ফাইল ছবি

হঠাৎ করেই যেন অবনতি ঘটেছে হবিগঞ্জ জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। এতগুলো খুনের ঘটনায় জেলাজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। যদিও এরই মধ্যে গ্রাম্য এসব দাঙ্গা থামাতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ইতোমধ্যে জেলার বানিয়াচং, লাখাই, হবিগঞ্জ সদর উপজেলাসহ বেশকিছু এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে সহস্রাধিক দেশীয় অস্ত্র।

 


এপ্রিল মাসজুড়ে হবিগঞ্জ জেলায় খুন, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সহিংসতা, পারিবারিক টানাপড়েনে প্রাণ গেছে একই পরিবারের তিনজনসহ অন্তত ১৯ জনের। যার মধ্যে গ্রাম্য দাঙ্গায় খুন হয়েছেন বেশ কয়েকজন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৪ শতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশু। শুধু তাই নয়, গ্রাম্য দাঙ্গায় প্রাণহানির পাশাপাশি প্রায় শতাধিক ঘরবাড়ি ভাঙচুর-লুটপাটের কারণে ক্ষতি হয়েছে কয়েক কোটি টাকার।

 

ঘটনার শুরু গত ২৩ মার্চ দুপুরে চুনারুঘাট উপজেলার গাদিশাইল গ্রামে স্ত্রী ও প্রতিবন্ধী সন্তানকে হত্যার পর গাছে ঝুলে আত্মহত্যা করেন সজ্জুল হক (৪৫) নামে এক ব্যক্তি। তার বাড়ির ভেতর থেকে স্ত্রী জেসমিন আক্তার (৩৫) ও তাদের বড় ছেলে প্রতিবন্ধী ইয়াছিন মিয়ার (১০) মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করে, সজ্জুল মিয়া খুবই দরিদ্র। তিনি সংসার চালাতে পারছিলেন না। এ জন্য স্ত্রী ও ছেলে ইয়াছিনকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেন।

 

গত ২৫ মার্চ বানিয়াচং উপজেলার ইকরাম গ্রামে পাওনা টাকা না দেয়ার জেরে বিষ্ণু সরকার (২২) নামে এক যুবককে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে খুন করা হয়। এ ঘটনায় মিন্নত আলীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়।

 

গত ২৭ মার্চ সকালে চুনারুঘাট উপজেলার ডিসিপি হাই স্কুল মাঠের জঙ্গলে শিশু স্বপন মিয়াকে গলাকেটে হত্যার চেষ্টা করে শান্ত নামে এক যুবক। গলাকাটা অবস্থায় শিশু স্বপন মিয়া (১০) সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে মারা যায়। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২ এপ্রিল রাতে সে মারা যায়।

 

গত ৮ এপ্রিল শনিবার জেলার বানিয়াচং উপজেলার কুশিয়ারতলা গ্রামে দুইপক্ষের সংঘর্ষে টেঁটাবিদ্ধ হয়ে জাহাঙ্গীর (৩৫) নামে এক যুবক খুন হন। এ সময় চার পুলিশসহ আরো অন্তত শতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশু আহত হন। নিহত জাহাঙ্গীর আলম কুশিয়ারতলা গ্রামের ধলাই মিয়ার ছেলে। এই সংঘর্ষে গুরুতর আহত ইছাক মিয়া (৫৫) ১১ এপ্রিল সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

 

গত ৯ এপ্রিল আজমিরীগঞ্জ উপজেলার নোয়াগড় গ্রামে জমিতে গরু ঢুকে যাওয়ার জেরে কথা কাটাকাটি থেকে দুইদল লোকের সংঘর্ষ বেঁধে যায়। এতে ফয়েজ মিয়া (২০) নামে এক মাদ্রাসাছাত্র গুরুতর আহত হন। ৯ এপ্রিল সিলেট এমএজি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ সংঘর্ষে কমপক্ষে ২০ জন আহত হন।

 

বানিয়াচং উপজেলার মশাকলি গ্রামে গত ১৩ এপ্রিল জমি নিয়ে বিরোধের জেরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে জোড়াখুনের ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- মশাকলি গ্রামের দশর দাশের ছেলে সুব্রত দাস (৩০) ও একই গ্রামের সুনীল দাসের ছেলে সুজিত দাস (৩৫)।

 

১৪ এপ্রিল শুক্রবার সকালে লাখাই উপজেলার মকসুদপুর গ্রামে ধান কাটা নিয়ে বিরোধের জেরে হওয়া সংঘর্ষে ফিকল বিদ্ধ হয়ে আব্দুল জলিল (৬৫) নামে এক কৃষক খুন হন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। সন্ধ্যায় বানিয়াচং উপজেলার খাগাউড়া গ্রামে ভাতিজার দায়ের কোপে মোশারফ হোসেন (৪০) নামে এক ব্যক্তি খুন হন।

 

১৮ এপ্রিল লাখাই উপজেলার কাটাইয়া গ্রামের স্বামী খলিলুর রহমানের হাতে স্ত্রী রুহেনা খাতুন (৪৫) খুন হন।

 

গত ২২ এপ্রিল ঈদের দিন সকালে মাধবপুর উপজেলার রসুলপুর গ্রামে উচ্চ শব্দে গান বাজানোকে কন্দ্রে করে ষাটোর্ধ্ব ইরফান আলী নামে এক মোয়াজ্জনিকে পিটিয়ে খুন করা হয়।

 

গত ২৪ এপ্রিল মাধবপুর উপজেলার বহরা ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামে ছেলের মার্বেল খেলা নিয়ে বিরোধের জেরে খুন হয়েছেন মা মিনারা খাতুন (৪৭)। এতে আহত হয়েছেন আরও তিনজন।

 

গত ২৬ এপ্রিল বুধবার দুপুরে লাখাই উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামে পূর্ববিরোধের জেরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে জহিরুল ইসলাম (২৮) নামে এক যুবক খুন হন ও উভয়পক্ষের প্রায় অর্ধশত লোকজন আহত হয়েছেন। নিহত জহিরুল ইসলাম লক্ষ্মীপুর গ্রামের আবু সালেহের ছেলে।

 

গত ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জ সদর উপজলোর পশ্চিম ভাদৈ গ্রাম থেকে মানিক মিয়া (৫০) নামে এক কাঠ ব্যবসায়ীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মানিক মিয়া বাহুবল উপজেলার মিরপুর হরিপাশা গ্রামের মৃত আব্দুস সোবহানের ছেলে। তাকে হত্যার পর লাশ ফেলে রাখা হয়েছে বলে দাবি নিহতের পরিবারের। পুলিশও বলছে, এটি একটি হত্যাকাণ্ড।

 

সর্বশেষ রবিবার ৩০ এপ্রিল মাধবপুর উপজেলার ইটাখোলা গ্রামে মানসিক ভারসাম্যহীন বাবা আবু জাহের মিয়ার লাঠির আঘাতে ছেলে রায়হান (১২) মৃত্যু হয়েছে।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. সাবের আহমেদ চৌধুরী বলেন, এসব ঘটনার মূল কারণ হচ্ছে গ্রাম্য বিচারব্যবস্থা একেবারেই দুর্বল হয়ে পড়েছে। আগে যারা গ্রাম্য শালিস বৈঠক করতেন, তারা অত্যন্ত স্বচ্ছ মানুষ ছিলেন। খুব শক্ত হাতে শালিস-বিচার করতেন এবং তাদের রায়গুলো উভয় পক্ষ মেনে নিতেন। রায়ের প্রতি পক্ষদ্বয় যথেষ্ট সম্মান দেখাতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে গ্রাম্য শালিস বিচারগুলো পক্ষদ্বয় মেনে নিচ্ছেন না। এর পেছনেও অধিকাংশ শালিসকারী টাউট-বাটপার রকমের লোক। তাদের সামান্য কিছু টাকা দিলেই কেনা যায়। আর স্থানীয় রাজনীতি বা দলীয় রাজনীতির প্রভাবও রয়েছে এর পেছনে।

 

হবিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শৈলেন চাকমা বলেন, দাঙ্গার বিরুদ্ধে পুলিশ কঠোর অবস্থান নেওয়ার পাশাপাশি সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে দাঙ্গার বিরুদ্ধে সিনেমাও তৈরি করা হয়েছে। হাওর এলাকায় ধান কাটার মৌসুমে এসব ঘটনা বেশি ঘটে। এ সময় পুলিশি তৎপরতা বাড়ানোর পরও লোকজনকে থামানো যাচ্ছে না। পুলিশ এ ব্যাপারে আন্তরিকভাবে কাজ করছে।


সিলেটভিউ২৪ডটকম/ডেস্ক/ইআ-১০