সম্প্রতি এক মাসের ব্যবধানে সিলেটে দুইবার ধাক্কা দিয়ে গেছে বন্যা। দ্বিতীয় বন্যা পুরো সিলেট জেলাকে প্রায় বিধ্বস্ত করেছে। সেই দুই ধকল কাটিয়ে উঠার আগেই জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি সিলেটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের মাঝে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। সিলেটের এই দুই শ্রেণি ও দরিদ্র মানুষ চোখে রীতিমতো সরষে ফুল দেখছেন। 

সিলেট নগরীর তালতলা এলাকায় ভ্যান গাড়ি দিয়ে ভ্রাম্যমাণভাবে আচার বিক্রি করেন পারভেজ মিয়া। তার বাড়ি ভৈরব হলেও গত ১০ বছর ধরে সিলেট শহরে বসবাস করে সমসাময়িক ব্যবসা করে যাচ্ছেন। সংসারে বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানসহ ৭ জনের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকর্তা তিনি। আগে প্রতি মাসে ১২-১৪ হাজার টাকা রুজি করে সংসার চালিয়ে হাজার দুয়েক টাকা সঞ্চয় করতে পারতেন। কিন্তু বন্যার ধাক্কা আর একের পর এক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় গত দুই মাস ধরে টিকে থাকা দুঃসাধ্য হয়ে হচ্ছে তাঁর জন্য। কোনো রকম চলছে তাঁর সংসার। এরই মাঝে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো মনে হচ্ছে তাঁর কাছে। 


রবিবার (৭ আগস্ট) সন্ধ্যায় তিনি সিলেটভিউ-কে বলেন- ভাই কী আর বলবো। আগে তো সংসারের খরচ চালিয়ে কিছু টাকা সঞ্চয় করতে পারতাম। কিন্তু গত দুই মাস ধরে টেনেটুনে সংসার চলছে। আমাদের গরিব মানুষের অবস্থা খুবই খারাপ টিকে থাকা দায় হয়ে যাচ্ছে। এরই মাঝে বেড়েছে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম। এর ফলে নিশ্চয় দু-একদিনের মধ্যে সবকিছুর দাম আরেক দফা বাড়বে। এখন দুবেলা ভাত খেয়ে বাঁচতে পারবো কি-না সন্দেহ। 

জিন্দাবাজার পয়েন্টে মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে প্যাসেঞ্জার খুঁজছিলেন রকি নামের এক উবার চালক। তিনি বলেন- আমরা পেট্রোলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার পূর্বেই উবার ও পাঠাও-এর অ্যাপস ব্যবহার করে যাত্রী সেবা দিয়ে যেতাম। কিন্তু গত দুদিন পূর্বে হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা উবার ও পাটাও-এর অ্যাপস ব্যবহার করা বন্ধ করে দিয়েছি।

কেন বন্ধ করে দিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি সিলেটভিউ-কে বলেন- আমরা আগে ৮৬ টাকা ধরে পেট্রোল কিনতাম। এখন কিনতে হয় ১৩০ টাকায়। দুইশত টাকার তেল দিয়ে সারাদিন চলতে পারতাম। কিন্তু এখন দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় খরচও বৃদ্ধি পেয়ে গেছে। কোম্পানিও আমাদের রেট বৃদ্ধি করে নাই। তাই ক্ষতি সামলাতে আমরা অ্যাপস ব্যবহার বন্ধ করে বসে আছি। কিন্তু যাত্রী তো মিলে না। যাত্রী যে টাকা দিয়ে যেতে চান সে টাকা দিয়ে আমাদের পোষায় না। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন- আমরা আগে উপশহর ৫০ টাকায় যেতাম। কিন্তু এখন উপশহর ৫০ টাকায় গেলে আমাদের লোকসান হয়। তাই আমরা খুবই সমস্যায় আছি।

তিনি বলেন- বর্তমানে সবকিছুর ধরদাম ঊর্ধ্বগতি। তারমধ্যে হুট করে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা বিপাকে আছি। জনজীবন মারাত্মক আকারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। 

কাকলী শপিং সিটিতে এক কাপড় সেলাই মেশিনের দোকানে কাজ করা রহিম আলী বলেন- সবকিছুর দাম তো বাড়ছে আমাদের তো বেতন বাড়ে না। আমরা কীভাবে খাবো আর কিভাবে চলবো সেটা নিয়ে চিন্তায় আছি।

ওই শপিং সিটির ফয়সল ফেব্রিকস্ এর মালিক ফয়সাল মাহমুদ বলেন- সবকিছুর দাম বাড়ছে। বিদ্যুৎও থাকে না। ঘনঘন লোডশেডিং হয় জেনেরেটার চালাতে হয়। যে হারে জ্বালানী তেলের দাম বেড়েছে তাতে আমাদের খরচের খাতাও লম্বা হচ্ছে। আর জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রেতাদেরও সংকট রয়েছে। এখন ক্রেতারা আসতে অতিরিক্ত বহন খরচ দিতে হচ্ছে। এতে ক্রেতা সংকট তৈরি হয়েছে। ক্রেতারা না আসলে আমরা কাদের কাছে ব্যবসা করবো। এতে আমরা খুবই সংকটময় সময় পার করছি। কিভাবে দোকান চালাবে, কর্মচারীর বেতন, দোকান ভাড়া ও বিদ্যুৎবিল পরিশোধ করবো তা নিয়ে আছি মহা দুচিন্তায়।

তিনি অন্তত জ্বালানি তেলেরসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমাতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে আহ্বান জানান।
 
শুধু তারা নয়- সারাদেশের মানুষের মতো সিলেটের লোকজন করোনা ও বন্যার ধাক্কার পর এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ঊর্ধ্বগতির কারণে নানান ভোগান্তিতে আছেন। 

সর্বশেষ কোনো ধরনের পূর্বঘোষণা ছাড়াই গত শুক্রবার (৫ আগস্ট) দিনগত রাত ১২টার পর ডিজেল, পেট্রল, কেরোসিন ও অকটেনের দাম বাড়িয়েছে সরকার। প্রতি লিটার ডিজেলে ৩৪ টাকা, কেরোসিনে ৩৪ টাকা, অকটেন ৪৬ টাকা, পেট্রলে বাড়ানো হয়েছে ৪৪ টাকা।
ভোক্তাপর্যায়ে আগে খুচরামূল্য ছিল প্রতি লিটার ডিজেল ৮০ টাকা, কেরোসিন ৮০ টাকা, অকটেন ৮৯ টাকা ও পেট্রল ৮৬ টাকা। বর্ধিত দামে বর্তমানে প্রতি লিটার ডিজেল ১১৪ টাকা, কেরোসিন ১১৪ টাকা, অকটেন ১৩৫ টাকা ও পেট্রল ১৩০ টাকা।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে শনিবার (৬ আগস্ট) গণপরিবহনে ভাড়া বাড়িয়ে সমন্বয় করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। যেখানে মহানগরে প্রতি কিলোমিটারে বাস ও মিনিবাসে ভাড়া ৩৫ পয়সা এবং দূরপাল্লার বাসে কিলোমিটারে ৪০ পয়সা বাড়িয়েছে সরকার। বর্ধিত ভাড়া অনুযায়ী, মহানগরে প্রতি কিলোমিটারে বাসে ২ টাকা ৫০ পয়সা, মিনিবাসে ২ টাকা ৪০ পয়সা ভাড়া দিতে হচ্ছে। দূরপাল্লার বাসে কিলোমিটারপ্রতি যাত্রীদের ভাড়া গুণতে হচ্ছে ২ টাকা ২০ পয়সা।


সিলেটভিউ২৪ডটকম / মুন্না / ডালিম