বাংলাদেশ তথা সিলেটের অনেক ইউরোপ যাওয়ার ক্ষেত্রে মাধ্যম-দেশ হিসেবে বেছে নেন তুরস্ককে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে সে দেশে গিয়ে বন্দী হয়ে পড়ে অনেক বাংলাদেশির ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্ন। এদের মধ্যে অনেক সিলেটিও আছেন। অনেকের ঠাই জেলখানায় পর্যন্তও হয়।


মুন্সীগঞ্জের এক যুবক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘ইনফোমাইগ্রেন্টস’র কাছে তুলে ধরেছেন চমকে উঠার মতো অনেক তথ্য।
 


মুন্সীগঞ্জের এক কৃষক পরিবারে জন্ম আসাদের। কোনো সনদ না থাকলেও কিছুটা পড়াশোনা ছিলো তার ঝুলিতে। পরিবারে স্বচ্ছ্বলতা ফেরাতে বিদেশমুখী হওয়ার সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন ২০১৮ সালে। ওই বছরের মাঝামাঝি সময়ে শ্রমিক হিসেবে নিয়মিত পথে ইরাকে যান আসাদ। সে দেশের রাজধানী বাগদাদে একটি চাকরিও পেয়ে যা। আয় যা হচ্ছিল, তাতে খুশিই ছিলেন তিনি। ভালোই চলছিল সবকিছু। কিন্তু ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে সবকিছু পাল্টে যেতে থাকে। ওইদিন ইরাকের বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় নিহত হন ইরানের সাবেক মেজর জেনারেল কাশেম সুলেইমানি।


ওইসময় সংঘর্ষ শুরু হয়। বিভিন্ন স্থানে চলতে থাকে সহিংসতা, বোমা হামলা। পুরো এলাকা রূপ নেয় আতঙ্কে। আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম আসাদও। দিন দিন পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। প্রাণ ভয়ে বাগদাদ ছেড়ে কুর্দিস্তানে চলে যান আসাদ। সেখানে পৌঁছাতেই দেখা হয় তার এক আত্মীয়ের সঙ্গে। পরে দেখা মেলে তারই পাশের গ্রামের নাঈম নামের যুবকের সঙ্গে।

 

সবাই মিলে ঠিক করলেন ইরাকে আর থাকা যাবে না। সিদ্ধান্ত নেন- চলে যাবেন তুরস্কে। সেখান থেকে সুযোগ করে ইউরোপে।  

সীমান্ত দিয়ে পায়ে হেঁটে অনিয়মিত পথ ধরেই আরো অনেকের সঙ্গে তুরস্কে প্রবেশ করেন আসাদসহ তারা তিনজন। আসাদ বলেণ বলেন, ‘‘ইরাকের কুর্দিস্তান দিয়ে তুরস্কে ঢুকি আমরা।’’

 

তুরস্কে পৌঁছে দেশটির সীমান্তবর্তী এলাকায় কয়েকদিন ছিলেন তারা। আসাদ বলেন, ‘‘যে এজেন্টের মাধ্যমে এসেছিলাম আমরা, সেখানে ওই এজেন্টের বাসা ছিল। সেখানেই রাখছিল আমাদের। এক সপ্তাহের মতো ছিলাম। তারপর বাসের টিকিট করে দিছে।  তারপর ইস্তাম্বুলে চলে আসি। ’’

 

ইরাক থেকে তুরস্ক পা রেখে সাহসটা যেন আরো বেড়ে গেল আসাদসহ দলের আরো কয়েকজনের। এর মধ্যে মধ্যস্বত্বভোগীর খোঁজখবরও নিয়ে নিলেন তারা। ঠিক করলেন, তুরস্কে কাজকর্ম না খোঁজে চলে যেতে হবে গ্রিসে। কারণ, তারা মনে করতেন ইউরোপে পৌঁছালেই বদলে যাবে জীবন।

 

আসাদ বলেন, ইস্তাম্বুলে আসার পর এক দালালকে টাকা দিছিলাম গ্রিসে যাওয়ার জন্য। গ্রিসে গেইম মারলাম বেশ কয়েকটা। যখনই গ্রিসে যাচ্ছি, ওখানকার সীমান্তরক্ষীরা আবারো তুর্কিতে ডিপোর্ট করে দিত।


কয়েকবারের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় হতাশ হলেন কিছুটা। কিন্তু হাল ছাড়তে রাজি না আসাদ৷ তাই খুঁজে বার করলেন অন্য মধ্যস্বত্বভোগীকে।


আসাদ বলেন, ‘‘অন্য দালাল বললো- আমার কাছে ভালো গেইম আছে। এলাকার পরিচয়-টরিচয় পেয়ে, ফুসলিয়ে, নানা কিছু বুঝিয়ে আমাকে রাজি করালো। ওই দালালের মাধ্যমে আবার গেইম মারলাম। শেষে জানতে পারলাম, দালাল লোকটা ভালো ছিল না। ওই দালালের কাছে যখন টাকা জমা করি, দালাল একটা গেইমে পাঠায়। আধা রাস্তার মধ্যে পুলিশ আমাদের ধরে। মানে সীমান্তেই যেতেই পারিনি। ইস্তাম্বুল ছেড়ে আসতেই একটি চেক পয়েন্টে পুলিশ আমাদের ধরে ফেলে। ধরার পর একটি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্প থেকে নেয়া হয় ভান শহরে, যা ইরান সীমান্তের কাছাকাছি।  ওইখানে প্রায় পাঁচ মাসের মতো রাখা হয় আমাদের৷।’


ভান শহরের যে জায়গায় আসাদ ছিলেন, তার দেওয়া বর্ণনায় সেটা ছিল মূলত বন্দিশিবির। কাঁপা কাঁপা গলায় সেই বন্দিদশার বর্ণনা করতে গিয়ে আসাদ বলেন, ‘‘ওটা ক্যাম্প না। ওটা আসলে মরণ ফাঁদ। জেলখানা, রুমে রুমে বন্দি। নড়তে চড়তে দিত না। খাবার দাবারের অবস্থা খুবই বাজে।  কিছু বললেই মারধর করা হয়।’’

খাদ্য সংকট, শারিরীক নির্যাতন, নিপীড়ন যেমন ছিলো, তেমনি আতঙ্কেও থাকতে হতো তাদের। কারণ- ওই বন্দিশিবির থেকে অনেক লোককে নিয়ে রাতের আঁধারে ইরান সীমান্তে ছেড়ে দেওয়া হতো বলে দাবি করেন আসাদ।

 

আসাদ বলেন, সাদা কাগজে টিপসই নিয়ে জোর করে ইরানে ঢুকিয়ে দেয়া হতো। ইরানে যাদের পাঠানো হতো তাদের সবাইকে মাফিয়ারা ধরতো। মাফিয়া ধরে আঙ্গুল কেটে দিতো। কান কেটে নিতো। হাত কেটে দিতো। বিশাল অঙ্কের টাকা দাবি করতো। তিন লাখ, চার লাখ করে টাকা দাবি করতো। টাকা না দিলেই শারীরিক নির্যাতন।


টানা পাঁচমাস ওই ক্যাম্পে রাখার পর সেই শিবিরের অনেক অভিবাসনপ্রত্যাশীকে নিয়ে যাওয়া হয় ইরান সীমান্তবর্তী আরেকটি ক্যাম্পে। ওই এলাকার সম্পর্কে খুব একটা ধারণা ছিলো আসাদের।

 

তিনি জানালেন, ‘‘সেই ক্যাম্পের ভেতর প্রচুর বাংলাদেশি আছেন। কিন্তু নেই কোনো খাবার দাবার। নেই গোসলের কোনো জায়গা। সেখানে আড়াই মাস যাওয়ার পর নাঈম (কুর্দিস্তান থেকে আসাদের সহযাত্রী) অসুস্থ হয়ে পড়ে। খাবার না পেয়ে, দুশ্চিন্তা থেকে অসুস্থ হয়ে যায় সে।’’

একপর্যায়ে যে মধ্যস্বত্বভোগীর কথা শুনে গ্রিস যাওয়ার পথে ধরা খেলেন পুলিশের কাছে, তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন আসাদ। উদ্দেশ্য ছিল, তার কাছে দেয়া অর্থ আদায় করা।


আসাদ বলেন, ‘‘সে (মধ্যস্বত্বভোগী) আমাদের ফোন ধরতো না। দালাল ফোন ধরলে, তার কাছ থেকে টাকা আদায় করতে পারলে খেয়ে-বেঁচে থাকতে পারতাম।’’

 

ওই ক্যাম্পে অনেকে আট মাস, অনেকে নয় মাস, কেউ দেড় বছর ধরে আটকা পড়ে আছেন বলেও জানান আসাদ। সেই ক্যাম্পের বর্ণনা দিতে গিয়ে আসাদ বলেন, ‘‘শুকনো রুটি দেওয়া হতো। এমন শুকনো যে এগুলো দিয়ে কাউকে আঘাত করলে মানুষের মাথা ফেটে যেতে পারে। আরেক এক পদের ম্যাগী নুডুলসের মতো নুডুলস দিতো। শুধু গরম পানি দিয়ে সেদ্ধ করে দিতো। এর মধ্যে আর কিছুই থাকতো না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খাওয়ার জন্য এক লিটার পানি দিতো।’’

 

এদিকে, আসাদের সঙ্গী নাঈমের শরীরের আরো অবনতি হতে থাকে। কিন্তু ওই ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছিল না। অসহায়বোধ করছিলেন আসাদসহ অন্য বাংলাদেশিরা।


তিনি বলেন, ৪৮ ঘণ্টার পর তাকে (নাঈম) হাসপাতালে নেওয়া হয়। আমরা চেঁচামেচি করার পর তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে জানতে পারলাম সে ব্রেইন স্ট্রোক করেছে।


নাঈমের অসুস্থতার পর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে বন্দিদশা থেকে মুক্তির পথ পান আসাদ।

 

আসাদ বলেন, কোনো কথাবার্তা ছাড়া নাঈমকে হাসপাতালে ভর্তির দুই দিন পর আমাকে বের করা হলো। বলা হলো- তুই চলে যা। আমাকে হাসপাতালের গেটে নামিয়ে দিয়ে গেলো। দেখলাম নাঈমেরও একই অবস্থা। সেই হাসপাতালে নাঈমের পাশে ছিলাম দেড় মাস।’’

 

অচেনা শহরের ওই হাসপাতালে নাঈমের চিকিৎসা চলে প্রায় আড়াইমাস ধরে। তার সঙ্গে মাস দেড়েক ছিলেন আসাদ। বলেন, একপর্যায়ে আমিও অসুস্থ হয়ে যাই। তাই আমি চলে আসি। আড়াইমাস পর মারা যায় নাঈম। পরে তার লাশ দেশে পাঠানো সম্ভব হয়েছে।’’


হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন আসাদ। তার পরামর্শ শুনেই চলে আসেন ফের তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে। তারপর থেকে সেখানেই আছেন।

 

তিনি বলেন, ‘‘ইস্তাম্বুলে আসার পর প্রায় দেড় মাস পাগলের মতো ছিলাম। বন্ধুর রুমে থাকতাম। বন্ধুর কাছেই আছি৷ সব খরচ সে বহন করছে। নিজের কাছে আর কোনো সঞ্চিত অর্থ নেই।

 

এদিকে, বাংলাদেশে আসাদের পরিবারে আছেন স্ত্রী ও এক সন্তান। সন্তান পড়াশোনা করছেন। আর আছেন বৃদ্ধ বাবা-মা। স্ত্রী-সন্তানের দেখাশোনাটা এখনই তার বাবাই করছেন। বিদেশে থেকেও পরিবারের জন্য কোনো অর্থের যোগান দিতে পারছেন না ৪০ বছর বয়সি এই মানুষটি।

 

আসাদ বলেন, এখনো কোনো কাজ করছি না। পুলিশের ভয়ে বাসা থেকে বের হই না। এভাবেই কী তবে জীবন কাটবে?—এমন প্রশ্ন করে  কেঁপে উঠে তার গলা।


আসাদ বলেন, ‘‘এখন যদি পরিস্থিতি অনুকূলে আসে, তাহলে কাজকর্ম করবো। এছাড়া তো আর কোনো পথ নেই। লোকমুখে শুনছি, কিছু সুযোগ সুবিধা হয়তো দেবে এ দেশের সরকার। কিন্তু ক্লিয়ার না।’’


ঘর ছেড়ে বের হতে না পারার কারণ ব্যাখ্যায় আসাদ বলেন, ‘‘পুলিশ যদি ধরতে পারে তবে আবারো বন্দিখানায় নিয়ে যাবে৷’’


আসাদ বলেন- আমার মতোই অনেক বাংলাদেশির ইউরোপের স্বপ্ন তুরস্কবন্দী।


সিলেটভিউ২৪ডটকম / ডি.আর/ নোমান