বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে নতুন বই তুলে দেওয়ার এক যুগের রীতিতে এবার ছেদ পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে দরপত্র ও কার্যাদেশে বিলম্বের কারণে।

পাঠ্যবই মুদ্রণের সঙ্গে জড়িতরা এজন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড- এনসিটিবিকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে হলে ছাপানোর জন্য যে সময় দরকার, এবার তা তারা পাননি।


দরপত্র প্রক্রিয়ায় দেরির বিষয়টি স্বীকার করে নিলেও শিক্ষার্থীদের হাতে নির্ধারিত সময়েই বই পৌঁছে দেওয়ার আশার কথা বলছেন এনসিটিবির কর্মকর্তারা।

তারা বলছেন, প্রেস মালিকরা এবার ‘একজোট হয়ে’ দরপত্রে দর বেশি দেওয়ায় তারা পুনঃদরপত্র দিতে বাধ্য হয়েছেন, সেখানে সময় নষ্ট হয়েছে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেছেন, “আমাদের লক্ষ্যই হল ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের বই দেওয়া। সেজন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা আমরা চালাব।”

জটিলতা কোথায়?

২০১০ সাল থেকে বছরের প্রথম দিন মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার গত ১২ বছরে ৪০১ কোটি ২৪ লাখ ৩৯ হাজার ৯৭৮টি বই বিনামূল্যে বিতরণ করেছে।

গতবছর প্রাথমিকের বই নির্ধারিত সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হলেও মহামারীর কারণে স্কুলে স্কুলে উৎসব করে প্রথম দিনই তা বিতরণ করা যায়নি। মাধ্যমিকের সব বই পেতে কিছুটা অপেক্ষা করতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের।

২০২১ সালে ধাপে ধাপে ৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬২ হাজার ৪১২টি বই বিতরণ করা হয়। আর আসছে নতুন বছরে ৩৪ কোটি ৭০ লাখ ১৬ হাজার ২৭৭টি বই বিনামূল্যে বিতরণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

এনসিটিবি বলছে, এরই মধ্যে ১০ কোটি বই ছাপিয়ে বিভিন্ন এলাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি কাজ শেষ করে আরও ২৪ কোটির বেশি বই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানোর জন্য হাতে সময় আছে দেড় মাসের কম। কিন্তু সে অনুযায়ী কাজ এগোয়নি বলে জানিয়েছে কয়েকটি প্রেস।

বাংলাবাজারে ঢাকা প্রিন্টার্সের স্বত্বাধিকারী আমিন খান জানান, মাধ্যমিকের সাড়ে ৫ লাখ বইয়ের অর্ডার পেয়ে অর্ধেক কাজ শেষ করতে পেরেছেন তারা।

“আমরা আগে ওয়ার্ক অর্ডার পাওয়ার পর ৯৮ দিন সময় পেতাম। এবার পেয়েছি ৭৪ দিন। এই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা, সময়মত বই দেওয়া অনেক কষ্টের হয়ে যাবে।”

তিনি বলেন, “যাদের অনেক লোকবল আছে, তাদের সমস্যা নাই। কিন্তু আমাদের মত প্রতিষ্ঠানের চাপ হয়ে যায়।

এবার কেন সমস্যা হল জানতে চাইলে আমিন খান বলেন, “এনসিটিবি টেন্ডারগুলো আগে থেকে করলে সবারই সুবিধা হত। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি সময়মত বই দেওয়ার।”

সাধারণত পরের শিক্ষাবর্ষের বই ছাপানোর দরপত্র প্রক্রিয়া মে মাসের মধ্যেই শেষ করা হয়। জুনে কার্যাদেশ পাওয়ার পর কাজ শুরু হয় ছাপাখানাগুলোতে। মহামারীর কারণে গত বছর এই প্রক্রিয়া কিছুটা পিছিয়ে যায়।

এবার ২৯ মার্চ ২০২২ শিক্ষাবর্ষের বই ছাপানোর দরপত্র প্রক্রিয়া শুরু করে এনসিটিবি। তখন তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের দরপত্র আহ্বান করা হয়। পরে অন্যান্য বইয়ের জন্য কয়েক ধাপে দরপত্র ডাকা হয়। নভেম্বর পর্যন্ত এই দরপত্রগুলোতে আবার সংশোধনী আনা ও পুনরায় দরপত্র আহ্বান করায় বইয়ের কার্যাদেশ পিছিয়ে যায়।

এর মধ্যে প্রথম দরপত্র আহ্বান করা তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকের ‌‘পুনঃদরপত্র সংশোধনী’ আনা হয় ৮ অগাস্ট। সর্বশেষ ৯ নভেম্বর প্রাক-প্রাথমিকের ‘আমার বই’ এর আন্তর্জাতিক দরপত্র পুনরায় আহ্বান করা হয়।

প্রেস মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের অনেক কার্যাদেশই পেয়েছেন নভেম্বরের শুরুতে। এখন শর্ত অনুযায়ী ৭৪ দিন সময়ে বই দিলেও ১ জানুয়ারির মধ্যে সব বই পাঠানো যাবে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত নন তারা।

পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ পাওয়া বাংলাবাজারের একজন প্রেস মালিক নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, “বই ছাপানোর সার্বিক খবর আসলে ভালো না। এনসিটিবির গত বছরের কিছু টাকা এখনও বাকি আছে। সবকিছুর খরচ বেড়ে গেছে, হঠাৎ করে তেলের দাম বেড়ে গেল। কাগজের দাম বেড়ে গেছে। আমার তো দাম বাড়ানোর কোনো উপায় নাই। কালি আমরা কিনতাম ১২২-১২৮ টাকায়, সেটা এখন কিনতে হচ্ছে ১৬৫-১৭০ টাকা দিয়ে।

“আমরা যখন টেন্ডারে গেলাম, সরকারের ট্যাক্স ছিল ৫ শতাংশ, জুনে এসে সেটা করে ফেলছে ৭ শতাংশ। কিন্তু আমরা রেট বাড়াতে পারি নাই।”

যারা সবসময় পাঠ্যপুস্তকের কাজ পান, তারা এবার ‘কম কাজ’ পেয়েছেন দাবি করে তিনি বলেন, “অভিজ্ঞতা না থাকলে কাজটা ভালো হবে না। টেন্ডার দিতে দেরি হয়েছে, পুনরায় টেন্ডার দিয়েছে এর কারণে তো কাজের উপর কিছুটা প্রভাব পড়বেই।”

বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির চেয়ারম্যান শহীদ সেরনিয়াবাতের অভিযোগ, বই ছাপানোর ক্ষেত্রে ‘এনসিটিবির কয়েকজন কর্মকর্তার অনিয়মের কারণে’ এই জটিলতা তৈরি হয়েছে।

“একটা প্রকাশনীকে বেশি কাজ দেওয়ার জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম করেছে। ওই প্রতিষ্ঠানকে ৩০ শতাংশ কাজ দিয়েছে। এতো কাজ একটি প্রতিষ্ঠানকে আগে কখনও দেয়নি।

“তাছাড়া দরপত্র প্রক্রিয়ার ত্রুটির কারণেও এবার বই ছাপানোর কাজ পিছিয়ে গেছে। মাধ্যমিক স্তরের অনেক বইয়ের এখনও চুক্তি চলছে। ওয়ার্ক অর্ডার হয়নি।”

প্রাথমিক স্তরে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৭৫ লাখ বই ছাপানো হচ্ছে ভারতে। আর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বই বাংলাদেশে ছাপা হচ্ছে। সে কাজ পুরোদমে চলায় নির্ধারিত সময়েই শিক্ষার্থীদের হাতে প্রাথমিকের বই পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে আশাবাদী প্রেস মালিকরা।

ঢাকার বাসাবোর পূর্ব নন্দীপাড়ার লেটার অ্যান্ড কালার লিমিটেডের প্রোডাকশন ম্যানেজার আশরাফুল কবির পলাশ জানান, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ১ কোটি ১৭ লাখ বইয়ের কাজ তারা পেয়েছেন।

“এর মধ্যে প্রাথমিকের ৫৪ লাখ বইয়ের অর্ধেকের বেশি বই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিকের ৬৭ লাখ বইয়ের কাজ চলছে। ১০ লাখ ছাপানো হয়েছে।”

বাংলাবাজারের মৌসুমী অফসেট প্রেসের কর্ণধার নজরুল ইসলাম কাজল জানান, তারা এ বছর এক কোটির কিছু বেশি বই ছাপানোর কাজ পেয়েছেন। এর মধ্যে প্রাথমিকের ৩৩ লাখ বই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, মাধ্যমিকের ১৮ লাখ বই পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।

বাকি ৫০ লাখ বই ছাপিয়ে পাঠানোর কাজ ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার আশা করছেন তিনি।

এনসিটিবি কী বলছে?

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, বই ছাপানোর এ কাজে তারা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। সেজন্য বছরের প্রথম দিন থেকেই তাদের প্রস্তুতি শুরু হয়।

“করোনাভাইরাসের কারণে, লকডাউনের কারণে আমাদের কিছু সময় নষ্ট হয়েছে। বিভিন্ন কারণে, যেমন- প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে ছিলেন, এসে আমাদের অনুমোদন দিয়েছেন, এগুলোর কারণে কিছু সময় নষ্ট হয়েছে। কিন্তু ব্যাপকভাবে প্রস্তুতি চলছে আমাদের।”

এ পরিস্থিতিতে সব শিক্ষার্থীর হাতে বছরের প্রথম দিন বই তুলে দেওয়া সম্ভব হবে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সেটা সম্ভব করতে তাদের ‘সর্বাত্মক চেষ্টা’ চলছে।

দরপত্রে বিলম্বের অভিযোগের বিষয়ে ফরহাদুল ইসলাম বলেন, “প্রেস মালিকরা প্রথমে আমাদের এস্টিমেটেড দরের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি দর দিয়েছিল।… এবার সবাই মিলেমিশে এরকম করেছে। ওরা টেন্ডারের গতি-প্রকৃতি সবই জানে। তারপরও এমন করেছে। এর কারণে প্রথম টেন্ডারটা ভ্যালিডিটি পায়নি।”

একটি প্রতিষ্ঠানকে বেশি কাজ দিতে দরপত্র প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে বলেন, “এটা কী কখনও হয়? একটা প্রতিষ্ঠানের জন্য আমরা আমাদের এতদিনের সুনাম নষ্ট করব?

“দরপত্র দেওয়ার সময় যিনি আমার কাঙ্ক্ষিত দরের মধ্যে থাকবেন, তাকে আমি কাজ দেব না? উনি হয়ত বাকিদের সাথে নেগোসিয়েশন করেন নাই। সে কারণে উনার কাছে কাজ গেছে।”

এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বছরের প্রথম দিনই সব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছে দেওয়ার আশার কথা বলেছেন।

তিনি বলেন, “আমাদের ১০ কোটি বই ইতোমধ্যে উপজেলায় চলে গেছে। বাকিগুলোও চলে যাবে। যারা কাজ পায়নি, তারাই বিভিন্ন কথা ছড়াচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান শতভাগ বই দিয়ে দিয়েছে।”

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে


সূত্র : বিডিনিউজ