বাংলাদেশে যেহেতু বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে তা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ হতে পারে। ঢাকা সফরে আসা বিদেশি প্রতিনিধিরা সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে এমন বার্তাই দিতে চেয়েছেন। এ কারণে আওয়ামী লীগও সংঘাতের বিষয়ে সতর্ক থেকে রাজনীতির মাঠ নিয়ন্ত্রণের কৌশল নিয়েই এগোতে চায়। দলটির পরিকল্পনা হলো, পরিস্থিতি উত্তপ্ত না করে সহশীলতা দেখিয়ে বিএনপির রাজনীতিকে নির্বিষ রাখা। সে কারণে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা ডেরেক শোলের সফরের পরদিন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সংলাপের প্রসঙ্গটি আসে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে যা জানা গেছে, তার মূল বিষয় হলো বিএনপির চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রাখাই আওয়ামী লীগের একমাত্র লক্ষ্য। সরকারবিরোধী এ আন্দোলন দুর্বল করে রাখতে পারলে বিদেশি চাপও সামলে নিতে পারবে ক্ষমতাসীনরা। তাই সরকারি দলের সব মনোযোগ এখন বিএনপির আন্দোলন দুর্বল করে রাখা।


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ একাধিক দাবিতে মাঠে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, বিদেশি অবস্থান ও চাপ বিএনপির আন্দোলনের ধরন দেখে ওঠানামা করবে। তাই নির্বাচনের আগে বিএনপির আন্দোলন চাঙ্গা করার মতো কোনো সুযোগ আওয়ামী লীগ দিতে চায় না। তারা আরও বলেন, বিএনপির দাবিগুলো জোরালো নয়। তাদের সাত দফায় জনগণের কথা নেই। আছে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার রাস্তা প্রশস্ত করার কথা। ফলে জনসম্পৃক্ত কোনো ইস্যু না থাকায় বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন জমবে না ধরে নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। এর ফলে বিদেশি চাপও দুর্বল হয়ে পড়বে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, ‘বিএনপির অন্যায়-অন্যায্য দাবি যেমন মানা হবে না, তেমনি ভোটের আগে ভোট বানচাল করার যে পরিকল্পনা রয়েছে, বিএনপির সেটাও সহ্য করা হবে না। পেট্রলবোমা, অগ্নিসন্ত্রাস করার কোনো সুযোগ বিএনপিকে দেওয়া হবে না।’

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, সামনে রোজা, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা এবং বর্ষাকাল। এ সময়ে কঠোর আন্দোলন করতে গেলে সাধারণ মানুষ বিরক্ত হবে। এভাবে বছরও কেটে যাবে। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসবে। এ বিবেচনা থেকে নির্বাচন ডিসেম্বরে করে ফেলারও পরিকল্পনা নিতে পারে আওয়ামী লীগ সরকার। তারা বলেন, সে কারণেই দলের পক্ষ থেকে ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে পারে এমন ইঙ্গিত দিয়ে রাখা হয়েছে।

ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, বিএনপির পক্ষে জনসম্পৃক্ততা ঘটানো সম্ভব হলে শুধু বিদেশিদের চাপ বাড়তে পারে। তা না হলে সরকারের পক্ষেই থাকবে বিদেশিরা। তারা আরও বলেন, বিদেশিদের এমন অবস্থানের বার্তা তারা পেয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু গত জানুয়ারিতে, দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা ডেরেক শোলে এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় খাতরা গত সপ্তাহে ঢাকা সফর করেছেন। এ সময় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। তাদের কেউ বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেননি। এরপর থেকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আরও সক্রিয় হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ।

দলটির সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নির্বাচন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ মাঠে থাকবে। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার মূল কারণ হলো আন্দোলনের নামে সংঘাত-সহিংসতার সুযোগ যাতে বিএনপি ও তাদের সমমনারা না পায়। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের ভাবনা সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতে পারলে বেগতিক অবস্থা সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। তা না হলে নিশ্চিন্তেই কাটাতে পারবে সরকার- এমন তৃপ্তিও আছে অনেকের ভেতরে। নানা সমালোচনার ভেতরেও বিএনপির কর্মসূচির দিন মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কারণও মাঠের নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখা। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এ নেতা বলেন, মাঠে থাকার বিষয়ে সমালোচনা আমলে নেবে না দল। ‘পাহারাদার’ হিসেবে আওয়ামী লীগ মাঠে থাকছে, এটা প্রতিষ্ঠিত করতে চান তারা।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি সন্ত্রাস-সহিংসতা ও অরাজকতা সৃষ্টি করবে আর আওয়ামী লীগ ও সরকার তা বসে বসে দেখবে? তাহলে বিএনপির কর্মসূচি সারা বছর থাকবে, আওয়ামী লীগ বা অন্য রাজনৈতিক দল কর্মসূচি পালন করবে না? ফলে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি পাল্টাপাল্টি হিসেবে দেখা বা বলা কতটুকু প্রাসঙ্গিক।’

আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক সদস্য বলেন, বিদেশি অবস্থান এখন যেরকম তাতে নির্বাচন পর্যন্ত দেশে স্বাভাবিক ও শান্ত পরিবেশ বজায় রাখতে পারাই বড় চ্যালেঞ্জ তাদের জন্য। তাই বিএনপির কর্মসূচিগুলোতে মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। তবে মাঠে থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ সর্বোচ্চ সহনশীলতাও দেখাবে। কারণ তাদের লক্ষ্য রাজনীতির মাঠ নিস্তরঙ্গ রাখা। এ কারণে উত্তপ্ত পরিস্থিতি এড়াতে আওয়ামী লীগ নিজেরাও সতর্ক থাকবে। যাতে অন্য কেউ অর্থাৎ দেশি-বিদেশি কেউ সুযোগ নিতে না পারে।

বিদেশিদের অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার করে আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য বলেন, তারা সরকারের সঙ্গেই আছে, সব পরিস্থিতি ঠিক থাকলে তাদের সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লে বিদেশি চাপ বাড়বে। জনগণ আওয়ামী লীগের সঙ্গে না থাকলে বিদেশিরাও থাকবে না। ফলে বিএনপির চলমান আন্দোলন বেশ সতর্কভাবে মোকাবিলা করা হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবে সরকার ও আওয়ামী লীগ। নির্বাচন পর্যন্ত দেশের পরিস্থিতি শান্ত রাখতে নরম ও গরম দুই পন্থা গ্রহণ করার পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগের।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের চাপ আছে। ওই সময় তিনি প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে বলেন, বিএনপি তো সংলাপে আসতে চায় না।

আওয়ামী লীগের নেতারা সেদিন সংলাপের সম্ভাবনার কথাও বলেছেন। এর জন্য নির্দিষ্ট কিছু করণীয়ও ঠিক করেছেন তারা। কেউ কেউ বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হবে।

এর পরই বিএনপির কয়েকশ নেতাকর্মীর জামিন হতে দেখা গেছে। এ ছাড়া আইনমন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে আইনি বাধা নেই। দুটি দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিএনপি চেয়ারপারসনের সাজা হয়। এরপর তাকে জেলে পাঠানো হয়। দেশের করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে সাজা স্থগিত করে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তখন বলা হয়েছিল, তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না এবং বিদেশে যেতে পারবেন না। এরপর বহুবার আবেদন করেও অসুস্থ খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যেতে পারেননি তার স্বজনরা।

আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক সদস্য বলেন, চাপ সৃষ্টিকারী বিদেশি শক্তিগুলো সরকারকে অবহিত করেছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে চায় না তারা। সরকারে যেই থাকুক তারা সে সরকারের সঙ্গে কাজ করবে। তবে পরিস্থিতি সংঘাতময় হওয়া যাবে না।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে


সূত্র : দেশ রূপান্তর