ফাইল ছবি।

বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর অবৈধ বেচাকেনা চলে। এসব প্রাণী অবৈধভাবে পাচার করা হয় প্রতিবেশী ভারত, মিয়ানমারসহ কয়েকটি দেশে। যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত এক গবেষণায় ওঠে এসেছে এমন তথ্য।

গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, দেশের মোট ১৩টি জেলায় বন্যপ্রাণীর বেচাকেনা চলে প্রকাশ্যে। এই তালিকায় আছে সিলেট জেলা। বাকি জেলাগুলো হচ্ছে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, রাঙামাটি, কক্সবাজার, বান্দরবান ও গাজীপুর।


বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী বেচাকেনা ও পাচার নিয়ে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গবেষণা শুরু হয় ২০১৮ সালের মধ্যভাগে। গবেষণা দলে ছিলেন ৮ জন।

গবেষক মো. নাসিরউদ্দিনের নেতৃত্বে এই দলে ছিলেন তানিয়া আখতার, আরিফুল ইসলাম, দেলোয়ার হোসেন, তাসনিম আরা, স্যাম ইনোচ, অ্যালিসি হুগেজ ও ক্রেইগ ফুলস্টোন।

সম্প্রতি তাদের গবেষণা প্রতিবেদনটি ‘এক্সপ্লোরিং মার্কেট-বেইজড ওয়াইল্ড লাইফ ট্রেড ডাইনামিকস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে যেসব স্থানে বন্যপ্রাণী বেচাকেনা হয়, সেসব স্থান গবেষক দল পরিদর্শন করেছেন। শুধুমাত্র ২০১৯ সালের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, সে বছর ৯২৮টি বন্যপ্রাণী বেচাকেনা হয়।

গবেষক দল ৪২৩ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে, যারা বন্যপ্রাণী বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত। তাদের পরিচয় অবশ্য গোপন রাখা হয়েছে। পরিচয় গোপন রাখা হবে এমন শর্তে এসব ব্যক্তিদের ৩৩৭ জন গবেষক দলকে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন, যেখানে তারা বন্যপ্রাণী বেচাকেনা, হত্যা ও পাচারের কথা স্বীকার করেছেন।

চিহ্নিত ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, যেসব প্রাণীর চাহিদা পাওয়া যায়, সেগুলোর জন্য আগেভাগেই দরদাম ঠিক করা হয়। এরপর বন থেকে সে প্রাণী ধরে এনে বিক্রি করা হয়।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন ধরে ধরে আনা বিভিন্ন ধরনের জ্যান্ত প্রাণী প্রকাশ্যে বেচাকেনা হয়। তবে বিদেশে পাচারের তালিকায় রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মুখপোড়া হনুমান, লজ্জাবতী বানর, তক্ষক, বিষধর সাপ, ছোট সরীসৃপ, উল্লুক, কালো ভালুক প্রভৃতি। যেসব প্রাণী জীবিত পাচার করা সম্ভব হয় না, সেগুলোকে হত্যা করে মাংস, হাড়, নখ, দাঁত, চামড়া, এমনকি রক্ত পর্যন্ত বিক্রি ও পাচার করা হয়। প্রাণী যতো দুর্লভ হয়, অর্থও ততো বেশি মেলে। বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সর্বনিম্ন ৩ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়।

গবেষক দল বলছে, সিলেটসহ যে ১৩টি জেলায় বন্যপ্রাণী বেচাকেনার কথা বলা হয়েছে, সেসব জেলার বনাঞ্চল থেকে ধরে আনা প্রাণীর অর্ধেক ঢাকায় পাঠানো হয়। এক-তৃতীয়াংশ যায় চট্টগ্রামে, বাকিগুলো যায় বাগেরহাট ও খুলনায়। ঢাকা থেকে বিমানযোগে বন্যপ্রাণী বিদেশে পাচার করা হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে বিদেশে পাচার করা হয় সমুদ্রপথে।

বন্যপ্রাণী সবচেয়ে বেশি পাচার হয় ভারত ও মিয়ানমারে। এ ছাড়া থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও লাওসে পাচার করা হয় বলে ওঠে এসেছে প্রতিবেদনে।

সিলেটসহ দেশের ১৩টি জেলায় হাট-বাজার, জনবহুল পয়েন্ট, বাসস্ট্যান্ড প্রভৃতিতে প্রকাশ্যে বনরুই, বিপন্ন পাখি, বেজি, সাপ, বানর প্রভৃতি প্রাণী বেচাকেনা হয়। কোথাও কোথাও বিভিন্ন জাতের প্রাণীর তেল, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গও বিক্রি হয়।

গবেষক দলের প্রধান মো. নাসিরউদ্দিন উল্লেখ করেন, যখন আন্তর্জাতিক বাজারে পাচারের চাহিদা বাড়ে, তখন বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী ধরা, হত্যা ও পাচার বেড়ে যায়। বিদেশে বেশি পাচার হয় বাঘ, বানর, সাপ ও তক্ষক-জাতীয় প্রাণী।

তাঁর মতে, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি সচেতন হয়, তবে বন্যপ্রাণী বেচাকেনা ও পাচার ঠেকানো সম্ভব।

গবেষক দলটি বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী ধরা, হত্যা ও পাচার ঠেকাতে ৭টি পরামর্শও দিয়েছে।

বনপ্রাণী পাচার ও হত্যার বিরুদ্ধে সচেষ্টা আছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক মো. ছানাউল্যা পাটওয়ারী। তিনি বলেন, ‘দেশের যেখানেই বন্যপ্রাণী পাচার ও হত্যার খবর পাচ্ছি আমরা, সেখানেই অভিযান চালাচ্ছি। ২০১২ থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৪৯ হাজার বন্য প্রাণী পাচারের সময় উদ্ধার করেছে বন অধিদপ্তর।’

গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বে অবৈধ পণ্যের বাজারের তালিকায় চতুর্থ স্থানটি বন্যপ্রাণীর। বছরে অন্তত ৩২ হাজার কোটি ডলার মূল্যের বন্যপ্রাণী বেচাকেনা হয়।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে