ছবি: তাসমিত আফিয়াতের সৌজন্যে

ফেসবুকে হঠাৎ ভাইরাল গায়েহলুদের একটা ছবি, যেখানে দেখা যাচ্ছে, ঘোড়ায় চেপে বরকে নিতে এসেছে বউ। ঘোড়ায় চেপে বউ আনতে চলেছে বর, এমনটা অনেক সিনেমাতেই দেখা যায় কিন্তু এখানে যে উল্টো চিত্র। বরকে নিতে এসেছে কনে! নানা চমকে ভরা আলোচিত সেই বিয়ের গল্পই শোনা যাক-


তাসমিত আফিয়াতের বাবা সরকারি চাকরিজীবী। তিনি চেয়েছিলেন, মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়ুক। সেই সুযোগও মেয়ে পেয়েছিলেন। তবে ছোটবেলা থেকেই তাঁর সৃষ্টিশীল কাজে আগ্রহ। তাই ভর্তি হয়ে গেলেন চারুকলায়, গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে। স্বাভাবিকভাবেই বাবার সঙ্গে মন–কষাকষি হলো। আর তখনই মেয়ে ঠিক করলেন, বাবার ইচ্ছায় যেহেতু পড়ছেন না, বাবার কাছ থেকে পড়াশোনা বাবদ কোনো অর্থও নেবেন না। তাই প্রথম বর্ষ থেকেই কাজে হাত দিলেন। পড়াশোনা শেষ করে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় ডিজাইনার ও শিল্পনির্দেশকের কাজ নেন তাসমিত আফিয়াত, কাছের মানুষেরা যাকে অর্নি নামেই চেনে বেশি। এই তাসমিতই আলোচিত সেই বিয়ের কনে। আর বর সাবিন হিন্টন। মার্কিন নাগরিক, পেশায় মার্কিন পররাষ্ট্রবিষয়ক কর্মকর্তা।



ডেকেছি কে আগে, কে দিয়েছে সাড়া

১৮ মাসের জন্য সাবিনের পোস্টিং ছিল ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে। সেই সময় ২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর এক কমন বন্ধুর মাধ্যমে সাবিন–অর্নির পরিচয়। ছয় মাসে কয়েকবার মাত্র দেখা হয়েছে। সাবিন বিশেষ একটা কথাবার্তা বলতেন না। সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। অর্নির ভাষায়, ‘ও সরাসরি বাংলায় প্রপোজ করল। আগে ওর সঙ্গে আমার কোনো প্রেমালাপ হয়নি। ও নাকি আমার ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছিল। ও কী বলল, সেটা বুঝতেই পাঁচ মিনিট লেগেছিল। আমি তো শুনেই “না” করে দিয়েছিলাম।’


কেন? ‘ছোটবেলা থেকেই আমি কাজপাগল মানুষ। উচ্চমাধ্যমিকের পর থেকে কাজ শুরু করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় যখন পড়ি, তখন থেকেই আমার নিজের ফ্যাশন ব্র্যান্ড আছে। আবার শিল্পনির্দেশনাও দিই। আমি খুবই স্বাধীনচেতা মানুষ। আমার অধীন যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সংসারের দায়িত্ব আমার। দেশ ছেড়ে, নিজের কাজ ছেড়ে এক বিদেশি নাগরিককে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা আমার জন্য কঠিন ছিল,’ অর্নির ঝটপট উত্তর।


সাবিন অর্নিকে বলেছিলেন, ‘আমার বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার একটা যৌক্তিক কারণ বলো।’ মিনিট দশেক ভেবেও কোনো কারণ খুঁজে পাননি অর্নি। এরপর সপ্তাহ দুয়েক সাবিনের সঙ্গে ‘ডেট’ করেন। তারপর নিজেই সাবিনের প্রেমে পড়ে গেলেন। কেন ভালো লাগল সাবিনকে? অর্নি বলেন, ‘ও খুবই ভদ্র, বিনয়ী একটা মানুষ। ওকে বিয়ে করলে আমার কাজ বা স্বাধীনতায় কোনো ক্ষতি হবে বলে মনে হয়নি। তখন বললাম, “আমার বাবা, মা আর ভাইকে রাজি করাও।” সাবিন মা দিবসে আমার মা আর ছোট ভাইকে মার্কিন দূতাবাসের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়ে পটিয়ে ফেলল।’


১৫ মে বাগদান আর বিয়ে, দুটেোই হয়ে গেল।  বরের ঢাকার বাসার ছাদেই সব হল। বনানীতে বিদেশি কূটনীতিকদের জন্য বরাদ্দ যে বাসা, তার ছাদে ছোট্ট করে অনুষ্ঠান। তারপর গায়েহলুদ আর সবশেষে সংবর্ধনা। গায়েহলুদে তাঁর পরনে ছিল রিকশা প্রিন্টের থিমে তৈরি লেহেঙ্গা। এই গায়ে হলুদেই ঘোড়ায় করে বর নিতে এসেছিলেন কনে। এই উল্টো রীতি কেন জানতে চাইলে কনের পাল্টা প্রশ্ন, ‘কে বলেছে, বরই কেবল বউকে নিতে আসবে? বউ কেন ঘোড়ায় চেপে বরকে নিতে আসতে পারে না?’
 

‘সব্যসাচী ব্রাইড না, রিকশা ব্রাইড হব’

ছোটবেলা থেকেই রিকশা থিম নিয়ে কাজ করেছেন অর্নি। উচ্চমাধ্যমিকের পর এনটিভির স্টাইল গুরু প্রতিযোগিতায় রিকশা থিমের কস্টিউম বানিয়ে তিনি প্রথম হন। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ায় অনুষ্ঠিত মিস ইউনিভার্সের আসরে শিরিন শিলাও পরেছিলেন অর্নির নকশা করা লাল জামদানি শাড়ি, সঙ্গে রিকশার হুড আর বর্ণমালার গয়না।


আগত অতিথিরাও পরেছিলেন রিকশা পেইন্টের থিমের পোশাক
 

১১ বছর ধরে ডিজাইনার হিসেবে কাজ করছেন অর্নি। বিয়ের কনেরা তাঁকে ভারতীয় বাঙালি ডিজাইনার সব্যসাচীর গাউন দেখিয়ে বলতেন সেটির মতো একটা গাউন বানিয়ে দিতে। শুনে অর্নির খারাপ লাগত। তিনি বললেন, ‘আমি ঠিক করেছিলাম, আমি সব্যসাচী ব্রাইড হব না; বরং রিকশা ব্রাইড হব। আমি সব অতিথির জন্য আমার ব্র্যান্ড স্ট্রাইড থেকে কটি আর ব্লাউজ পাঠিয়েছিলাম। সেখানে ছিল রিকশা পেইন্টের থিমে আমার আর সাবিনের চেহারা।’ 
 

বিয়েতে বাঙালিয়ানা

গায়েহলুদে আমন্ত্রিত অতিথিরা হলরুমে ঢুকতেই রিসেপশনে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয় আখের রস। বিদেশি অতিথিরা খুবই মজা করে আখের রস খেয়েছেন। পাতায় বানানো বাটিতে খেয়েছেন ফুচকা। ছিল চটপটি, হাওয়াই মিঠাই, মাটির কাপে চা, মিষ্টি পান ও আগুন পান। শুটিং (বেলুন ফাটানো), টিয়া পাখিকে দিয়ে ভাগ্যগণনার ব্যবস্থাও ছিল। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গামছা দিয়ে পাখনার মতো করে ফটোবুথ বানানো ছিল। আবার তালপাতার পাখার থিমেও আরেকটা ফটোবুথ ছিল। নিজের সংস্কৃতির পাঁড় ভক্ত অর্নি। বিয়ের সব আয়োজনে ছিল তারই ছোঁয়া।


কনেকে সাদা গাউনে দেখার ইচ্ছে ছিল বরের

 
অর্নিদের গায়েহলুদ আর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্র সিড–পেপার দিয়ে বানানো। প্রতিটি কার্ডে ব্যবহার করা হয়েছিল ১৫ থেকে ২০টি টমেটোর বীজ। তাই কার্ডটি টবে বা মাটিতে ফেলে রাখলেই গাছ জন্মাবে যেখান থেকে।
অর্নির বরের ইচ্ছা ছিল সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কনেকে সাদা গাউনে দেখার। বরের দাবি মেনে সাদা গাউনই পরেছিলেন, তবে তা তৈরি করেছিলেন জামদানি কাপড়ে। আর পরেছিলেন রুপার গয়না। ছোটবেলা থেকেই এই বাংলাদেশি ডিজাইনারের রুপা খুব পছন্দ। অর্নি বলেন, ‘বিয়েতে কেন সোনা বা হীরা পরতেই হবে? কনের যেটা ইচ্ছা, সেটা পরবে।’
 

সব তো হলো, এবার কী করবেন?

বিয়ের পরই যুক্তরাষ্ট্রে শ্বশুরবাড়ি থেকে ঘুরে এসেছেন অর্নি। গ্রিন কার্ডও নিয়েছেন। আপাতত কাতারের দোহায় আছেন। দুই থেকে তিন বছরের জন্য তাঁর জীবনসঙ্গীর পোস্টিং যে ওই দেশে। সেখান থেকেই নিয়মিত যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া–আসা করবেন। আর সময় পেলেই উড়াল দেবেন বাংলাদেশে। এই জানুয়ারিতেই আবার মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের কাজে দেশে আসার কথা আছে। বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, সেখান থেকেই নিজের ফ্যাশন ব্র্যান্ডের কাজ চালিয়ে যাবেন অর্নি। আর সময়–সুযোগ পেলেই টুকটাক শিল্পনির্দেশনার কাজ করবেন।

 

সিলেটভিউ২৪ডটকম/ডেস্ক/পল্লব-৫


সূত্র : প্রথম আলো