মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে চা শিল্প ও বস্তি এলাকার বেকার নারী শ্রমিকরা বৈষম্যমূলক মজুরিতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। মে দিবসকে কেন্দ্র করে শ্রমিকদের ৮ ঘন্টা কাজ, ৮ ঘন্টা বিনোদন আর ৮ ঘন্টা বিশ্রামের অধিকার থাকলেও জীবন আর জীবিকার তাগিদে নারী-পুরুষ ও বেকার শ্রমিকরা মে দিবসে অর্জিত অধিকার থেকে বঞ্চিত। মজুরিতে বৈষম্য রোধ করার দাবি জানিয়েছেন এসব নারী শ্রমিকরা।
 

চা শ্রমিকের জীবনটাও ছেঁটে দেয়া চা গাছের মতোই, লেবার লাইনের ২২২ বর্গফুটের একটা কুঁড়ে ঘরে বন্দি। মধ্যযুগের ভ‚মিদাসের মতোই চা মালিকের বাগানের সঙ্গে বাধা তার নিয়তি। চা শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম একটি বৃহৎ শিল্প। জাতীয় অর্থনীতিতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপ‚র্ণ ভ‚মিকা পালন করে আসছে।
 


চা বাগানের শ্রমিকরা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। প্রায় ২শ’ বছর ধরে উপজেলার ১৯টি চা বাগানে বংশ পরম্পরায় কাজ করছেন এসব চা শ্রমিকরা। তাদের শ্রমে এই শিল্পের উন্নয়ন হলেও শ্রমিকদের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না আজও।

নারী শ্রমিকরা জানান, ঘুম থেকে উঠেই নাস্তা সেরে কাজে বের হন আর সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে রান্নাবান্না করেন। চা বাগানের বেকার নারীদের প্রতিদিনের চিত্র। এভাবেই চলছে তাদের জীবন সংগ্রাম। বস্তির অতি দরিদ্র ও চা শিল্পে শ্রমজীবীদের একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে বেকার। এদর মধ্যে যুবতী ও মধ্য বয়সী নারী শ্রমিকরা রয়েছেন। জীবিকার তাগিদে শিল্পের বাইরে কনস্ট্রাকশন, মাটি কাটা, মাথায় টুকরি নিয়ে ইট, বালু, পাথর বহন করার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। তবে কঠিন কাজে নিয়োজিত থাকলেও মজুরি বৈষম্য দীর্ঘদিনের! পুরুষদের সমান কাজে নিয়োজিত থাকলেও সমান মজুরি পাচ্ছেন না। মে দিবসের চেতনায় মজুরি বৈষম্যের দাবি জানান এসব নারী শ্রমিকরা। মৌলিক চাহিদা পূরণে দীর্ঘদিন ধরে মজুরি বৃদ্ধি, ভূমি অধিকার, বাসস্থান ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বিভিন্ন দাবি তাদের।

চা বাগানে কর্মরত নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা বর্তমানে দৈনিক ১৭০ টাকা মজুরিতে কাজ করছেন। এর বাইরে বিপুল সংখ্যক বেকার নারী শ্রমিকরা বস্তি কিংবা শহরের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনে, মাটি কাটা, নার্সারী, কৃষি সহ সকল ক্ষেত্রে কাজ করে সংসারের চাহিদা পূরণ করছেন। স্বল্প মজুরি আর বেকারত্বের কঠিন জীবন সংগ্রাম থেকে স্বস্তি পেতে তারা এসব পথ বেঁচে নিয়েছেন। পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে চেহারায় হাড্ডিসার দশা। জীবিকার তাগিদে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কঠিন কাজ করেন। রোদ, বৃষ্টিতে ভিজে, পোকা-মাকড়ের আক্রমনের মধ্যেই চলে তাদের কাজ। এরপর মজুরি! সেটিও পাঁচ সাত সদস্যের পরিবারে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

বস্তির নারী শ্রমিক পারভীন বেগম, শেফালি কর বলেন, পেটের দায়ে যখন যে কাজ পাই সেটা করতে বাধ্য হই। তারপরও দেড়শ কিংবা দুইশ টাকা রোজ দেয়া হয়। এটি দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। আর পুরুষরা কাজ করলেই চার থেকে পাচঁশত টাকা পান। পুরুষদের চেয়ে কাজ কম করি না। তবে পারিশ্রমিক কম পাই।
 

তারা আরও জানান,  প্রতি বছর চা বাগানের অনেক মানুষ নিয়ে মে দিবস পালন করে দুঃখ-দুর্দশা সবার কাছে তুলে ধরা হলেও এই আন্দোলন কে শুনবে, কি হবে আর মে দিবস পালন করে।

শমশেরনগর চা বাগানের মনি গোয়ালা, লছমী রাজভর, আলীনগর চা বাগানের রেবতি রিকিয়াশনসহ নারী শ্রমিকরাও জানান, চা বাগানের নারীদের কাছ থেকে সস্তায় শ্রম পাওয়া যায়ে। বাগানে সারাদিন পরিশ্রম করে মজুরি ১৭০ টাকা, আর শহর-বস্তিতে কাজ করলে সর্ব্বোচ্চ আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ টাকা দেয়া হয়। অথচ পুরুষ শ্রমিকদের বেলায় তিন থেকে পাঁচশ’ টাকা মজুরি। এই বৈষম্য কোন মতেই কাম্য নয়।

মৌলভীবাজার চা শ্রমিক সংঘের নেতা হরি রিকিয়াশন ও কানিহাটি চা বাগানের শ্রমিক নেতা সীতারাম বীন বলেন, চা বাগানে কর্মরত আর বেকার শ্রমিকরা বাগানের বাইরে কর্মরত। তারা কঠিন কাজ ও পরিশ্রম করলেও ন্যায্য মজুরি বঞ্চিত। তার উপরে রয়েছে মজুরি বৈষম্য। তাই মে দিবসের চেতনা বাস্তবায়নের মধ্যদিয়েই নারী পুরুষ শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও মজুরি বৈষম্য রোধ হওয়া উচিত বলে তারা দাবি করেন।
 

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রাম ভজন কৈরী জানান, চা শ্রমিকরা সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এ দেশে বাস করছে। তারা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযোদ্ধে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল। সেই চা শ্রমিকরা আজও অবহেলিত। বর্তমান শ্রমিক বান্ধব সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দাবি জানাচ্ছি- এই অবহেলিত চা শ্রমিকদের বাসস্থানের জায়গাটুকু যাতে তাদের নিজের নামে করে দেয়া হয়। যাতে বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে না পারে।


 


সিলেটভিউ২৪ডটকম/জয়নাল/এসডি-১৬