মহান আল্লাহ বিশ্বজগতের সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, লালনকর্তা ও পালনকর্তা। তিনি সমুদয় বস্তুর মালিক ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সত্তা, স্বকীয়তা, গুণ, কর্ম ও ক্ষমতায় তাঁর সমপর্যায়ের কেউই নেই, তিনি লা শরিক। দৃশ্য ও অদৃশ্য জগতের সব কিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন।

আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোন উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সর্বদা রক্ষণাবেক্ষণকারী। তাঁকে তন্দ্রা ও নিদ্রা স্পর্শ করে না। আকাশমন্ডলে ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, তাঁরই। কে সেই ব্যক্তি যে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর নিকট সুপারিশ করে? তিনি লোকদের সমুদয় প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অবস্থা জানেন। পক্ষান্তরে মানুষ তাঁর জ্ঞানের কোনকিছুই আয়ত্ত করতে সক্ষম নয়, তিনি যে পরিমাণ ইচ্ছে করেন সেটুকু ছাড়া। তাঁর কুরসী আকাশ ও পৃথিবী পরিবেষ্টন করে আছে এবং এ দুয়ের রক্ষণাবেক্ষণ তাঁকে ক্লান্ত করে না, তিনি উচ্চ মর্যাদাশীল, মহান।


মানবজাতির প্রতি মহান রবের নির্দেশনা, তোমরা আমার শ্রেষ্ঠত্ব ও কৃতজ্ঞতা ঘোষণা করো। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক বলেন, তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করব। আর তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং অকৃতজ্ঞ হয়ো না। (সুরা বাকারাহ, আয়াত ১৫২)

আর আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন। (সুরা মুদ্দাসসির, আয়াত ৩)

বিশ্ব ইতিহাসে প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী হিসাবে আল্লাহ পাক আদম (আলাইহিস সালাম)-কে নিজ দু’হাত দ্বারা সরাসরি সৃষ্টি করেন। (সুরা ছোয়াদ, আয়াত ৭৫)

মাটির সকল উপাদানের সার-নির্যাস একত্রিত করে আঠালো ও পোড়ামাটির ন্যায় শুষ্ক মাটির তৈরি সুন্দরতম অবয়বে রূহ ফুঁকে দিয়ে আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করেছেন।
আদি পিতা আদম (আঃ)-কে আল্লাহ সর্ব বিষয়ের জ্ঞান ও যোগ্যতা দান করেন এবং বিশ্বে আল্লাহর খেলাফত পরিচালনার মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। সাথে সাথে সকল সৃষ্ট বস্তুকে করে দেন মানুষের অনুগত (সুরা লোকমান, আয়াত ২০) ও সবকিছুর উপরে দেন মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। (সুরা ইসরা, আয়াত ৭০)

জিন-ফেরেশতা সবাইকে মানুষের মর্যাদার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য আদমকে সিজদা করার আদেশ দেন। সবাই সে নির্দেশ মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ইবলিস অহংকার বশে সে নির্দেশ অমান্য করায় চিরকালের মত অভিশপ্ত হয়ে যায় (সুরা বাক্বারাহ, আয়াত ৩৪)। অথচ সে ছিল বড় আলেম ও ইবাদতগুযার। এই কারণে সে জিন জাতির হওয়া সত্ত্বেও সে ফেরেশতাদের সঙ্গে বসবাস করার অনুমতি পেয়েছিল ও তাদের নেতা হয়েছিল। কিন্তু আদমের উচ্চ মর্যাদা দেখে সে ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে। ফলে অহংকার বশে আদমকে সিজদা না করায় এবং আল্লাহ ভীতি না থাকায় সে আল্লাহর গযবে পতিত হয়।

আসমানি ধর্মগুলোর (ইসলাম, খ্রিস্টান ও ইহুদি) বিশ্বাস হলো, পৃথিবীর সব মানুষ আদম (আ.)-এর বংশধর। পবিত্র কোরআনে আল্লাতায়ালা বলেন, হে মানুষ, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তা থেকে তাঁর স্ত্রী সৃষ্টি করেন, যিনি তাদের দুজন থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দেন। (সুরা নিসা, আয়াত ১)

মহান আল্লাহ তার বান্দার নিকট তার পূর্ণজ্ঞান, ক্ষমতা ও মহত্ব প্রমাণ করার জন্য এই মহাজগৎ সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি এই মহাজগতের সবকিছুকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, সবকিছুই তাদের প্রতিপালকের প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা করে। মানুষ যখন এই বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারবে, তখন তার প্রতিপালকের ইবাদতের দিকে ধাবিত হবে, যিনি একক এবং যার কোন শরীক নেই। আর সে মহান আল্লাহ ও তার রাসুলগণের আনুগত্যের মাধ্যমে মহান আল্লাহর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সক্ষম হবে। সাথে সাথে সে আল্লাহর পূর্ণ দাসত্ব ও আনুগত্যে অন্যান্য সৃষ্টির সাথেও অংশগ্রহণ করতে পারবে।

আল্লাহতায়ালা বলেন, তিনি আল্লাহ, যিনি সাত আসমান এবং অনুরূপ যমীন সৃষ্টি করেছেন; এগুলোর মাঝে তাঁর নির্দেশ অবতীর্ণ হয়, যেন তোমরা জানতে পার যে, আল্লাহ সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান এবং আল্লাহর জ্ঞান সবকিছুকে বেষ্টন করে আছে। (সুরা আত-তালাক্ব, আয়াত ১২)

আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, আর আমি জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদত করবে। আমি তাদের কাছে কোন রিজিক চাই না; আর আমি চাই না যে, তারা আমাকে খাবার দিবে। নিশ্চয় আল্লাহই রিজিকদাতা, তিনি শক্তিধর, পরাক্রমশালী। (সুরা আয-যারিয়াত, আয়াত ৫৬-৫৮) আল্লাহতায়ালাকে ভয় করুন। তাঁরই পবিত্রতা বর্ণনা করুন। তাঁর গুণগান ও প্রশংসা করুন। জেনে রাখুন, একমাত্র আল্লাহই বিজয় ও সাহায্যদানকারী। দ্বীনের পথে বিজয় ও সাফল্য অর্জনে মহান প্রভুর সাহায্য কামনা করুন।

মহান আল্লাহতায়ালা মানবজাতির দুনিয়া ও আখেরাতে শান্তি, কামিয়াবি ও সফলতা রেখেছেন একমাত্র দ্বীনের মধ্যে। মৃত্যুর পর প্রতিটি মানুষকে তিনটি প্রশ্ন করা হবে। তোমার রব কে, তোমার নবী কে এবং তোমর দ্বীন কী? ঈমানদাররা শুধুই কবরে এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন। আমার রব আল্লাহ, নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং দ্বীন হলো ইসলাম। এখানে দ্বীন বলতে, আল্লাহর নির্দেশিত জীবনব্যবস্থা বা ইসলাম ধর্ম। আল্লাহর হুকুম মেনে চলা এবং নবী করিম (সা.)কে অনুসরণ করার মাধ্যমেই আল্লাহতায়ালা মানুষের দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা রেখেছেন।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট ইসলামই হচ্ছে একমাত্র মনোনীত দ্বীন (আনুগত্যের বিধান বা জীবন ব্যবস্থা)। (সুরা আল ইমরান, আয়াত ১৯)

মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবন কেমন হবে ইসলাম তার নীতিমালা বর্ণনা করেছে। দুনিয়া-আখেরাতে মানুষের সুখ, শান্তি, সফলতা আল্লাহতায়ালা দ্বীনের মধ্যে রেখেছেন। দ্বীনকে আল্লাহতায়ালা দামি করেছেন। ইসলামে আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে রয়েছে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। দ্বীন মানুষের জন্য মহান আল্লাহর মনোনীত একমাত্র জীবনবিধান। আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে জীবনের চলার পথে সঠিক পথ নির্দেশনা দেওয়ার লক্ষ্যে যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। তাঁর প্রেরিত নবী-রাসুলদের নিকট হেদায়েতের যে বাণী পাঠিয়েছেন, তাকে বলা হয় ওহী। যুগে যুগে প্রেরীত নবী-রাসুলদের মধ্য থেকে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হলেন বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। তাঁর উপর অবতারিত কিতাব কুরআনুল কারীম গোটা মানবজাতির জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। আর রাসুলে কারীম (সা:)-এর যবান নি:সৃত বাণীকে বলা হয় সুন্নাহ বা হাদীস। ওহী বলতে কুরআন ও সুন্নাহ দুটোকেই বুঝানো হয়ে থাকে। কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানব জাতির জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ, মুক্তি ও সফলতা।

যত নবী-রাসুল পৃথিবীতে এসেছেন তাঁদের সবার দ্বীন ছিল ইসলাম যার মূল শিক্ষা হচ্ছে তাওহীদ, রিসালত ও আখিরাত। প্রত্যেক নবী তাঁর জাতিকে তাওহীদের দিকে ডেকেছেন এবং রিসালতে ঈমান এনে আল্লাহর বিধান শিরোধার্য করার আদেশ করেছেন।

পৃথিবীতে মানুষের চলার পথ দুটি। একটি হলো সরল সঠিক পথ বা সিরাতুল মুস্তাকীম। অপরটি গোমরাহীর পথ। এ দু’পথের যে কোনো পথে মানুষ পরিচালিত হতে পারে। এজন্যে পরকালেও জান্নাত এবং জাহান্নাম এ দু’ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। পবিত্র কুরআন গোটা জাতিকে মুমিন এবং কাফির দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করেছে।

মুমিনগণ কিসের ভিত্তিতে জীবন চালাবেন এবং কোনটি তাদের জীবন নির্বাহের পথ, সে বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাই তাঁর আগমনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’-এর পথ দেখানো। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় আপনি প্রেরিত রাসুলগণের একজন। সরল পথে প্রতিষ্ঠিত। (সুরা ইয়াসিন, আয়াত ৩-৪)

হাদিসে জিবরীল খ্যাত ঐতিহাসিক একটি হাদিসে ইসলামের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। একবার নবী (সা.) সবার সামনে উপবিষ্ঠ ছিলেন। তখন আগন্তুকের বেশে জিবরীল (আ.) এসে নবীকে (সা.) কিছু প্রশ্ন করেন। তন্মধ্যে একটি হলো, ‘ইসলাম’ কী? উত্তরে নবী (সা.) বলেন, ইসলাম হলো, তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না, সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, ফরজকৃত বিধান জাকাত প্রদান করবে আর রমজানের সিয়াম পালন করবে। (বুখারি : ৫০)। এখানে ইসলামের পরিচয় দিতে গিয়ে পাঁচটি মূল ভিত্তির কথা বলা হয়েছে যেগুলো ইসলামের স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত।

বিদায় হজের ভাষণে রাসুল (সা.)-এর প্রতি সবিশেষ অহি ছিল দ্বীন হিসেবে ইসলামের পরিপূর্ণতা নিয়ে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের ওপর আমার নেয়ামত পূর্ণ করলাম; আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে নির্বাচন করলাম। (সুরা মায়েদা, আয়াত ৩)

আল্লাহর হুকুমে প্রলয় ঘনিয়ে আসবে এবং ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে। মানুষের দেহগুলো সব মৃত্যুর পরে মাটিতে মিশে যাবে। কিন্তু রূহগুলো স্ব স্ব ভাল বা মন্দ আমল অনুযায়ী ‘ইল্লীন’ অথবা ‘সিজ্জীনে’ অবস্থান করবে (মুত্বাফফেফীন ৮৩/৭, ১৮)। যা ক্বিয়ামতের পরপরই আল্লাহর হুকুমে স্ব স্ব দেহে পুনঃপ্রবেশ করবে (ফজর ৮৯/২৯) এবং চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশের জন্য সকল মানুষ সশরীরে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দরবারে নীত হবে। (মুত্বাফফেফীন ৮৩/৪-৬)

মানুষের ঠিকানা হল তিনটি : ১- দারুদ দুনিয়া। অর্থাৎ যেখানে আমরা এখন বসবাস করছি ২- দারুল বরযখ। অর্থাৎ মৃত্যুর পরে কবরের জগত। ৩- দারুল ক্বারার। অর্থাৎ ক্বিয়ামতের দিন শেষ বিচার শেষে জান্নাত বা জাহান্নামের চিরস্থায়ী ঠিকানা।

পৃথিবী হল মানুষের জন্য সাময়িক পরীক্ষাগার মাত্র। জান্নাত থেকে নেমে আসা মানুষ এই পরীক্ষাস্থলে পরীক্ষা শেষে সুন্দর ফল লাভে পুনরায় জান্নাতে ফিরে যাবে, অথবা ব্যর্থকাম হয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। অতঃপর সেখানেই হবে তাদের সর্বশেষ যাত্রাবিরতি এবং সেটাই হবে তাদের চূড়ান্ত ও চিরস্থায়ী ঠিকানা। আল্লাহ বলেন, মাটি থেকেই আমরা তোমাদের সৃষ্টি করেছি। ঐ মাটিতেই তোমাদের ফিরিয়ে নেব। অতঃপর ঐ মাটি থেকেই আমরা তোমাদেরকে পুনরায় বের করে আনব। (সুরা ত্বোয়াহা, আয়াত ৫৫)

অতঃপর বিচার শেষে কাফেরদেরকে হাঁকিয়ে নেওয়া হবে জাহান্নামের দিকে এবং মুত্তাক্বীদের নেওয়া হবে জান্নাতে (যুমার ৩৯/৬৯-৭৩)। এভাবেই সেদিন যালেম তার প্রাপ্য শাস্তি ভোগ করবে এবং মযলূম তার যথাযথ প্রতিদান পেয়ে ধন্য হবে। সেদিন কারু প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হবে না (সুরা বাক্বারাহ, আয়াত ২৮১)। হাশরের ময়দানে বনি আদমকে পাঁচটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। এই প্রশ্নগুলোর সদুত্তর যারা দিতে পারবে তারা আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের দলে শামিল হয়ে যাবে। আর যারা এর যথাযথ উত্তর দিতে অক্ষম হবে, তারা অবিশ্বাসী কাফিরদের দলভুক্ত হয়ে যাবে। এতদ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে মাসউদ রা. রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, (হাশরের দিন) মানুষের পা একবিন্দু নড়তে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তার নিকট এই পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা না হবে। এক. নিজের জীবনকাল সে কোন কাজে অতিবাহিত করেছে? দুই. যৌবনের শক্তি সামর্থ্য কোথায় ব্যয় করেছে? তিন. ধন সম্পদ কোথা হতে উপার্জন করেছে? চার. অর্জিত ধন সম্পদ কোথায় ব্যয় করেছে? পাঁচ. এবং (দ্বীনের) যতটুকু ইলম অর্জন করেছে সে অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে? (জামে তিরমিযী : ৪/২৪১৬)।

মানুষের এসব প্রশ্নের উত্তর তখনই দেয়া সম্ভব হবে যখন আল্লাহর দেওয়া মনোনীত দ্বীনের উপর অবিচল থাকবে। কারণ দ্বীন হিসেবে ইসলাম নবী (সা.)-এর মাধ্যমে পূর্ণতা পেয়েছে। কিয়ামত পর্যন্ত এটি অটল, অবিকৃত ও অবিচল থাকবে। আর আল্লাহতায়ালা মুমিনদের জন্য দ্বীন হিসেবে ইসলামকে নির্বাচন করে দিয়েছেন। তাই ইসলামের মধ্যে নতুন করে কোনো কিছু তৈরি, পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের সুযোগ নেই। আর ইসলাম কিয়ামত পর্যন্ত একটি সার্বজনীন, জীবন ঘনিষ্ঠ ও শাশ্বত দ্বীন হিসেবে বিবেচিত হবে।

আল্লাহতায়ালা নবী (সা.)-এর মাধ্যমে যে ইসলাম মানব জাতির জন্য নির্ধারণ করেছেন তা ব্যতীত অন্য সব ধর্ম, মতবাদ বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য। ইসলাম ব্যতীত সব পথ ও মত আল্লাহর কাছে মূল্যহীন। কোনো ব্যক্তির যত ভালো কর্মই হোক না কেন তা আর গ্রহণযোগ্য হবে না। আর আখেরাতে সে চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনও তার নিকট থেকে গ্রহণ করা হবে না এবং সে হবে আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা আল ইমরান, আয়াত ৮৫)

আল্লাহ তায়ালা মানব কল্যাণে ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ হিসেবে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ‘ইসলাম’কে নির্বাচন করেছেন। ইসলাম সকল প্রকার সমস্যা ও জটিলতামুক্ত এবং সহজতর একটি দ্বীন। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ব্যাপারে সহজতা চান, জটিল বা কঠিনতা চান না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৫)

ইসলাম উদার ও মানবিকতাসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ দ্বীন। কোনোরূপ সংকীর্ণতা বা বাড়াবাড়ির জায়গা ইসলামে নেই। মানব জাতির বৃহত্তর কল্যাণের নিমিত্তে ইসলামের আগমন। অন্ধকার ও জাহালত থেকে মুক্ত করে মানব জাতিকে সত্যের দিশা দিতে মহামহিম আল্লাহ ইসলামকে নির্বাচন করেছেন। আল্লাহ বলেন, তিনি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোনো সংকীর্ণতা বা কঠোরতা চাপিয়ে দেননি।’ (সুরা হজ, আয়াত ৭৮)

সকল প্রকার প্রান্তিকতামুক্ত উদার ও মধ্যমপন্থাই হলো শ্রেষ্ঠতম পথ। আল্লাহতায়ালা এই দ্বীনকে একটি মধ্যমপন্থি দ্বীন বানিয়েছেন। আর ইসলামের অনুসারীগণ হলো মানবকুলের মধ্যে একমাত্র মধ্যমপন্থি ও সাক্ষ্যদানকারী জাতি। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আর এভাবে আমি তোমাদেরকে এক মধ্যমপন্থি জাতিতে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা মানবজাতির ওপর সাক্ষী হও এবং রাসুল তোমাদের ওপর সাক্ষী হতে পারেন। (সুরা বাকারা, আয়াত ১৪৩)

পৃথিবীর সকল জড়বস্তু ও জীববস্তু আল্লাহর কাছে সমর্পণ করেছে বা ইসলামের উপর রয়েছে। এরপরেও যারা অবিশ্বাস করে ও ইসলাম বাদ দিয়ে অন্য পথ তালাশ করে তাদের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, তারা কি আল্লাহর দ্বীনের পরিবর্তে অন্য দ্বীন তালাশ করছে? অথচ আসমান ও জমিনে যা কিছু রয়েছে স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, তাঁরই অনুগত এবং তাঁর নিকটই ফিরে যাবে। (সুরা আল ইমরান, আয়াত ৮৩)

আল্লাহতায়ালা এ উম্মতকে বাছাই করেছেন এবং মানবতার কল্যাণে তাদেরকে উত্তম উম্মত হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরা হলে সর্বোত্তম উম্মত, যাদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। (সুরা আল ইমরান, আয়াত ১১০)

আল্লাহ সৃষ্টিকুলের রব এবং তিনি মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে সৃষ্টিকুলের জন্যই রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সৃষ্টিকুলের রব। (সুরা আল-ফাতিহা, আয়াত ২)। আল্লাহ বলেন, তিনি বরকতময়, যিনি তাঁর বান্দার উপর ফুরক্বান নাযিল করেছেন, যেন সে জগতবাসীর জন্য সতর্ককারী হতে পারে। (সুরা আল-ফুরক্বান, আয়াত ১)

দ্বীনের দিকে দাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা এ উম্মতকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত সম্মানিত করেছেন। আল্লাহ বলেন, বলুন, ইহাই আমার পথ, আমি ও আমার অনুসারীগণ ডাকি আল্লাহর দিকে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে। আল্লাহ পবিত্র এবং আমি শিরককারীদের অন্তর্ভুক্ত নই। (সুরা ইউসুফ, আয়াত ১০৮) অচিরেই এই দ্বীন সর্বত্র পৌঁছবে, যেমন দিন রাত্রি পৌঁছে। অতঃপর তা অপরিচিত অবস্থায় ফিরে আসবে যেভাবে সূচনা হয়েছিল।

সত্য সেটাই যা আল্লাহ প্রেরিত। আর মিথ্যা সেটাই যা আল্লাহ বিরোধী এবং যাতে প্রবৃত্তির রং মিশ্রিত। সত্য সর্বদা বিজয়ী এবং মিথ্যা সর্বদা পরাজিত। আল্লাহ বলেন, তিনিই তার রাসুলকে প্রেরণ করেছেন হেদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে। যাতে তিনি উক্ত দ্বীনকে সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী করতে পারেন। যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে। (সুরা ছফ, আয়াত ৯)।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, তিনি মহান আল্লাহ! যিনি তাঁর রাসুল (সা.)-কে পাঠিয়েছেন হিদায়াত সঠিক পথনির্দেশ ও সত্য দ্বীন পরিপূর্ণ জীবন বিধানসহকারে, যাতে তিনি তা সকল বিধানের ওপর বিজয়ীরূপে প্রতিষ্ঠা করেন, সাহায্যকারী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। (সুরা-৪৮ ফাত্হ, আয়াত: ২৮)

সফলতা ও বিজয়ের জন্য চাই সৎকর্ম ও সামর্থ্য। এ বিষয়টিও কোরআনে আল্লাহতায়ালা জানিয়ে দিয়েছেন। আর আমি জাবুর কিতাবে লিপিবদ্ধ করেছি, নিশ্চয়ই আমার ভূমির অধিকারী হবে সৎকর্মশীল ও যোগ্য বান্দারা। (সুরা আল আম্বিয়া, আয়াত: ১০৫)

আল্লাহর সাহায্যেই বিজয় আসে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন, তখন আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন; তিনি তো তওবা কবুলকারী। (সুরা নাসর, আয়াত ১-৩)

৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা বিজয়ের পরের বছর অর্থাৎ ৯ম ও ১০ম হিজরীকে ইতিহাসে ‘প্রতিনিধি দলসমূহের আগমনের বছর’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই সময়ে মক্কার কাফিররা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে। মানুষের বিজয়ের বা সাফল্যের জন্য সৃষ্টিকর্তার সাহায্যের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বিজয় মানুষের শক্তিমত্তার ওপর নির্ভর করে না। বিপুল শক্তিশালী দলও যুদ্ধে পরাজিত হয়। অন্যদিকে, দুর্বল দলও আল্লাহর সাহায্যক্রমে জয়ী হতে পারে বদরের যুদ্ধ যার প্রমাণ। শক্তিমত্তা নয়, আল্লাহর সাহায্যই বিজয়ের একমাত্র নিয়ামক।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/ডেস্ক/ইআ-০৪