থানার ভেতরে পুলিশের সামনে এক যুবককে মারধর করছেন এক ব্যক্তি। ঘটনাটি গত বছরের আগস্ট মাসের। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানায় ঘটে। তবে মুঠোফোনে ধারণ করা নাজমুল ইসলাম নামের ওই যুবককে মারধর করার ভিডিওটি সম্প্রতি ফেসবুকে ছড়িয়েছে। এরপর বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলছে সিলেটসহ সারা দেশে। 

ঘটনাটি নিয়ে গত ২৪ মার্চ একটি সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়। এ খবরে নাজমুল ইসলাম নামের যুবককে মারধর করা ব্যক্তির নাম সুলতান আহমদ এবং তাকে ‘স্বর্ণপাচারকারী চক্রের নেতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। 


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই ব্যক্তির পুরো নাম সুলতান আহমদ হিরন (৪০)। তার বাড়ি মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ দক্ষিণ ইউনিয়নের কাশেমনগর গ্রামে। বাবার নাম মৃত আমিন আলী। সুলতান স্বর্ণ পাচার মামলায় গত বছরের ডিসেম্বর মাসে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছেন। সম্প্রতি তিনি জামিনে বেরিয়েছেন। তবে স্বজনদের দাবি, সুলতান ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জেলে গেছেন। 

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, সুলতান দীর্ঘদিন ধরে স্বর্ণপাচার কাজে জড়িত। তিনি প্রায় দুবাই থেকে দেশে আসা ব্যক্তিদের সাথে স্বর্ণ পাঠান। বিনিময়ে কাউকে বিমানের টিকিট দেন কিংবা টাকা দেন। গত বছরের আগস্টে সাটুয়ারিয়া থানার নাজমুল ইসলাম নামের এক যুবককে বিমানের টিকেটের বিনিময়ে সোনা দিয়েছিলেন সুলতান। কিন্তু নামজুল দেশে এসে সোনা না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দেন।

শনিবার (২৫ মার্চ) দুপুরে সুলতান আহমদ হিরনের খোঁজে তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। এলাকার লোকজন জানান, সুলতান দীর্ঘদিন ধরে দুবাইতে থাকেন। তবে সুলতান সোনা পাচারকারী কিনা তা তারা জানেন না। অবশ্য তারা শুনেছেন- সুলতান কয়েকমাস আগে সোনা পাচারের মামলায় ঢাকা বিমানবন্দর পুলিশের হাতে আটক হয়েছিলেন। সম্প্রতি তিনি জামিন পেয়েছেন। 

সুলতানের ভাই দুবাই প্রবাসী ফারুক মিয়া (৪৫) সিলেটভিউ-কে বলেন, আমরা তিনভাই এবং চার বোন। বড় ভাই কুয়েতে থাকেন। আর তিনি (ফারুক) গত দুই বছর ধরে দুবাইতে আছেন। আর হিরন প্রায় ১৫ বছর ধরে দুবাইতে আছেন। হিরন সেখানে সরকারি একটি অফিসের গাড়ি চালান। পাশাপাশি সেখানে ফ্লাট লিজ নিয়ে ভাড়া দেন। 

থানায় পুলিশের সামনে এক যুবককে মারধরের ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে ফারুক মিয়া এ প্রতিবেদককে বলেন, ঘটনাটি গত বছরের আগস্ট মাসের। 

তিনি বলেন, সুলতান এক বছর আগে বিয়ে করেছেন। তখন তার বিয়ের কাবিনে ১২ লাখ টাকার সোনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সোনাগুলো উসুল দেখানো হয়। কিন্তু তার স্ত্রীকে দেওয়া হয়নি। পরে সুলতান দুবাই গিয়ে তার স্ত্রীর জন্য এবং আমার এক বোনের মেয়ের জন্য স্বর্ণ কিনেন। সেই স্বর্ণ সুলতান দুবাইতে তার ফ্লাটে থাকা মানিকগঞ্জের নাজমুল নামে এক যুবকের কাছে দেন। সুলতান তাকে বিমানের একটি টিকেট ও সোনার টেক্স পরিশোধের জন্য আরও ৪০ হাজার টাকা দেন। কথা ছিলো- নাজমুল সোনাগুলো আমাদের স্বজনদের কাছে দেবেন। কথা অনুয়ায়ী গত বছরে অর্থাৎ নয় মাস আগে নাজমুল দেশে আসেন। নাজমুল যেদিন সোনা নিয়ে দেশে আসেন, ওইদিন আমার স্বজনরা বিমানবন্দরে সোনা আনতে যান। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় করে তারা নাজমুলের কোনো দেখা পাননি। পরে তারা নাজমুলের ফোনও বন্ধ পান। ঘটনার ৪-৫ দিন পর সুলতান দেশে আসেন। 

পরিবেশমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন সোনা উদ্ধারের বিষয়ে পুলিশের সঙ্গে আলাপ করেছিলান কিনা- এমন প্রশ্নের বিষয়ে ফারুক বলেন, আমার ভাই দেশে এসে আমাদের এলাকার এমপি ও পরিবেশমন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের কাছে বিচারপ্রার্থী হন। আমিও গিয়েছিলাম। পরে মন্ত্রী সোনাগুলো বৈধ কিনা জানতে চান এবং সোনা ক্রয়ের কাগজপত্র যাচাই করে দেখেন। মন্ত্রী কাগজপত্র দেখে সোনাগুলো বৈধ বলে নিশ্চিত হন। এসময় মন্ত্রীকে নাজমুলের নাম ঠিকানা দেন সুলতান। পরে মন্ত্রী মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানার পুলিশকে বিষয়টি জানান এবং সোনাগুলো উদ্ধারে আইনি সহায়তা চান। কিন্তু পুলিশ নাজমুলকে কোনোভাবে ধরতে পারছিল না। পরে পুলিশ নাজমুলের ফোন ট্র্যাকিং করে তার অবস্থান শনাক্ত করে। পরে সেখানকার চেয়ারম্যান ও মেম্বার এবং থানার ওসি মিলে বিষয়টি সমাধান করেছেন। প্রায় ২৭ লাখ টাকার সোনা মাত্র ১৫ লাখ টাকা দিয়ে সমাধান করা হয়েছে। সোনাগুলো নাজমুল বিক্রি করে দিয়েছিলেন।  

ফারুক আরও বলেন, নাজমুলের কাছ থেকে সোনার টাকা উদ্ধারের পর সুলতান আবার দুবাইতে চলে যান। দুইমাস পর সুলতান আবার দেশে আসেন। তখন মাত্র ১৫ দিন দেশে ছিল। তিনি বলেন, এরপর আবার (গত বছরের ডিসেম্বর মাস) দুবাইতে যাওয়ার সময় বিমানবন্দর পুলিশ সুলতানকে আটক করে। তখন তার কাছে শুধু পাসপোর্ট আর মোবাইল ছিল। পরে পুলিশ আড়াই কোটি টাকার স্বর্ণের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। 

সুলতান ষড়যন্ত্রের শিকার দাবি করে ফারুক বলেন, দুবাইতে তার একটি ফ্লাটে নেত্রকোনার তিনজন ভাড়া থাকতেন। কয়েকমাসের ভাড়া তারা দিচ্ছিলেন না। পরে সুলতান তাদের ফ্লাট থেকে বের করে দেন। তাদের নাম জানি না। এদের মধ্যে একজনের ভাই সোনা পাচারকারি। তার নাম মুমিন। ওই ব্যক্তি তার ভাইকে ফ্লাট থেকে বের করে দেওয়ায় পরিকল্পনা করে আমার ভাইকে পুলিশ দিয়ে আটক করিয়েছি।

ফারুক জানান- তিনিও দুবাইতে ছিলেন। সুলতান গ্রেপ্তার হওয়ার খবর পেয়ে দেশে আসেন। এখনও তিনি দেশে অবস্থান করছেন।

সুলতান এখন কোথায় আছেন জানতে চাইলে তিনি প্রথমে বলেন, তার ভাই এখনও কারাগারে আছেন। পরে অবশ্য তিনি স্বীকার করেন- সুলতান জামিন পেয়েছেন। 

দক্ষিণভাগ দক্ষিণ ইউপির ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য এনামুল হক সিলেটভিউ-কে বলেন, সুলতান তার ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তবে তার সঙ্গে এনামুলের পরিচয় নেই। সুলতানের ভাই ফারুক মিয়াকে তিনি চেনেন। সুলতান স্বর্ণ পাচারের সঙ্গে জড়িত কিনা তা  তিনি জানেন না। 

এই ইউপি সদস্য আরও বলেন- আমি দীর্ঘদিন এলাকার বাইরে ছিলাম। প্রথমবারের মতো মেম্বার নির্বাচিত হয়েছি। এলাকার সবার সাথে এখনও তেমন পরিচয় হয়নি। 

এসব বিষয়ে পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘সুলতান আমার এলাকার ছেলে। সে তাঁর স্বর্ণ হারিয়েছে বলে আমার কাছে এসে বলেছিল। আমি পুলিশকে বলেছিলাম তদন্ত করে সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে। আমি পুলিশকে বলিনি তাঁকে ওসি বানিয়ে চেয়ারে বসাতে।

মন্ত্রী বলেন- সুলতানের বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালানের অভিযোগ রয়েছে তা তিনি জানতেন না। তাঁকে সুলতান বলেছিলেন- সোনাগুলো বৈধ এবং শুল্ক পরিশোধ করে আনা হয়েছে।


সিলেটভিউ২৪ডটকম / লাভলু / ডালিম