সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম আলীরগাঁও ইউনিয়নের হাতিরপাড়া গ্রামের লিয়াকত আলী। স্ত্রী সন্তান নিয়ে ৯ সদস্যের পরিবার। দিনমজুরের কাজ করে চলতো দিন। টানাপোড়েনের সংসারে মাথা গোঁজার ঠাঁই বলতে ছিল কেবল একটা খড়ের তৈরি কাঁচাঘর। ১৫ জুন থেকে পানিবন্দি হয়ে পড়েন লিয়াকত আলী। পরদিন টিকতে না পেরে পরিবার নিয়ে ওঠেন এলাকার একটি আশ্রয়কেন্দ্রে। ৯ দিন পর যখন লিয়াকত আলী বাড়ি ফিরেন তখন দেখতে পান বসতঘরটি মাটিতে মিশে আছে। বানের পানি কেড়ে নিয়েছে তার আশ্রয়স্থল। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরে লিয়াকত আলী যেন হয়ে পড়েন আশ্রয়হীন।

লিয়াকত আলীর মতো একই অবস্থা গোয়াইনঘাট উপজেলার নন্দিরগাঁও ইউনিয়নের নোয়াগাঁও এর আবদুল কাদিরের। হাঁস লালন পালন আর কামলা খেটে চালাতেন ৬ সদস্যের পরিবার। বন্যার স্রোতের তোড়ে আবদুল কাদিরের বসতঘরও বসে গেছে মাটিতে। আর বানের পানির সাথে ভেসে গেছে আয়ের অবলম্বন হাঁসগুলো। খোলা আকাশকে ছাদ বানিয়ে এখন রোদ-বৃষ্টিতে মানবেতন দিনাতিপাত করছেন আবদুল কাদির। তার ভাষায়- ‘এর চেয়ে ভাল ছিল বন্যার পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। বন্যায় জীবিত রেখে গেছে, অথচ সর্বস্ব হারিয়ে পরিবার নিয়ে এখন বেঁচে থাকাটাও দায়। যেখানে দুমুঠো ভাতের যোগাড় করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে ঘর বানানো তো দু:স্বপ্ন মাত্র।’



লিয়াকত আলী ও আবদুল কাদিরের মতো সিলেটে লাখো পরিবারের অবস্থা একই। এবারকার ভয়াবহ বন্যায় বেঁচে থাকার সকল অবলম্বন হারিয়ে তারা এখন নিঃস্ব। বন্যার পানিতে ধসে পড়েছে ঘরবাড়ি। পানির তোড়ে ভেসে গেছে আসবাবপত্র ও তৈজসপত্র। এক কাপড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠা বানভাসি মানুষ এখনো আছেন একইভাবে। জীবনের সকল রঙ কেড়ে নিয়েছে সর্বনাশা বন্যা।

সিলেটে শতবর্ষী প্রবীণরাও বলছেন, তাদের জীবদ্দশায় এবারের মতো ভয়াবহ বন্যা দেখেননি। ১৯৮৮ ও ২০০৪ সালের বন্যাকে সিলেটের ইতিহাসের বড় বন্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এবারকার বন্যার ভয়াবহতা ছাড়িয়ে গেছে অতীতের সকল ইতিহাস। এর আগে গোটা জেলাজুড়ে এমন ভয়াবহ বন্যা হয়নি বলে স্বীকার করছে জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডও।

জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, বন্যায় সিলেট জেলার ১৩টি উপজেলা ও ৫টি পৌরসভায় ৪০ হাজার ৯১টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৩৮৩টি পরিবারের ২৯ লাখ ৯৯ হাজার ৪৩৩ জন। জেলাজুড়ে বন্যা যখন ভয়াবহ রূপ নেয় তখন ৬১৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠেন ২ লাখ ৫২ হাজার ৭৮৪ জন বন্যার্ত। পানি কমার পর যখন তারা আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়ি ফিরে যান, তখন তারা দেখতে পান তাদের সর্বনাশের দৃশ্য। বেশিরভাগ কাঁচা ঘরবাড়ি বন্যার পানিতে ভেসে গেছে অথবা ভেঙ্গে পড়েছে। যেগুলো কোনরকম খাঁড়া আছে সেগুলোর অবস্থাও নড়বড়ে। ঝড়-তুফান হলে সেগুলোও ধসে পড়ার আশঙ্কা করছেন ঘরের মালিকরা।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, মঙ্গলবার পর্যন্ত জেলার ৩১৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছিলেন ২৫ হাজার ৫৭৯ জন। ঘরবাড়ি হারিয়ে অনেকে এখনো পরিবার নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন।

এদিকে, সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান জানিয়েছেন, প্রথম ধাপে পুনর্বাসনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এমন পাঁচ হাজার পরিবারকে এই সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে এই খাতে আরও বরাদ্দ আসলে আরও ক্ষতিগ্রস্তদের ঘরবাড়ি নির্মাণে অর্থ সহায়তা দেয়া হবে বলে জানান তিনি।

এদিকে, সিলেট সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকাগুলোতেও বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়ক রায় চৌধুরী জানিয়েছেন, নগরীতে কয়েক হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। তালিকা প্রস্তুত হলে পুনর্বাসনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/পিডি