স্বর্ণ উদ্ধারের জন্য থানায় পুলিশের সামনে এক যুবককে মারধর করে আলোচিত-সামলোচিত মৌলভীবাজারের বড়লেখার দুবাইপ্রবাসী সুলতান আহমদ হিরন এখন কোথায়- এ নিয়ে বেশ ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। কারণ- সম্প্রতি স্বর্ণপাচার মামলায় তিনি জেল খেটে জামিনে বেরিয়েছেন। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ নেই। তার বাড়িতে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
তবে স্বজনদের দাবি, সুলতান জেল থেকে বেরিয়ে দুবাই চলে গেছেন। দুবাই পৌঁছে তিনি ফেসবুকে দুটি ছবিও পোস্ট দিয়েছেন।
তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, সুলতান দেশে আত্মগোপেন রয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতেই তিনি ‘দুবাই চলে গেছেন’বলে ফেসবুকে ছবি দিয়ে নাটক করছেন।
দুবাইপ্রবাসী একটি সূত্র জানিয়েছে, সুলতান এখনও দুবাইতে আসেননি। এলে অবশ্য তাকে দেখা যেত। সুলতান দুবাইতে যেখানে থাকেন, সেখানে তারা খোঁজ নিয়ে দেখেছেন। তাদের ধারণা, সুলতান এখনও দেশে রয়েছেন।
সম্প্রতি থানার ভেতর পুলিশের সামনে এক যুবককে দুবাইপ্রবাসী সুলতান আহমদ হিরনের মারধরের একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ঘটনাটি গত বছরের আগস্ট মাসে সাটুরিয়া থানায় ঘটে। এ ঘটনার খবর সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়। সংবাদে সুলতানকে ‘স্বর্ণপাচারকারী চক্রের নেতা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর ঘটনাটি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়।
তবে সাটুরিয়া থানা পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে। দুবাইপ্রবাসী সুলতান আহমদ হিরন সাটুরিয়া থানা পুলিশ পরিদর্শকের (তদন্ত) কক্ষে বসে যুবককে মারধর করেন। এ ঘটনায় ইতোমধ্যে অভিযুক্ত এএসআই তারিক আজিজকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া ওই থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মহব্বত আলীকেও বদলি করা হয়েছে।
সাটুরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকুমার বিশ্বাস বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় মুঠোফোনে সিলেটভিউ-কে বলেন, ঘটনাটা গত বছরের। তখন যে ওসি ছিলেন তিনি বদলি হয়েছেন। এরপর আমি যোগদান করেছি। সুলতানের বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা হয়েছে কিনা তা তিনি জানেন না।
সুলতান আহমদ হিরন বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ দক্ষিণ ইউনিয়নের কাশেমনগর গ্রামের মৃত আমিন আলীর ছেলে। সুলতান স্বর্ণ পাচার মামলায় গত বছরের ডিসেম্বর মাসে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। সম্প্রতি তিনি জামিনে বের হয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে স্বজনদের দাবি, সুলতান ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জেলে গেছেন।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, সুলতান দীর্ঘদিন ধরে স্বর্ণ পাচারের সঙ্গে জড়িত। তিনি প্রায় দুবাই থেকে দেশে আসা ব্যক্তিদের সঙ্গে স্বর্ণ পাঠান। বিনিময়ে তাদের বিমানের টিকিট দেন কিংবা টাকা দেন।
বড়লেখা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়ারদৌস হাসান সিলেটভিউ-কে বলেন, সুলতান আহমদ হিরনের বিরুদ্ধে বড়লেখা থানায় কোনো মামলা নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে যুবককে সুলতান সাটুরিয়া থানায় মারধর করেছেন তার নাম নাজমুল ইসলাম। তার বাড়ি মানিকগঞ্জের সাটুয়ারিয়া থানায়। নাজমুল গত বছরের আগস্টে দুবাই থেকে দেশে আসেন। ওই সময় সুলতান কয়েক ভরি স্বর্ণ নাজমুলের কাছে দেন। বিনিময়ে নাজমুলকে বিমানের টিকিট দিয়েছিলেন সুলতান। কথা ছিলো নাজমুল স্বর্ণগুলো সুলতানের আত্মীয়ের কাছে দেবেন। কিন্তু নামজুল দেশে এসে স্বর্ণগুলো সুলতানের আত্মীয়ের কাছে না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দেন। স্বর্ণ উদ্ধারের জন্য সুলতান কয়েকদিন পর দুবাই থেকে দেশে ফিরে মৌলভীবাজার-১ আসনের এমপি ও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের দারস্থ হন। মন্ত্রী স্বর্ণগুলো বৈধ জেনে আইনীভাবে উদ্ধারের জন্য সাটুরিয়া থানার পুলিশকে বলেন। কয়েকদিন পর পুলিশ নাজমুলের অবস্থান শনাক্ত করে তাকে থানায় আনে। ওইদিন সুলতান সাটুরিয়া থানায় গিয়ে নাজমুলকে পুলিশের সামনে মারধর করেন। পরে পুলিশ স্বর্ণ উদ্ধার করতে না পারলেও নাজমুলের কাছ থেকে প্রায় ১৫ লাখ টাকা উদ্ধার করে সুলতানের কাছে দিয়ে বিষয়টি সমাধান করেছে।
সুলতানের বড়ভাই যুবলীগ নেতা ফারুক মিয়া জানিয়েছেন, বড়লেখা উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন তাদের মন্ত্রীর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, সুলতান তার স্ত্রী ও আমার এক বোনের মেয়ের জন্য সাটুরিয়ার এক যুবকের সঙ্গে বিদেশে থেকে স্বর্ণ পাঠিয়েছিলেন। কথা ছিল, ওই যুবক দেশে স্বর্ণগুলো আমাদের কাছে দেবেন। কিন্তু তিনি দেননি। সোনা তার কাছে রেখে দেন। তারও ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। কিছুদিন পরে সুলতান দেশে এসে আমাদের এলাকার মন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের কাছে গিয়ে সোনা উদ্ধারে সহযোগিতা চান। উপজেলা যুবলীগের সম্পাদক কামাল আমাদের মন্ত্রীর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমিও ছিলাম। পরে মন্ত্রী স্বর্ণগুলো বৈধ জেনে ফোনে সাটুরিয়া থানা পুলিশকে আমাদের আইনী সহযোগিতা করতে বলেন। পুলিশ স্বর্ণগুলো উদ্ধার করতে না পারলেও ওই যুবকের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা উদ্ধার করে দিয়ে বিষয়টি সমাধান করেছে। ফারুকের দাবি, তার ভাই সুলতান স্বর্ণপাচারের কাজে জড়িত নয়। তাকে পরিকল্পিতভাবে স্বর্ণ পাচারকারী বানিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছে। সম্প্রতি সে জেল থেকে বেরিয়েছে। তবে সে এখন দুবাইতে আছে।
কাশেমনগর এলাকার স্থানীয় লোকজন জানান, সুলতান দীর্ঘদিন ধরে দুবাইতে আছেন। তবে সুলতান সোনা বেচাকেনা করে বলে তারা জানেন। কিন্তু সোনা পাচারকাজে জড়িত কি-না তা তারা জানেন না। অবশ্য তারা শুনেছেন সুলতান কয়েকমাস আগে সোনা পাচারের মামলায় ঢাকা বিমানবন্দর পুলিশের হাতে আটক হয়েছিলেন। কয়েকদিন আগে তিনি জামিন পেয়েছেন।
পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন সম্প্রতি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সুলতান তার এলাকার ছেলে। সুলতান তার স্বর্ণ হারিয়েছে বলে তার কাছে এসে জানিয়েছিল। সোনাগুলো বৈধ এবং শুল্ক পরিশোধ করে আনা হয়েছে বলেও জানিয়েছিল। স্বর্ণগুলো বৈধ দেখে তখন তিনি পুলিশকে আইনীভাবে বিষয়টি দেখতে বলেছিলেন। তবে সুলতানের বিরুদ্ধে যে স্বর্ণ চোরাচালানের অভিযোগ রয়েছে তা তিনি জানতেন না বলে জানান।
সিলেটভিউ২৪ডটকম / লাভলু / ডি.আর