‘আমরা চেয়েছিলাম এমসি কলেজের প্রতিটি ডিপার্টমেন্টকে এক জায়গায় মিলিত করতে। যেখানে সকল ছাত্রছাত্রী গানে সুর তুলবে প্রাণ খুলে। কবিতায় বলবে কথা। নাচ-অভিনয় জুড়ে দেখাবে উজ্জ্বল প্রতিভা। আর তাই নদী যেমন এপথ-ওপথ ঘুরে মিলিত হয় মোহনায়। আমরাও তাই নাম দিই মোহনা।’
 

কথাগুলি বলছিলেন মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ, সিলেটের সবচেয়ে পুরাতন মোহনা সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ও সাবেক সভাপতি আসাদুজ্জামান পাটোয়ারী সুজন।


তিনি আরও বলেন, ‘এমসি কলেজের আঙিনায় এর আগেও অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল তবে স্থায়ী হয়নি। মোহনা গঠন করতে গিয়ে আমরা আলাদা আলাদা বিভাগের পনেরো জন শিক্ষার্থী একত্রিত হই এবং প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হই। আমরা মূলত শিক্ষার্থীদের মাঝে এমনই সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন করতে চেয়েছিলাম। আরেকটি কথা না বললেই নয় যে, শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সংস্কৃতিবান শিক্ষকদের সহযোগিতার ফলে মোহনা এমন দুর্বার পথচলতে পেরেছে।’
 

কিছু স্বপ্নবাজ তরুণদের হাত ধরে তৈরি হওয়া মোহনা সাংস্কৃতিক সংগঠন কাগজ-কলমে হলেও ‘মোহনা’ নামেই সবার কাছে বহুলপরিচিত সংগঠনটি। প্রত্যেক বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্রাণবন্ত বিচরণের অনন্য প্লাটফর্ম মোহনা। ২০০৭ সালে একঝাঁক তরুণ, স্বপ্নবাজ, সৃজনশীল ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের হাত ধরে যে যাত্রা শুরু হয় এমসি কলেজের আঙিনায়, তারপর একে-একে কেটে গেছে সতেরোটি বসন্ত। আসছে পহেলা বৈশাখে মোহনা পা রাখতে চলেছে পথচলার দুর্বার আঠারোতম বছরে। সুস্থ ধারার বাঙালি সংস্কৃতি তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে মোহনার ব্যস্ততম কার্যক্রম চলছেই।

২০০৭ সালে দেশের রাজনৈতিক বৈরিপরিবেশে যখন সংস্কৃতি চর্চা করা কঠিন হয়ে উঠে তখন এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ মঞ্চে যাত্রা শুরু করে ‘মোহনা সাংস্কৃতিক সংগঠন’। বর্তমানে এর দায়িত্ব পালন করছে রাফি-জুবায়ের নেতৃত্বাধীন ষোড়শ কার্যনির্বাহী পরিষদ। মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক মোহনা সাংস্কৃতিক সংগঠন দেশের প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ এমসি কলেজের প্রাচীনতম সংগঠন। বছরজুড়ে নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটকসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কার্যক্রম আয়োজন করে সংগঠনটি। সিলেটে সবচেয়ে বড় আয়োজনে বসন্ত উৎসব, লোকসংস্কৃতি অনুষ্ঠান, সবুজায়ন বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, বর্ষাবরণ, শরৎ একদিন ভবঘুরে, রক্তদান কর্মসূচি, শীতবস্ত্র বিতরণ, খাদ্য সামগ্রী বিতরণ, চিকিৎসাসেবা প্রদান এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
 

প্রতিবছর মোহনা তার নতুন কার্যকরী পরিষদ ‘বৈশাখী’ মুখপত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকে। গল্প কবিতার সাথে প্রকাশিত হয় বার্ষিক মুখপত্র ‘বৈশাখী’। বিগত বছরের পুরো কার্যক্রমের বিস্তর চিত্রসহ নতুন কার্যকরী পরিষদ ও নবীন-প্রবীণ লেখকের লেখা দিয়ে সাজানো হয় মুখপত্রটি। পুরো মুরারিচাঁদ কলেজ ক্যাম্পাসকে সংস্কৃতির ছোঁয়ায় মাতিয়ে রাখতে মোহনা বদ্ধপরিকর। তাই তো সংগঠনটির একদল শৈল্পিক কর্মী প্রতিবছর একাধিকবার পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে আলপনা করে। ১২৪ একরের চিরসবুজ এমসি আঙ্গিনার সৌন্দর্য তাতে বেড়ে যায় কয়েকগুণ। সবসময় শিক্ষার্থী ও সিলেটের সংস্কৃতি প্রেমী মানুষের নজরকাড়ে মঞ্চস্থ যে কোনো আয়োজন। বিশেষ করে সিলেটের বুকে বর্ণাঢ্য আয়োজনে করা বর্ণিল সাজে সজ্জিত ‘মোহনা বসন্ত উৎসব’।

মোহনা’র ঝুলিতে আছে জাতীয় পর্যায়ে স্বর্ণপদক অর্জনসহ একাধিকবার বিভিন্ন অঙ্গনে সেরা হওয়ার কৃতিত্ব। ২০২১ সালে ‘মোহনা’ জয় বাংলা ইয়ূথ এওয়ার্ড-২০২১ এ দেশসেরা ৩১ সংগঠনে জায়গা করে নেয়। যোগ্যতা, দক্ষতা আর নেতৃত্বে নতুনদের গড়ে তুলতে সারাবছর নিরলস সৃজনশীল পরিশ্রমের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করে সংগঠনটি।

মোহনা’র সাধারণ সম্পাদক জুবায়ের আহমেদ রাকিব জানান, ‘সাংস্কৃতিক সংগঠনকে বলা হয় ক্যাম্পাসের প্রাণ। যেখানে সাংস্কৃতিক সংগঠন যত বেশি সুসংগঠিত সেখানে ক্যাম্পাস ততোই বেশি প্রাণবন্ত। আর মোহনা সবসময় ক্যাম্পাসকে প্রাণবন্ত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

মোহনা’র সভাপতি শাহ রাকিবুল হাসান রাফি জানান, ‘মোহনা তরুণ প্রজন্মের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর কাছে প্রায় দেড়যুগ ধরে সুস্থধারার সংস্কৃতি পৌঁছে দেয়ার কাজ করে চলেছে এমসি কলেজে তথা সিলেটের বুকে। স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট নাগরিক গঠনে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি নানান সামাজিক কর্মকাণ্ডেও আসছে দিনে আরও বেশি অংশগ্রহণ করবে মোহনা।’
 

মোহনা’র প্রতিষ্ঠাকালীন উপদেষ্টা ও মুরারিচাঁদ কলেজ, সিলেট এর বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর আবুল আনাম মো. রিয়াজ জানান, ‘মোহনা সাংস্কৃতিক সংগঠন, মুরারিচাঁদ কলেজের সবচেয়ে পাইওনিয়ার সাংস্কৃতিক সংগঠন। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতি চর্চায় ব্যতিক্রম করেনি। শিক্ষার পাশাপাশি দেশজ সংস্কৃতি লালন ও প্রসারে কলেজে এক অনন্য অবস্থান তৈরি করেছে। নববর্ষ আবাহন, বসন্ত উৎসব পালনসহ জাতীয় দিবস পালনে তাদের রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা। এই সংগঠনের অনেক শিক্ষার্থী একই সাথে রোভার স্কাউটস, বিএনসিসি ও অন্যান্য সহপাঠ্যক্রম নির্ভর সংগঠনেও সমান কার্যকর। শুরুর দিকে এই সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যাপক হিসেবে তাদের খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে, দেখেছি এরা দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে কত আন্তরিক। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো তাদের সাথে সমান তালে অনেক সংগঠন গড়ে উঠেছে যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো থিয়েটার মুরারিচাঁদ, কবিতা পরিষদ, এমসিডিএস, এসব সংগঠনে যে সকল শিক্ষার্থী জড়িত এরা ভালো ফলাফলের পাশাপাশি শিক্ষা জীবন শেষে চাকরি প্রাপ্তিসহ সুন্দর জীবন গড়তে পারছে। তাই মুরারিচাঁদ কলেজের শিক্ষার্থীরা আরও বেশি সংখ্যায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হোক আশাবাদ ব্যক্ত করছি।’


 

লেখক- ইমরান ইমন, সভাপতি, এমসি কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি

 


সিলেটভিউ২৪ডটকম/প্রেবি/এসডি-১৬৪৬