দেশে উৎসব করে বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার রেওয়াজ শুরু হয় ২০১০ সালে। তবে গত শিক্ষাবর্ষের শুরুতে বই বিতরণ শুরু করা গেলেও সব শিক্ষার্থীর হাতে বই দেওয়ার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়নি। বই ছাপানোর কার্যাদেশ দিতে দেরি করাসহ তিনটি কারণে এবারও সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে মানসম্মত বই তুলে দেওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে মাত্র সাড়ে তিন মাস বাকি। কিন্তু জাতীয় শিক্ষা শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) এবং মুদ্রণকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপানোর কার্যাদেশই দিতে পারেনি এনসিটিবি।


নতুন বছরের জন্য ৩৪ কোটি ২ লাখ ৪০ হাজার বই ছাপানো হচ্ছে। এর মধ্যে মাত্র ২ লাখ ৪০ হাজার (ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় রচিত বই) ছাপানোর কার্যাদেশ দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

আবার বই ছাপার কাজ পেতে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে গড়ে ২২ থেকে ২৫ শতাংশ কম দাম দিয়েছেন মুদ্রণকারীরা। যদিও কাগজ, কালি ও কাগজ তৈরির মণ্ডের (পাল্প) দাম বাড়তির দিকে। এ দুটি কারণেও মানসম্মত বই ছাপানো নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এনসিটিবির কর্মকর্তা ও মুদ্রণকারী উভয়েরই আশঙ্কা, কার্যাদেশ দিতে বিলম্বসহ তিন কারণে সময়মতো মানসম্মত বই ছাপিয়ে আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে বিতরণ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে।

এর মধ্যেই আবার কার্যাদেশ শুরুর আগেই মুদ্রণকারীদের পক্ষ থেকে দাবি-দাওয়া দেওয়া শুরু হয়েছে। দরপত্র অনুযায়ী মোট সময়ের প্রথমভাগে ৫০ শতাংশ এবং বাকি ৫০ শতাংশ বই পরের ভাগে দেওয়ার কথা থাকলেও এখন মুদ্রণকারী চাইছেন এই শর্ত না রাখতে। অতীতেও দেখা গেছে, শেষ সময়ে কিছুসংখ্যক মুদ্রণকারী নানা ফন্দিফিকির করে নিম্নমানের কাগজে বই দেয়। এবারও একই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তবে শঙ্কা থাকলেও সময়মতো মানসম্মত বই দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম।

তিন শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের বই
আগামী ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য মাধ্যমিক স্তরের প্রায় সাড়ে ২৩ কোটি এবং প্রাক্-প্রাথমিকসহ প্রাথমিক স্তরের জন্য প্রায় সাড়ে ১০ কোটি বই ছাপানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে এনসিটিবি। এবার প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণি এবং মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই ও শিক্ষক গাইড দেওয়া হচ্ছে। বাদবাকি শ্রেণিগুলোর জন্য পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে বই ছাপানো হবে।

২০১০ সাল থেকে শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন উৎসব করে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে পাঠ্যবই তুলে দিচ্ছে সরকার। কিন্তু করোনার কারণে গত দুই বছর সে উৎসব হয়নি। এর মধ্যে আবার চলতি শিক্ষাবর্ষে বছরের শুরুতে সব শিক্ষার্থীর হাতে সব পাঠ্যবই তুলে দিতে পারেনি এনসিটিবি। ফেব্রুয়ারি-মার্চেও কোনো কোনো মুদ্রণকারী বই দিয়েছিল। বইয়ের কাগজের মান নিয়েও অভিযোগ উঠেছিল। এবারের পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

কার্যাদেশই দিতে পারেনি এনসিটিবি
বই ছাপার কাজের দরপত্র হয় লটের মাধ্যমে। এবার মাধ্যমিক স্তরে একটি অংশে ২৮০টি লটে বই ছাপা হবে। এতে অষ্টম, নবম শ্রেণি, দাখিল এবং কারিগরি স্তরে ১২ কোটি ৫১ লাখের বেশি বই ছাপানোর কথা। এসব বই ছাপার বিষয়ে দরপত্রের কাজ শেষ করে মূল্যায়নের কাজ শেষ করে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদন হলেও এখনো কার্যাদেশ দেওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনটিসিবির এক কর্মকর্তা গতকাল দুপুরে বলেন, সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদনের পর এ বিষয়ে আবার সরকারের শীর্ষ মহলের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। গতকাল দুপুর পর্যন্ত সেটি তাঁরা হাতে পাননি।

নিয়মানুযায়ী এনসিটিবি দরপত্রের কাজ শেষ করে সেটি মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেখানে মূল্যায়ন করে অনুমোদন দেওয়ার পর তা সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদন নিতে হয় এবং সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অনুমোদন লাগে। এরপর নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানকে নোটিফিকেশন অ্যাওয়ার্ড তথা কার্যাদেশ দেওয়া হয় এবং ২৮ দিনের মধ্যে চুক্তি করতে হয়। যেদিন থেকে চুক্তি হবে, সেদিন থেকে বই ছাপার জন্য দেওয়া নির্ধারিত সময় শুরু হয়।

এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, এসব লটে ৭০ দিনের মধ্যে বই ছাপানোর জন্য সময় দেওয়া হচ্ছে। এনসিটিবি গত মাসে যে প্রাক্কলন করেছিল, তাতে হিসাব করে দেখেছিল, ওই ২৮০টি লটের বই ছাপিয়ে সরবরাহ করতে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। কিন্তু এখনো কার্যাদেশ না হওয়ায় কোনো কারণে কিছুটা ওদিক-ওদিক হলেই বড় ধরনের সমস্যা তৈরির আশঙ্কা আছে।

এনসিটিবির এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি মাথায় রেখে ৫০ শতাংশ বই ৪০ দিনে এবং বাকি অর্ধেক বই ৩০ দিনে সরবরাহ করতে বলা হচ্ছে।


তবে সর্বশেষ জানা গেছে, এনসিটিবির কাছে দুই ভাগে বই দেওয়ার শর্তটি বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন মুদ্রণকারীরা। অর্থাৎ তাঁরা চাইছেন পুরো সময়ের (৭০ দিন) মধ্যে বই দিতে।

মাধ্যমিক স্তরের অপর অংশে ১৮২টি লটে ১১ কোটির মতো বই ছাপা হবে। এসব লটের বই ছাপানোর জন্যও আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করে কার্যাদেশ দেওয়া যায়নি। এসব বই ছাপাতে ৫০ দিন সময় ধরা হয়েছে। এনসিটিবির হিসাব অনুযায়ী, আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করে চুক্তি মিলিয়ে আগামী ২৩ ডিসেম্বরের মধ্যে বই ছাপা সম্ভব হবে।


আর প্রাথমিক স্তরের বইগুলোর তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই ছাপার কাজ ক্রয় কমিটিতে অনুমোদন হলেও পরবর্তী ধাপ শেষ না হওয়ায় এসব বই ছাপার কার্যাদেশ দেওয়া যায়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনসিটিবির এক কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত বছরের মে মাস থেকেই দরপত্রের প্রক্রিয়া শুরু হতো। কিন্তু এ বছর এনসিটিবির চেয়ারম্যান পদ শূন্য থাকা–সংক্রান্ত জটিলতার জেরে এ দরপত্রের প্রক্রিয়াটিই শুরু হয় অন্তত তিন মাস পর। এরপর আবার মূল্যায়নসহ আনুষঙ্গিক কাজগুলো শেষ করতেও দেরি হচ্ছে।

নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানোর আশঙ্কা
বিলম্বে কার্যাদেশ ও চুক্তি হলে শেষ সময়ে নিম্নমানের কাগজে বই দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এনসিটিবির এক কর্মকর্তা বলেন, এ নিয়ে তাঁরা ‘বেকায়দায়’ আছেন।

মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, এবার কয়েকটি কারণে সময়মতো ভালো মানের বই দেওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রথমত, এবার বই ছাপার কাজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেই দেরি করা হয়েছে। অন্যান্য সময়ে সেপ্টেম্বর থেকে বই সরবরাহ করা শুরু হয়ে যেত। কিন্তু এবার এখনো কার্যাদেশই দেওয়া সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, গতবার গড়ে ৯৬ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল বই ছাপানোর জন্য। সেখানে এবার কোনোটির ৫০ দিন, কোনোটির ৭০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। এই সময়ে মানসম্মত বই ছাপা একেবারেই কঠিন কাজ। এ শঙ্কা আরও বেড়েছে বৈশ্বিক সংকটের কারণে কাগজ, কাগজ তৈরির মণ্ডের দামও অনেক বেশি হওয়ায়।

তোফায়েল খান বলেন, গতবার দেরি করে বই দেওয়ায় ২৮টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার জন্য যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ ছিল এবং মুদ্রণ শিল্প সমিতি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে শেষ সময়ে এবার আরও বেশি নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানোর আশঙ্কা আছে।

এনসিটিবির চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলামও এমন আশঙ্কার কথা অস্বীকার করেননি। তবে তিনি বলেন, এটা ঠিক যে তাঁরা সময়ের চেয়ে পিছিয়ে আছেন। এ জন্য কিছুটা আশঙ্কা থাকলেও তাঁরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন যাতে সময়মতো মানসম্মত বই দেওয়া যায়। মুদ্রণকারীরাও সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/প্রআ/ইআ-০৭