স্বর্ণ পাচারকারী চক্র সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকেই ব্যবহার করছে বার বার। কিছুদিন পর পর ধরা পড়ছে স্বর্ণের বড় বড় চালান। ধরার পর জানা যায়, বেশিরভাগ চালানই আসে দুবাই থেকে। 

এদিকে, এসব চালান বহনকারীরা মাঝে-মধ্যে ধরা পড়লেও মূল ‘স্বর্ণ-সম্রাটরা’ সব সময়ই থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। 


কাস্টমস বিভাগ বলছে, স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে বড় চক্র জড়িত। গোয়েন্দা তৎপরতার ভিত্তিতে তাদের খোঁজে বের করা এবং আইনের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব। 

সর্বশেষ আজ শুক্রবার (২৭ মে) সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্টের রোগীদের ফুসফুসে ওষুধ প্রয়োগের যন্ত্রের (নেব্যুলাইজার) ভেতর থেকে ১১টি পাতসদৃশ্য ১ কেজি ১৬০ গ্রাম স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। যার বাজারমূল্য ৮০ লক্ষ টাকা। স্বর্ণের পাতগুলো দুবাই থেকে নিয়ে আসছিলেন মো. আলী আহমদ নামের এক প্রবাসী। তার বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার দরগার বাজার এলাকার উজান মেহেরপুর গ্রামে। শুক্রবার সকাল ৭ টায় দুবাই থেকে আসা বাংলাদেশ বিমানের বিজি-০২৪৮ ফ্লাইট-এর যাত্রী ছিলেন তিনি। স্বর্ণ জব্দের পর আলী আহমদকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে ওসমানী বিমানবন্দর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।  

এর আগে গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ১১ কেজি ২২০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণ উদ্ধার ও এর সাথে জড়িত সন্দেহে ৪ জনকে আটক করে কাস্টমস গোয়েন্দা বিভাগ। ওইদিন সকাল ৯টায় বাংলাদেশে বিমানের বিজি-২৪৮ দুবাই থেকে আসা ফ্লাইটের ৪ যাত্রীর সঙ্গে থাকা ব্যাগের ভেতরে আয়রন মেশিন ও জুসার মেশিনে করে স্বর্ণগুলো নিয়ে আসেন তারা। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের বারগুলোর বাজারমূল্য ছিলো প্রায় ৭ কোটি টাকা। ওই স্বর্ণ আয়রন মেশিন ও জুসার মেশিনের নীচে স্বর্ণ ঢালাই করে দুবাই থেকে সিলেটে নিয়ে আসা হয়। ওই স্বর্ণ বহনকারী চারজন ছিলেন- হবিগঞ্জ জেলার ছাতক নবীগঞ্জের শেখ মো. জাহিদ, কানাইঘাটের কায়স্থগ্রামের আব্দুল আহাদের ছেলে মকবুল আলী, কেউরিয়া হাওরের মনতাজ আলীর ছেলে বশির উদ্দিন ও বাঁশবাড়ি এলাকার নাজিম উদ্দিনের ছেলে সুলতান মাহমুদ। পরে তাগের গ্রেফতার করা হয়।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত স্বর্ণ উদ্ধারের খবরগুলো বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, এই দুই চালানের আগে সিলেট এয়ারপোর্টে ৭ বছরে আড়াই মন স্বর্ণ উদ্ধার করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। উদ্ধার হওয়া এসব স্বর্ণের বাজারমূল্য প্রায় ৫৬ কোটি টাকা। স্বর্ণ পাচারের সাথে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়। তবু থামছে না সিলেট এয়ারপোর্ট ব্যবহার করে স্বর্ণ চোরাচালান।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিলেট এয়াপোর্ট দিয়ে বেশীরভাগ স্বর্ণ আসে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে। বিশেষ করে দুবাই থেকে আসা যাত্রীদের কাছ থেকে এ বিমানবন্দরে বড় বড় স্বর্ণের চালান আটক হয়েছে। এছাড়া, সৌদি আরব থেকে অনেক সময় আসে স্বর্ণের ছোট চালান। 

জানা গেছে, গত ৭ বছরের মধ্যে ৪ বছরে উদ্ধার করা হয় দেড় মণ স্বর্ণ। আর বাকী সব স্বর্ণ উদ্ধার করা হয় পরবর্তী তিন বছরে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী- ২০১৭ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের ২২ নভেম্বর পর্যন্ত ওসমানী বিমানবন্দরে ১৮টি স্বর্ণের চালান আটক করে কাস্টমস। এই চার বছরে ১৮টি চোরাচালানের ঘটনায় ৫৯ দশমিক ১৮ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। আটক স্বর্ণের চালানোর দাম প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। এসব স্বর্ণ উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১০টি। তবে মামলাগুলো এখনো আদালতে বিচারাধীন।

২০১৪ সাল থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত পর্যন্ত ওসমানী বিমানবন্দর থেকে উদ্ধারকৃত স্বর্ণের পরিমাণ প্রায় ১০০ কেজি। মণ হিসেবে এর ওজন প্রায় আড়াই মণ। গত বছরের ৮ নভেম্বর দুবাই ফেরত যাত্রী নরেন্দ্র নাথের কাছ থেকে ৬ কেজি ১৪৮ গ্রাম ওজনের ৩৮ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করে কাস্টমস। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের দাম প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পরে নরেন্দ্র নাথকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। নরেন্দ্র নাথের বাড়ি মৌলভীবাজার এলাকায়।

২০২০ সালের ১৮ ডিসেম্বর ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুবাই থেকে আসা জামিল আহমদ (২৮) নামের এক যাত্রীর কাছ থেকে ১৪টি স্বর্ণের বার ও কিছু স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের ওজন প্রায় দুই কেজি। যার দাম প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ১২ টি বার বিশেষ ব্যবস্থায় জামিলের উরুতে আটকানো ছিল। জামিলের বাড়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলায়।

ওসমানী বিমানবন্দরে আবুধাবী থেকে আসা জাহিদ হোসেন নামের এক যাত্রীর কাছ থেকে ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টম্বর ৪ কেজি ৬৪ গ্রাম ওজনের ৪০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া স্বর্নের দাম প্রায় ২ কোটি টাকা। এরপর জাহিদ হোসেনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে কাস্টমস।

একই বছরের ৩ জানুয়ারি ওসমানী বিমানবন্দরে ফ্লাই দুবাই দিয়ে আসা একটি ফ্লাইটে তল্লাশী চালিয়ে ৬০ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করে কাস্টমস। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের ওজন প্রায় ৭ কেজি। যার দাম প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ ঘটনায় বাংলাদেশ বিমানের মেকানিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট কারিমুল ইসলামকে আটক করা হয়।

২০১৭ সালের ২৩ জুলাই আবুধাবি থেকে আসা বিমানের লাগেজ হোল্ডে অভিযান চালিয়ে ৩ কেজি ৫০০ গ্রাম ওজনের ৩০ টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে কাস্টমস। বিমানের ওই ফ্লাইটটি সিলেট হয়ে ঢাকায় ফিরছিল। স্বর্ণের এই চালান আটকের ঘটনায় কাউকে আটক করা যায়নি।

২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর দুবাই থেকে আসা বিমানে তল্লাশি চালিয়ে ১৬টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে কাস্টমস। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের ওজন ১ কেজি ৮৭২ গ্রাম। এ ঘটনায় কাউকে আটক করা যায়নি। একই বছরের ১৬ নভেম্বর ওসমানী বিমানবন্দর থেকে ৯ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের ৮০ টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে কাস্টমস। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের দাম প্রায় ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিমানের আসনের নিচে তল্লাশী চালিয়ে এসব স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। দুবাই থেকে আসা ওই বিমানের দুটি সীটের নীচ থেকে কাগজে মোড়ানো অবস্থায় স্বর্ণের বারগুলো উদ্ধার করা হয়। তবে এ ঘটনায় কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি।

ওই বছরের ১৭ মার্চ ৫৮০ গ্রাম ওজনের ৫টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায়ও কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। ২৪ এপ্রিল এক লন্ডন প্রবাসীর কাছ থেকে ৪৩২ গ্রাম স্বর্ণ উদ্ধার করে কাস্টমস। পরে ব্যাগেজ রুলস মোতাবেক বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয়।

২০১৪ ও ২০১৫ সালে ওসমানী বিমানবন্দর থেকে ১৯ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করে কাস্টমস। 

সিলেট বিমানবন্দর কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার মো. আল আমিন শুক্রবার বিকেলে সিলেটভিউ-কে বলেন, স্বর্ণ চোরাচালানের ক্ষেত্রে দুটি পক্ষ থাকে। একটি বিদেশে এবং দ্বিতীয়টি দেশে। আর যারা ধরা পড়ে তারা বাহকমাত্র। মূল হোতারা আড়ালেই থেকে যায়। 

তিনি বলেন, আমরা যাদের ধরি তাদের পরবর্তীতে স্বর্ণ চোরাচালান আইনে বিশেষ মামলা দায়েরপূর্বক থানাপুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। মামলার দীর্ঘসূত্রিতায় তারা কেউ কেউ জামিন নিয়ে বের হয়, আবার কেউ শাস্তি ভোগ করে জেল থেকে মুক্তি পায়।

এক প্রশ্নের জবাবে ডেপুটি কমিশনার মো. আল আমিন বলেন, এ কারবারে মূলত বড় চক্র জড়িত থাকে। তবে যারা মূল হোতা তাদের হয়তো গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে খুঁজে বের করা সম্ভব। সিলেট বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান রোধে আমরা তৎপর রয়েছি।


সিলেটভিউ২৪ডটকম / ডালিম