা....এই অসুস্থ হয়েছি, সবার আগে হারিছ চৌধুরীর বড়বোন ফোন দিয়েছেন, যে বোনের ওপর আমিও গোস্বা। আমি ফোন না ধরায় আমার বোনের কাছে তিনি ফোন দিয়েছেন...আমরা তো আমরা।”

এরপর সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, “হারিছ চৌধুরীর কমবয়সী মেয়ে আসছে, তাকে চ্যানেলে চ্যানেলে নেওয়া হচ্ছে। গলাটিপে ধরে হারিছ চৌধুরীর মেয়েকে মেরে ফেলবো। আমি তার মায়ের জামাই, আমি তার বাপ...আজ বাবা দুনিয়ায় নেই, আমি তার বাবা....ধৈর্য্য অনেক ধরেছি, গলাটিপে ধরবো। আর আমার বাড়িতে ঢুকবে কানাকানি করার জন্য, মারতে মারতে ***র বাচ্চাদের বাড়ি থেকে বের করে দেব। তোমরা রেডি থেকো গল্লাটল্লা নিয়ে, মারতে মারতে বের করে দেব....ডাক দেব আমার মাখন-টাখন যারা আছে সবাইকে....”

হারিছ চৌধুরীর মেয়ে এলে কেউ যদি কানাকানি করতে যায়, তবে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দেন আশিক চৌধুরী।

গালাগালি করে ‘মনের ফোলা’ গেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এই বক্তব্য, গালাগালি আর হুমিকর বিষয়ে কথা বলতে আশিক উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে আজ মঙ্গলবার দুপুর ১টা ৫ মিনিটে যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদক। তখন আশিক চৌধুরী বলেন, ‘আমি গাড়িতে আছি, পরে কথা বলবো।’

এরপর বিকাল ৩টা ৩৭ মিনিটে তাকে আবার কল দেওয়া হয়। তখন তিনি বলেন, ‘আমি বিয়ের অনুষ্ঠানে, শেষ হোক...।’

সিলেটভিউয়ের পক্ষ থেকে সামিরা চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।

এদিকে, লিখিত অভিযোগে সামিরার চাচাতো ভাই, কামাল চৌধুরীর ছেলে রাহাত চৌধুরী ফৌজদারি, জননিরাপত্তা ও ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে আশিক চৌধুরীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে অনুরোধ করেছেন।

কানাইঘাট থানার এসআই পিযুষ চন্দ্র সিংহ সিলেটভিউকে বলেন, ‘আমরা লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। এখন সেটা তদন্ত করে দেখা হবে।’

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে