সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) বন্দরবাজার ফাঁড়িতে হেফাজতে রায়হান আহমদ হত্যা মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের নির্ধারিত তারিখ ছিল আজ। এজন্য কারাগার থেকে আসামিদের আদালতে নিয়ে আসা হয়। তবে মহানগর দায়রা জজ আদালতের কার্যক্রম শুরুর পর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা এই মামলায় অভিযোগ গঠনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যাওয়ার কথা জানান। অবশ্য আদালত সাক্ষ্যগ্রহণের সিদ্ধান্ত দেন। কিন্তু আজ কোর্ট রেফারেন্স থাকায় পরে আর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। কোর্ট রেফারেন্স হচ্ছে কোনো আইনজীবী মারা গেলে আদালতের কার্যক্রম সীমিত বা বন্ধ থাকে।

সরেজমিনে দেখা যায়, আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টার খানিক আগে রায়হান হত্যা মামলার আসামি বরখাস্তকৃত এসআই আকবর হোসেন ভুঁইয়াসহ অন্যান্যদের কারাগার থেকে আদালতে নিয়ে আসা হয়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মহানগর দায়রা জজ মো. আব্দুর রহিমের আদালতে শুরু হয় এ মামলার কার্যক্রম।


কিছুক্ষণ পরে সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) নওশাদ আহমেদ চৌধুরী সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন। তিনি বলেন, সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আজ তিনজন সাক্ষী আদালতে হাজির ছিলেন। তারা হলেন- রায়হানের মা সালমা বেগম, স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী ও রায়হানের চাচা শ্বশুর।

তিনি বলেন, ‘সাক্ষ্য নিতে গেলে দুটি বিষয় সামনে আসে। প্রথমত, আজ আসামিদের আসতে একটু দেরি হয়েছে এবং আমাদের একজন আইনজীবী ইন্তেকাল করায় আজ কোর্ট রেফারেন্স ছিল। ইন দ্য মিন টাইম আসামিদের আইনজীবীরা আদালতে একটি দরখাস্ত দিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, গত দিন (১৮ এপ্রিল) এই মামলায় যে চার্জ গঠন হয়েছিল এর বিরুদ্ধে তারা হাইকোর্টে রিভিশনে গিয়েছেন। কিন্তু ওইটার কার্যক্রম বন্ধ বা স্থগিত এই মর্মে কোনো কিছু আনেননি। শুধু উনারা একটা লইয়ার সার্টিফিকেট দাখিল করেছেন যে আমরা গিয়েছি। পরে আদালত বলেছেন, আমি সাক্ষ্য নেব এবং আপনাদের পিটিশনটাও দেখব। পরে দেখা গেল আজ আর কিছু সম্ভব হচ্ছে না কোর্ট রেফারেন্সের কারণে। পরে আদালতের কার্যক্রম মুলতবি করা হয়।’

নওশাদ চৌধুরী জানান, এই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামীকাল বুধবার ও পরশু বৃহস্পতিবার তারিখ ধার্য রয়েছে।

তিনি জানান, রায়হান হত্যা মামলায় হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন তৎসহ ৩০২ দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারা ও ২০১ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু আসামিপক্ষ শুধুমাত্র হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে মামলাটি চালাতে চান। এজন্য অভিযোগ গঠনের বিরুদ্ধে তারা হাইকোর্টে গেছেন।

বাদীপক্ষের আইনজীবী এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ জানিয়েছেন, রায়হান হত্যা মামলায় অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে সাক্ষী করা হয়েছে।

এর আগে গত ১৮ এপ্রিল সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আবদুর রহিমের আদালতে ৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে রায়হান হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়। এরও আগে ১২ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের তারিখ থাকলেও সেটি পিছিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

২০২০ সালের ১১ অক্টোবর ভোরে সিলেট শহরের আখালিয়ার এলাকার বাসিন্দা রায়হান আহমদকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরে তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে তিনি সেখানে মারা যান। পরদিন তার স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।

মামলাটির তদন্তে প্রথমে পুলিশ ছিল। পরে সে বছরের ১৩ অক্টোবর মামলাটি স্থানান্তর করা হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে। গত বছরের ৫ মে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক আওলাদ হোসেন আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ১ হাজার ৯০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

যে ছয়জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়, তাদের পাঁচজনই পুলিশ সদস্য। তারা হলেন- বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভুঁইয়া, এসআই হাসান উদ্দিন, এএসআই আশেক এলাহী, কনস্টেবল টিটুচন্দ্র দাস ও হারুনুর রশিদ।

অভিযুক্ত অপরজন আব্দুল্লাহ আল নোমান, যার বাড়ি কোম্পানীগঞ্জে। তার বিরুদ্ধে ঘটনার পর ভিডিও ফুটেজ গায়েব করার অভিযোগ রয়েছে।

এই ছয়জনের বিরুদ্ধেই অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। অভিযুক্ত পাঁচ পুলিশ সদস্য কারাগারে থাকলেও নোমান এখনও পলাতক রয়েছেন। সম্প্রতি সিলেটভিউয়ের সাথে যোগাযোগ করে নোমান জানান, তিনি কয়েকটি দেশ ঘুরে বর্তমানে ফ্রান্সে অবস্থান করছেন। সেখানে তিনি নাগরিকত্ব পাওয়ার চেষ্টায় রয়েছেন।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর সিলেটের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর আদালতের বিচারক আবুল মোমেন রায়হান হত্যা মামলার চার্জশিট গ্রহণ করেন। বাদীপক্ষ চার্জশিটের বিপক্ষে নারাজি দেয়নি। আদালত পলাতক নোমানের বিরুদ্ধে পরোয়ানাও জারি করেন।

এদিকে, পুলিশ হেফাজতে রায়হানের মৃত্যুর ঘটনায় ময়নাতদন্ত রিপোর্টে তার শরীরে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন থাকার কথা উল্লেখ করা হয়।

প্রসঙ্গত, রায়হান হত্যা ঘটনার পর পালিয়ে যান এসআই আকবর। পরে ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর দুপুরে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লক্ষীপ্রসাদ ইউনিয়নের ডোনা সীমান্ত এলাকা থেকে এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া গ্রেফতার করে পুলিশ। পরদিন, ১০ নভেম্বর তাকে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চান তদন্ত কর্মকর্তা; আদালত সাত দিনের আবেদনই মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শেষে ১৭ নভেম্বর তাকে আদালতে হাজির করা হয়। আদালত আকবরকে কারাগারে প্রেরণের আদেশ দেন।

 

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে