দেশের মানুষ যে ছোট দানার মসুর ডাল কেনেন, তার বড় অংশ আসে অস্ট্রেলিয়া থেকে। মাস দুয়েক আগে অস্ট্রেলিয়ার এই ডালের দাম টনপ্রতি ৯২০ মার্কিন ডলারে উঠেছিল। এরপর থেকে কমছে। এখন অস্ট্রেলিয়ার ডালের দাম নেমেছে ৭৮০ ডলারে।

মানে হলো, অস্ট্রেলিয়ার মসুর ডালের দর ১৫ শতাংশের মতো কমেছে। দাম কমেছে দেশের আমদানিকারক পর্যায়েও। কিন্তু খুচরা পর্যায়ে দাম কমেনি এক টাকাও।


শুধু মসুর ডাল নয়; বিশ্ববাজারে চাল, সয়াবিন তেল, পাম তেল, গম, চিনি, গুঁড়া দুধসহ খাদ্যপণ্যের দাম কমছে। কিন্তু এর সুফল সামান্যই পাচ্ছেন দেশের মানুষ।

দেশে দাম ততটা না কমার পেছনে ব্যবসায়ীরা দুটি কারণ দেখাচ্ছেন—১. ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া ও এই বাজারে অস্থিরতা। ২. বিশ্ববাজারে পড়তি দামের পণ্য দেশে এখনো না আসা।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্ববাজারে দাম কতটা কমেছে, সে অনুযায়ী দেশে কতটা কমা উচিত, সেটা নিয়ে পর্যালোচনা করা দরকার। কারণ, সাধারণত বিশ্ববাজারে দাম বাড়লেই দেশে বেড়ে যায়। কিন্তু কমার সময় দেশের বাজারে খুচরা পর্যায়ে প্রভাব পড়তে অনেক সময় লাগে।

ডালের উদাহরণেই আবার ফিরে যাওয়া যাক। চট্টগ্রামের বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী জানালেন, তাঁরা এখন সরু দানার আস্ত মসুর ডাল বিক্রি করছেন প্রতি কেজি ৮১ টাকার কিছু কম দরে। তাঁর হিসাবে, আস্ত ডাল ভাঙাতে কেজিপ্রতি ১২ থেকে ১৩ টাকা খরচ। মানে হলো, ৯৪ টাকা দাঁড়ায় সরু দানার মসুর ডালের দাম। এরপর মিলমালিক, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীর মুনাফা এবং পরিবহন খরচ যোগ হবে।

ঢাকার বাজারে সরু দানার মসুর ডাল কেজি ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কোনো বিপণন কোম্পানি এই ডাল প্যাকেটে ভরে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি দরেও বাজারে ছাড়ছে। বিষয়টি জানালে আবুল বশর চৌধুরী বলেন, ‘দাম এতটা হওয়া উচিত নয়।’

বিশ্ববাজার পড়তি>>

বিশ্বজুড়ে করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ায় হঠাৎ পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি, জাহাজভাড়া বেড়ে যাওয়া এবং গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর সরবরাহ–সংকটে দেশে দেশে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। পণ্যবাজার বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি দাম ছিল মার্চ ও এপ্রিলে। মে মাস থেকে বিশ্ববাজারে দাম কমতে থাকে। জুন ও জুলাইয়ে প্রায় সব পণ্যের দামই কমেছে।

বাজার বিশ্লেষণকারী সংস্থাগুলো বলছে, দাম কমার কারণ হলো বিভিন্ন দেশ রপ্তানি বন্ধের যে নীতি নিয়েছিল, সেখান থেকে সরে এসেছে। আবার কিছু দেশে উৎপাদন ভালো হয়েছে, বিপরীতে দাম বেড়ে যাওয়ার পর চাহিদাও কমে গেছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন চুক্তির পর ইউক্রেন থেকে শস্য সরবরাহ শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) প্রতিদিন বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম তুলে ধরে সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে একটি প্রতিবেদন দেয়। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের পণ্যবাজার তথ্য ধরে তৈরি করা সেই প্রতিবেদন বলছে, গত মে (২৩ মে) মাসের তুলনায় জুলাইয়ে (৩১ জুলাই) গমের দাম কমেছে ৩০ শতাংশ। একইভাবে চাল ১২, সয়াবিন তেল ৩১, পাম তেল ৩৬, চিনি ৬ ও সার্বিকভাবে মসুর ডালের দাম ১৯ শতাংশ কমেছে। গ্লোবাল ডেইরি ট্রেডের হিসাব বলছে, পূর্ণ ননিযুক্ত গুঁড়া দুধের দাম কমেছে ৬ শতাংশ।

দেশের বাজারের কী অবস্থা>>

পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে ভোজ্যতেল ও চিনির পাইকারি কেনাবেচা হয়। আর পাইকারি দরে ডাল বিক্রি হয় চকবাজারের কাছের রহমতগঞ্জে। গত সোমবার এই দুই বাজার ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোটামুটি কমেছে ভোজ্যতেলের দাম। অন্য পণ্যে তেমন প্রভাব নেই।

মৌলভীবাজারের পাইকারি দোকানে এখনই সরবরাহ করার ক্ষেত্রে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হয় প্রতি লিটার ১৪৮ টাকার আশপাশের দামে। ব্যবসায়ীরা জানান, এই দরটি সর্বোচ্চ ১৭৮ টাকায় উঠেছিল। মানে হলো, লিটারে দাম কমেছে প্রায় ৩০ টাকা।

অবশ্য সাধারণ মানুষ বোতলজাত সয়াবিন তেল কেনেন। বিশ্ববাজারে দাম কমার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনার পর ব্যবসায়ীরা সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ২০ টাকা কমিয়েছেন। কমার হার ১০ শতাংশের কম। ওদিকে বিশ্ববাজারে কমেছে ৩০ শতাংশের বেশি।

বাজারে দুভাবে আটা বিক্রি হয়—খোলা ও মোড়কজাত। বাজারে খোলা আটার দাম কিছুটা কমেছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব বলছে, ২২ মে থেকে ২ আগস্ট সময়ে খোলা আটার সর্বনিম্ন দর প্রতি কেজিতে পাঁচ টাকা কমেছে। যদিও প্যাকেটজাত আটার দাম কমেনি। সংস্থাটির হিসাবে, এখন প্রতি কেজি প্যাকেটজাত আটা ৪৮ থেকে ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

অবশ্য বিপণনকারী কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, দু–একটি কোম্পানি আটার দাম কেজিপ্রতি ৪ টাকা কমিয়ে বাজারে ছাড়া শুরু করেছে। এতে দাম কমার হার দাঁড়ায় ৭ শতাংশের মতো। যদিও বিশ্ববাজারে গমের দাম ৩০ শতাংশের মতো কমেছে।

দেশে কেন উল্লেখযোগ্য হারে দাম কমছে না, জানতে চাইলে ভোগ্যপণ্য বিপণনকারী শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান টি কে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আথহার তাসলিম বলেন, বিশ্ববাজারে দাম কমলেও ডলারের দর আবার বেড়ে গেছে। ডলারের বাজারও অস্থির। তাই ব্যবসায়ীরা আমদানির ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন।

ডলারের দাম কতটা বেড়েছে>>

দেশে গত মে মাসের মাঝামাঝি থেকে ডলারের বাজার অস্থির হতে শুরু করে। তখন প্রতি ডলারের দর ছিল ৮৬ টাকার আশপাশে। এরপর থেকে ব্যাংকে ডলারের দাম বাড়তে বাড়তে ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। আমদানিকারকেরা বলছেন, এখন ডলারপ্রতি কমপক্ষে ১০৫ টাকা দিয়ে পণ্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হচ্ছে। খোলাবাজারে ডলার উঠেছে ১১০ টাকায়।

হিসাব করে দেখা যায়, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ২২ শতাংশের মতো। পণ্যের দামে টাকার অবমূল্যায়নের প্রভাব পড়েছে।

বিশ্ববাজার থেকে সয়াবিন তেল আমদানি করতে এখন জাহাজভাড়াসহ টনপ্রতি দাম পড়ছে ১ হাজার ৪০০ ডলার। প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ধরে এক লিটার তেলের দাম পড়ে ১২০ টাকা। আর ডলারপ্রতি ১০৫ টাকা ধরে এক লিটারের দাম পড়ে ১৪৭ টাকা। সুতরাং শুধু ডলারের বাড়তি দামের কারণেই সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ২৭ টাকা বেশি পড়ছে।

একইভাবে আমদানিতে গমের দাম প্রতি কেজি ৭ টাকা, চিনি ৮ টাকা, মসুর ডাল ১০ টাকা ও গুঁড়া দুধের দাম ৭১ টাকা বেশি পড়ছে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে।

এখানে অবশ্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ব্যাপারটি যুক্ত। কেউ কেউ বিপুল ব্যয়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি, বিদেশি ঋণে জরুরি নয় এমন সব প্রকল্প নেওয়া এবং অর্থ পাচারকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ওপর চাপ তৈরির জন্য দায়ী করছেন। তাঁরা বলছেন, ডলারের দাম যদি এভাবে না বাড়ত, তাহলে দেশের বাজারে বিশ্ববাজারে দাম কমার সুফল পাওয়া যেত।

বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার অসুবিধা দ্রুত টের পায়, কমার সুবিধা পায় দেরিতে। এর কারণ বাজারে প্রতিযোগিতা কম। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার যে যুক্তি তুলে ধরছেন, সেটা অনেকাংশে ঠিক। আবার দেশে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান গুটিকয় হওয়ায় বাজারে পণ্যের দাম ধরে রাখার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ রয়েছে।

‘এখন ধারকর্জ করতে হয়’>>

নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধকে কারণ হিসেবে সামনে আনা হলেও দেশে দর বাড়ছিল ২০২০ সালের শুরু থেকেই। বিশেষ করে চালের দাম বাড়ার সঙ্গে বিশ্ববাজারের তেমন কোনো সংযোগ নেই। সরকার নানা চেষ্টা করলেও চালের দাম কমাতে পারেনি।

টিসিবির হিসাবে, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি বাজারে মোটা চালের সর্বনিম্ন দাম ছিল ৩০ টাকা, এখন তা ৪৮ টাকা। ২৮ টাকার খোলা আটা ৪০ টাকা। ৮৬ টাকা লিটারের খোলা সয়াবিন তেল এখন ১৬২ টাকা। ৫৫ টাকার মোটা দানার মসুর ডাল এখন ১০০ টাকা। ৬২ টাকার চিনি এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়।

নিত্যপণ্যের দামের সঙ্গে বেড়েছে সাবান, টুথপেস্টসহ নিত্যব্যবহার্য পণ্য, পানি, গ্যাস ও শিক্ষা উপকরণের দাম। সব মিলিয়ে জীবনযাত্রার ব্যয়ই অনেকটা বেড়ে গেছে। কিন্তু অনেকের আয়ই বাড়েনি। ফলে সংসার চালাতে হিমশিম অবস্থায় তাঁরা।

ঢাকার আজিমপুরের বাসিন্দা আঁখি আক্তার সোমবার কেনাকাটা করতে গিয়েছিলেন পলাশী কাঁচাবাজারে। তিনি এ সময় বলেন, ‘আমার স্বামীর যে আয়, তা দিয়ে বছরখানেক আগেও মাসে কিছু সঞ্চয় করতে পারতাম। এখন সঞ্চয় তো দূরের কথা, মাস শেষে অনেক সময় ধারকর্জ করতে হয়।’ তিনি বলেন, খাবার কেনায় খরচ কমিয়েছেন, জামাকাপড় কিনছেন না। বাসাভাড়া, গ্যাস–বিদ্যুতের বিল তো আর কমানোর সুযোগ নেই।

সরকারি তথ্য হলো, ২০১৯–২০ অর্থবছরে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) অনুপাতে জাতীয় সঞ্চয় ছিল ২৭ শতাংশের কিছু বেশি। সর্বশেষ অর্থবছরে (২০২১–২২) হারটি নেমে এসেছে ২২ শতাংশের নিচে। দেখা যাচ্ছে, শুধু আঁখি আক্তার নন, বহু মানুষ এখন আর ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করতে পারছেন না। দ্রব্যমূল্যের চাপে অনেকের তো পেট চালানোই দায়।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে


সূত্র : প্রথম আলো