চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতি বছর বাংলাদেশে নতুন করে দরিদ্র হচ্ছেন প্রায় ৮৬ লাখ মানুষ। এর মধ্যে দফায় দফায় ওষুধের দাম বাড়তি যেন ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে। কেন ওষুধের দাম এভাবে বাড়ছে? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওষুধ উৎপাদন করতে খরচ আগের চেয়ে বেড়েছে। তবে এটিকে কারণ হিসেবে দাঁড় করানো হলেও পেছনের গল্প কিন্তু ভিন্ন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর লাগামহীন প্রমোশন কস্ট (প্রচার খরচ), বিশেষ করে নিজ নিজ ব্র্যান্ডের ওষুধ লেখাতে চিকিৎসকদের পেছনে লাখ লাখ টাকা ব্যয় ওষুধের দাম বৃদ্ধির পেছনে কাজ করছে। এদিকে তাদের দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে নিয়মিত মাসোহারার লোভে অনেক চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে লিখছেন ‘মানহীন’ ও ‘অপ্রয়োজনীয়’ ওষুধ! ফলে সাধারণ মানুষ দুই দিক থেকেই প্রতারিত হচ্ছেন- বেশি দামে ওষুধ কিনছেন, কিন্তু পাচ্ছেন নিম্ন মানের চিকিৎসা ও ওষুধ।


সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রাসী বিপণন নীতি এবং অনেক চিকিৎসকের অসুস্থ মানসিকতা স্বাস্থ্যসেবার পরিবেশ নষ্ট করছে। বেআইনি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে একদিকে যেমন চিকিৎসকদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়াচ্ছে সাধারণ মানুষের চিকিৎসার ব্যয়। এ অবস্থায় চিকিৎসকদের আয়ের খাত এবং ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয়ের খাত কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি ওষুধের জেনেরিক (শ্রেণিগত) নাম দিয়ে ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) চালুর পরামর্শও দেন তারা।

জানা গেছে, ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ৫৮ ভাগ কর্মীই ওষুধের বাজারজাতকরণ (মার্কেটিং) ও বিতরণে কাজ করেন। প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট আয়ের ২৭ ভাগেরও বেশি ব্যয় হয় বিপুল সংখ্যক এ কর্মীর পেছনে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত এ ব্যয়ের কারণে দেশে চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত থাকছেন অন্তত ১৬ শতাংশ রোগী। তারা বলছেন, দেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নেওয়া ৯৭ শতাংশ রোগীই ওষুধ পান না। প্রয়োজনীয় ওষুধ তাদের কিনতে হয় বিভিন্ন ফার্মেসি থেকে। একইভাবে ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা রোগীকে করতে হয় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। ফলে বেড়ে যায় রোগীর ব্যয়। বিশেষ করে ক্যানসার, কিডনি ডায়ালাইসিস ও ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগের চিকিৎসায় নিঃস্ব হচ্ছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা।

দীর্ঘদিন চিকিৎসা চালিয়ে নেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠছে>>

নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বাড়ার এক ধরনের প্রতিযোগিতার মধ্যেই এ বছরের জুলাইয়ে বহুল ব্যবহৃত ৫৩টি ওষুধের দাম বাড়ানো হয়। যেসব রোগী এসব ওষুধ নিয়মিত কেনেন তারা এতে চরম বিপাকে পড়েছেন।

রাজধানীর রামপুরার বাসিন্দা মো. সিরাজুল ইসলাম (৫২) তেমনই একজন। দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন তিনি। প্রতি মাসে চিকিৎসক দেখানো আর ওষুধ কেনাবাবদ তার গুনতে হচ্ছে আট থেকে ১০ হাজার টাকা। স্ত্রী-সন্তানদের চিকিৎসার হিসাব টানলে মাসে এ খাতে ব্যয় দাঁড়ায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এদিকে, নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়তি। ফলে সন্তানদের পড়াশোনা আর সংসার চালাতে নাভিশ্বাস উঠছে তার। দফায় দফায় ওষুধের দাম বাড়ায় চিকিৎসা চালিয়ে নেওয়া এখন কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে তার জন্য।

সিরাজুল ইসলাম বলেন, কেবল আমার ওষুধের পেছনে প্রতি মাসে আট থেকে ১০ হাজার টাকা চলে যায়। পরিবারের অন্য সদস্যরা অসুস্থ হলে কী করব, সন্তানদের পড়াশোনার খরচ কোথা থেকে দেব, মাস চালাব কীভাবে? আমাদের রোজগারই বা কতটুকু? ওষুধ বাদ দিলে আমাকে বিছানায় পড়ে যেতে হবে। তখন সংসারের কী হবে?

সিরাজুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, চিকিৎসক দেখানোর পর ওষুধ কোম্পানির লোকজন সিরিয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে প্রেসক্রিপশন দেখার জন্য। কারণ কী? শুনেছি তারা চিকিৎসকদের অর্থসহ নানা সুবিধা দিচ্ছে। সে অনুযায়ী চিকিৎসকরা তাদের কোম্পানির ওষুধ লিখছেন কি না, সেটা দেখা হয়।কোম্পানিগুলো মাসোহারা হিসেবে লাখ লাখ টাকা খরচ করছে চিকিৎসকদের পেছনে। মাসোহারার এ টাকা কমিয়েও তো ওষুধের দাম কম রাখা যেত।

যাদের মাধ্যমে হয় অর্থের লেনদেন>>

ফার্মাসিউটিক্যালস মার্কেট-সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ব্যবস্থাপত্রে নিজ প্রতিষ্ঠানের ওষুধ লেখার বিষয়ে চিকিৎসকদের নগদ অর্থ দেওয়ার প্রক্রিয়াটি সর্বপ্রথম স্বল্প আঙ্গিকে শুরু করে ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল ও প্যাসিফিক ফার্মা। তাদের ‘ক্রনিক কেয়ার’-এর ওষুধগুলো ব্যবস্থাপত্রে লেখার জন্য চিকিৎসকদের এ সুবিধা দেওয়া হয়।

মানুষ যদি একবার হার্টের ওষুধ খাওয়া শুরু করে, এটা চলতেই থাকবে। ব্লাড প্রেশার, ডায়াবেটিসের ওষুধ একবার খাওয়া শুরু করলে মৃত্যু পর্যন্ত সেটা চলতে থাকবে। ক্রনিক ওষুধগুলো সাধারণত চিকিৎসকরা সহজে লিখতে চান না, যতক্ষণ না তারা নিশ্চিত হন যে ওষুধগুলো যথেষ্ট কার্যকর। এ অবস্থায় নির্বাচিত কিছু চিকিৎসকের সঙ্গে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি যোগাযোগ করেন এবং টাকার বিনিময়ে তাদের হাত করে ফেলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, আজ থেকে ১৫ বছর আগে সারা দেশে ২০ জনের বেশি এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট ছিলেন না। তাদের সবাইকে হাত করে ফেলল প্যাসিফিক ফার্মা। কার্ডিয়াক প্রোডাক্টসের জন্য কার্ডিওলজিস্টদের হাত করে ফেলল ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল। ১৯৯৯ সালে ইনসেপটা ফার্মা যখন বাংলাদেশে এলো তখন তারা সাধারণভাবে গড়পরতা সব চিকিৎসককে টাকা দেওয়ার প্রচলন শুরু করল। ধীরে ধীরে সব প্রতিষ্ঠান এদিকে ঝুঁকতে থাকল।

‘লেনদেনের বিষয়টি (চিকিৎসকদের অর্থ দেওয়া) আরও ব্যাপক মাত্রা পায় ২০০৬/২০০৭ সালের দিকে। এ সময় ইনসেপটার একটা গ্রুপ অপসোনিনে চলে আসে। তারা ইনসেপটাকে টপকাতে চিকিৎসকদের দ্বিগুণ টাকা দেওয়া শুরু করে। অসুস্থ এ প্রতিযোগিতার ফলে বর্তমানে একজন চিকিৎসকের সঙ্গে একটি ওষুধ কোম্পানির মাসিক চুক্তি দাঁড়ায় লক্ষাধিক টাকায়!’

চিকিৎসকদের মাসোহারা দেওয়া প্রসঙ্গে ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের মিডিয়া কনসালটেন্ট জাহিদ রহমান বলেন, কোনো ওষুধ কোম্পানি যদি চিকিৎসকদের সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, সেটা অনৈতিক। আমার জানা মতে ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালসের এমনটি করার কথা নয়।

কোম্পানির প্রমোশন সিস্টেম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভালো বলতে পারবেন। তবে আমি যতটুকু বলতে পারি, আমাদের কোম্পানি চিকিৎসকদের নানা সাইন্টিফিক সেমিনারে অংশ নেয়, সহায়তা করে। এটা আমাদের প্রমোশনের বড় মাধ্যম।

চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ খোদ চিকিৎসকদেরই>>

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আশরাফুল হক বলেন, চিকিৎসকদের এমন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আগে যখন শুনতাম তখন খুব বিব্রত হতাম। কিন্তু এখন আর হই না। কারণ, আমাদের আসলে লাজলজ্জা চলে গেছে। বলতে খারাপ শোনালেও সত্য, আমরা এতটাই নগ্ন হয়ে গেছি যে, ওষুধ কোম্পানিগুলো এখন আমাদের কোনো মূল্যই দেয় না। আমার কলিগ তো তাদের কাছে সোল্ড-আউট (বিক্রি হয়ে গেছে) হয়ে গেছে; তাহলে আমাকে মূল্য দিয়ে তাদের লাভ কী?

‘এমনও দেখেছি, ওষুধ কোম্পানিগুলো আমাদের অধ্যাপকদের ছেলে-মেয়েদের বিয়ের খরচ পর্যন্ত দেয়। বিদেশে বেড়াতে যাওয়ার টিকিট দেয়, বিদেশে বিভিন্ন কনফারেন্সে যাওয়ার খরচ দেয়। এভাবে আসলে তারা কোম্পানিগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে যাচ্ছেন। এটা এখন অনেকটা ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। কোনোভাবেই এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।’

কীভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চিকিৎসকদের অনৈতিক চুক্তি হয়— জানতে চাইলে আশরাফুল হক বলেন, “চিকিৎসকভেদে কোম্পানিগুলোর চুক্তি ভিন্ন হয়। এক্ষেত্রে যার রোগী বেশি, তার অর্থের অ্যামাউন্ট ও সুযোগ-সুবিধা বেশি। যাদের একটু কম, তাদের সুযোগ-সুবিধাও কম। যেমন- আমরা শুনেছি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের একজন অধ্যক্ষের বাসায় লিফটের ব্যবস্থা করে দিয়েছে একটা ওষুধ কোম্পানি। এভাবে চিকিৎসকদের পেছনে ওষুধ কোম্পানিগুলোর ‘লালন-পালনে’ যে খরচ সেটা ওষুধের দামের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এর ভুক্তভোগী কিন্তু আমি নিজেও। কারণ, আমি যখন প্রেশারের ওষুধ কিনতে যাই তখন দেখি এর দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। এটা নিশ্চয়ই আমার কোনো না কোনো কলিগের অবদানের কারণেই হচ্ছে!”

অনৈতিক এ সুবিধা বন্ধে করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘করণীয় একটাই। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এমন আইন করতে হবে যাতে ওষুধ কোম্পানিগুলো কোনো চিকিৎসককে কোনো ধরনের অনৈতিক সুবিধা দিতে না পারে। যদি কিছু দিতে হয় সেটা অবশ্যই প্রকাশ্যে দিতে হবে। আমরা দেখি, অনৈতিক এসব আর্থিক লেনদেন হচ্ছে অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে। এটা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।’

‘আমি যে স্টেম সেল নিয়ে কাজ করি, এর একেকটি ইনজেকশনের দাম বাজারে ৩২০০ টাকা। কোম্পানির দাম হচ্ছে ২২৫০ টাকা। তার মানে, দামে এক হাজার টাকা তফাত। এই এক হাজার টাকা কোথায় যায়? সেই চিকিৎসক, যিনি ইনজেকশনটা লিখবেন! আমি যদি ব্যবস্থাপত্রে এই ইনজেকশন লিখি, ওই টাকাটা ওষুধ কোম্পানি আমাকে পাঠিয়ে দেবে। তার মানে, আমি যদি দৈনিক পাঁচটা রোগীকে পাঁচটা ইনজেকশন দিই, আমার লাভ পাঁচ হাজার টাকা। একজন চিকিৎসক যখন এমন সুবিধা পাবেন, রোগীর চেয়ে টাকার লোভটা তার বেশি থাকবে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনের বাইরে রোগীকে ইনজেকশন দিতে দ্বিধা করবেন না তিনি!’

‘আমি আমার রোগীর জন্য নিজের পছন্দের ওষুধ দেওয়ার যেহেতু ক্ষমতা রাখি, সেক্ষেত্রে এসব বিষয় চলে আসবে। যদি এটা বন্ধ করতে হয়, তাহলে ওষুধের জেনেরিক (শ্রেণিগত) নাম দিয়ে প্রেসক্রিপশন দেওয়ার সিস্টেম চালু করতে হবে। তখন প্রতিষ্ঠান থেকে চিকিৎসকের টাকা খাওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। কারণ, রোগী তখন বাইরের দেশের মতো সরাসরি জেনেরিক ওষুধ কিনবে। আমার কোনো অপশন থাকবে না কোম্পানি চয়েস করে ওষুধ দেওয়ার।’

সরব বাংলাদেশি-মার্কিন চিকিৎসক>>

ডা. রুমি আহমেদ খান, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন চিকিৎসক। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে অবস্থিত রিজিওনাল মেডিকেল সেন্টারে মেডিসিনের (রেসপিরেটরি ও আইসিইউ) সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। চিকিৎসকদের অনৈতিকতা প্রসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

ফেসবুকে তিনি লেখেন- “ব্যাপারটা নিয়ে আমি আগেও লিখেছি, আবারও লিখছি। আমাদের হেলথ সেক্টর নিয়ে সমালোচনা করাটা আমার চিকিৎসক বন্ধু-বান্ধব ও স্বজনরা ভালোভাবে নেন না তা জানি। কিন্তু আমার ডাক্তার বন্ধুরা রাগ করবেন বা সোশ্যাল মিডিয়াতে আমাকে আক্রমণ করবেন— এই শঙ্কাগুলো আমাকে নিবৃত করতে ব্যর্থ হচ্ছে এসব নিয়ে লেখালেখিতে। আমাদের হেলথ সেক্টরে একটা বড় সমস্যা হচ্ছে- পলিফার্মেসি; ডাক্তারদের অতিরিক্ত ওষুধ প্রেসক্রাইব করার প্রবণতা। কম (একটা বা দুইটা) ওষুধ অনেক চিকিৎসকই লিখতে পারেন না, বিশেষ করে জুনিয়ররা। রোগী একটা পেলেই হলো…। ১, ২, ৩, ... নম্বর দিয়ে দিয়ে কম করে আট থেকে ১০টা ওষুধ, এমনকি অনেক সময় বয়স্ক/ক্রনিক রোগীদের ক্ষেত্রে ২০-২৫টা ওষুধও তারা লিখে দেন।

হাসপাতাল/ক্লিনিকে ভর্তি হওয়া রোগীর তো আরও খারাপ অবস্থা। প্রতিটা সম্ভাব্য সমস্যার জন্য চারটি করে ওষুধ। অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি ৪০টা পর্যন্ত ওষুধ! সম্প্রতি একজন ৫৮ বছর বয়সী অসুখ-বিহীন মহিলা খুলনার এক ক্লিনিকে ভর্তি হন উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে। ব্লাড প্রেশার ২২০/১০৫ এর মতো, যদিও প্রথম দিনে তা কন্ট্রোলে চলে আসে। এরপরও রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি রেখে মনিটর করা হলো আরও পাঁচ দিন। টেস্ট তো তেমন কিছু না, কিছু মামুলি ব্লাড টেস্ট আর ইসিজি যা পুরোপুরি নরমাল। ডিসচার্জের সময় তাকে লিস্ট করে আট-নয়টা ওষুধ ধরিয়ে দেয়া হলো। ওষুধগুলো হলো- ক্লোপিডিগ্রল, এসপিরিন, নাইট্রোগ্লিসারিন, ওমিডন, ডেক্সিলেন্ড, মেটোপ্রোলল, এম্লডিপিন+ওলমেসার্টেন, মেটাকার্ড এমআর, রসুভাসটাটিন। অথচ ভদ্রমহিলার না আছে চেস্ট পেইন, না আছে হার্টের সমস্যা বা পেটের সমস্যা।”

চিকিৎসকরা কেন এসব করছেন?

অপ্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া প্রসঙ্গে ডা. রুমি আহমেদ বলেন, রোগীরা চিকিৎসকের কাছে ফলোআপ করান না। ওষুধ একবার কাজ না করলে অন্য চিকিৎসকের কাছে চলে যান। ফলে তার জন্য এক-একটা ওষুধের থেরাপিউটিক ট্রায়ালের কোনো সুযোগ থাকে না। সুতরাং, একজন রোগী আসা মানে চিকিৎসকের হাতযশের চান্স একটাই। যে কারণে যা যা ওষুধ মাথায় আসে আর যে কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ বেশি আসে, সব লিখে দেওয়া।

‘দ্বিতীয় কারণটা বলা একটু রিস্কি। কারণ, আমার চিকিৎসক বন্ধুরাই আমার ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। তবুও বলছি। আমাদের দেশের চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন হ্যাবিট পুরোপুরি ওষুধ কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভের কন্ট্রোলে। এই যে রোগীমাত্রই ১০টা থেকে ৩০টা ওষুধের পলিফার্মেসি প্রেসক্রিপশন, এগুলো পুরোপুরি ওষুধ কোম্পানিগুলোর সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভদের প্ররোচনা ও নানামুখী প্রলোভন আর চাপের মুখে হয়।’

‘এই পলিফার্মেসি শুধুমাত্র রোগীর সিরিয়াস শারীরিক ক্ষতি করছে, তা-ই নয়; চিকিৎসাসেবার ব্যয় ১০ গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। গত তিন যুগে ওষুধ কোম্পানিগুলোর মার্কেটিং প্র্যাকটিস অসম্ভব আগ্রাসী (অ্যাগ্রেসিভ) হয়েছে। এই অ্যাগ্রেসিভ সেলস ক্যাম্পেইন এখনই কন্ট্রোল করতে হবে। তাদের রেগুলেশনের (প্রবিধান) আওতায় আনতে হবে। এ ব্যাপারে একটা মোরাটোরিয়াম (আইন প্রয়োগপূর্বক স্থগিত রাখা) জরুরি দরকার’— যোগ করেন প্রবাসী এ চিকিৎসক।

কোন চিকিৎসক কত নিচ্ছেন, যেভাবে লেনদেন>>

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেনেটা ফার্মাসিউটিক্যালসের এক মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ বলেন, সাধারণত যে চিকিৎসকের রোগী বেশি, তার সুযোগ-সুবিধাও বেশি। এক্ষেত্রে যারা বড় মাপের প্রফেসর, তাদের সঙ্গে একটা ওষুধ কোম্পানির মাসিক ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত চুক্তি হয়। যারা একেবারে নতুন তারা পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা নেন। তবে, সব ওষুধ কোম্পানি একরকম দেয় না। আমাদের কোম্পানি সর্বোচ্চ ২০ হাজার এবং সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা দেয়।

আপনাদের প্রতিষ্ঠান থেকে মাসোহারা নেন এমন চিকিৎসকের সংখ্যা কত— জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব চিকিৎসক এ চুক্তিতে আসেন না। যাদের লোভ বেশি, পরিবারের চাহিদা বেশি, তারাই চুক্তিতে আসেন। অনেক চিকিৎসক আছেন যাদের অফার করতে হয় না বরং তারা নিজেরাই খোঁজ নিয়ে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। অনেক চিকিৎসক সরাসরি আমাকে অফার করেছেন, আমি আপনাদের কোম্পানির এ ওষুধ নিয়মিত লিখব, আপনি আমাকে মান্থলি (মাসিক) ২০ হাজার টাকা দেবেন। সবমিলিয়ে মোটাদাগে যদি বলি, ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ চিকিৎসক ওষুধ কোম্পানিগুলো থেকে টাকা-পয়সা বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নেন। বাকি যারা আছেন, তাদের কাছে কোনো অফার দেওয়া যায় না।

চিকিৎসকদের সঙ্গে লেনদেন কীভাবে এবং কাদের মাধ্যমে হয়— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরাই মূলত মাধ্যম হিসেবে কাজ করি। চুক্তি হয় আমাদের ঊর্ধ্বতন বসদের মাধ্যমে, বিশেষ করে এরিয়া বা রিজিওনাল সেলস ম্যানেজারের মাধ্যমে। আমরা যখন চিকিৎসকদের কাছে যাই, তখন তারাই বলেন, আপনার ঊর্ধ্বতন বা বসকে নিয়ে আসেন, কথা বলব।’

টাকার পাশাপাশি আছে এসি, গাড়ি ও লিফট>>

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের মার্কেটিং বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন পদ্ধতিতে চিকিৎসকদের টাকা দেওয়া হয়। কাউকে মান্থলি (মাসিক) কাউকে ইয়ারলি (বার্ষিক) দেওয়া হয়। আবার কিছু আছে নির্দিষ্ট কন্টাক্ট। এর বাইরে বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে কোম্পানিগুলো বড় অঙ্কের টাকা স্পন্সর করে। সব টাকা খরচ হয় না। বাকি টাকা অয়োজক চিকিৎসকদের পকেটে যায়।

‘শুধু টাকা নয়, চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত অনেক সার্ভিসও দেওয়া হয়। এসি, গাড়ি, এমনকি বাড়ির লিফটও উপহার দেওয়া হয়। ধরুন, কোনো একজন চিকিৎসক সিলেট থেকে ঢাকায় আসছেন। এক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানিগুলো ওনাকে আসা-যাওয়ার টিকিট স্পন্সর করে। টিকিট দেওয়ার কারণে ওই চিকিৎসক পরবর্তীতে অন্য কোনো কোম্পানির ওষুধ না লিখে স্পন্সর দেওয়া কোম্পানির ওষুধ লেখেন। এক্ষেত্রে অন্যায়টা হবে তখন যখন ওষুধটা রোগীর প্রয়োজন নয় কিন্তু ব্যবস্থাপত্রে দেওয়া হবে’- জানান ওই বিপনন কর্মকর্তা।

নীতিনৈতিকতার জায়গা নষ্ট হচ্ছে : কাওসার খান

চিকিৎসকদের টাকা বা উপহার দেওয়ার বিষয়টি কতটা যৌক্তিক— জানতে চাওয়া হয় নভো হেলথ কেয়ার অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাওসার খানের কাছে। তিনি বলেন, আমরা চিকিৎসকদের টাকা দেওয়ার প্র্যাকটিসে যাই না। আমাদের এত সামর্থ্যও নেই। কোনো চিকিৎসককে মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়াটা আমাদের জন্য সহজ বিষয় নয়। এতে শুধু আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি না, নীতিনৈতিকতার জায়গাটাও নষ্ট হচ্ছে।

‘চিকিৎসকদের টাকা বা উপহার দেওয়া কতটুকু ইথিক্যাল? যুক্তরাষ্ট্রে এটা নিয়ে এখনও সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হয়। তাদের আলাদা একটা ইথিক্যাল বোর্ড আছে। একজন চিকিৎসক যদি ওষুধ কোম্পানি থেকে একটা লিটারেচারও নেয়, সেটা নিয়ে কিন্তু অনেক বিতর্ক হয়। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ওষুধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে একজন চিকিৎসকের কোনো অ্যাটাচমেন্ট থাকতে পারে না’- বলেন কাওসার খান।

কোম্পানিগুলোর মধ্যে তৈরি হচ্ছে প্রতিযোগিতা

এমন অনৈতিক কাজে ওষুধ কোম্পানিগুলোর মধ্যে টাকা খরচের প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে কি না– জানতে চাইলে কাওসার খান বলেন, ‘সেটা তো হচ্ছেই। ধরুন, একজন চিকিৎসককে পাঁচটা ওষুধ কোম্পানি ৫০ হাজার টাকা করে দিচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে চিকিৎসক কারটা নেবেন? কেউ যদি আগবাড়িয়ে বলে যে আমি ৬০ হাজার দেব, তাহলে নিশ্চয়ই ওই চিকিৎসক তারটা নেবেন। যদি কেউ বলে আমি ৮০ হাজার দেব, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসক সেটা নেবেন। বর্তমানে এটিই হচ্ছে।’

‘ওষুধ কোম্পানিগুলো দামটা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের এই প্রতিযোগিতার কারণে মার্কেটে একটা ডিমান্ড তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যেও অনেক চিকিৎসক আছেন, যারা বলছেন, না প্রয়োজন নেই, আমার কাছে যেটা (ওষুধ) ভালো লাগে সেটাই লিখব।’

মাসোহারা নিয়ে যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা>>

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা কিন্তু ওষুধ কোম্পানিগুলো তৈরি করেছে, চিকিৎসক করেননি। দেখা গেল প্রথম প্রথম একটা কোম্পানি এসে বলল, আপনি আমার এ ওষুধগুলো লিখবেন, আমি আপনাকে মাসিক ২০ হাজার টাকা দেব। এরপর আরেকটি কোম্পানি এসে বলল, আমরা ৫০ হাজার টাকা দেব। এভাবে কিন্তু তারা একজন চিকিৎসককে লোভে পড়তে বাধ্য করছে। মার্কেটিংয়ে ওষুধ কোম্পানিগুলোর এই যে বড় খরচ, সেটা নিশ্চয়ই ওষুধের দামের ওপর পড়ছে।

‘১৯৮২ সালে এরশাদ সরকারের সময়ে ওষুধ কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রণে ড্রাগ পলিসি করা হয়েছিল। সেটা মোটামুটি একটা স্ট্যান্ডার্ড পলিসি ছিল। এটা করতে গিয়ে এরশাদ সরকারকে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। দেশি-বিদেশি মাফিয়া চক্র, বিদেশি এজেন্ট বিশেষ করে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো প্রচণ্ড চাপ তৈরি করেছিল। কিন্তু এর পেছনে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ যারা ছিলেন তারা খুবই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাব দেখিয়েছিলেন। ফলে এরশাদ সাহেব সেটা করতে পেরেছিলেন।’

‘পর্যায়ক্রমে ড্রাগ পলিসিটা শিথিল করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ধীরে ধীরে আইনগুলো ওষুধ কোম্পানির পক্ষে চলে গেছে। কারণ, ওষুধের দামসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণে যে বোর্ড আছে সেখানে ওষুধ কোম্পানির লোক ঢুকে গেছে।’

ওষুধের দাম ফর্মুলার ভিত্তিতে নির্ধারণ>>

সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, আমাদের ড্রাগ পলিসিতে বলা আছে, ১১৭টা ওষুধের (এ্যাসেনশিয়াল ড্রাগ) দাম ফর্মুলার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়। সেই ফর্মুলায় দেখা হয় ওষুধের কাঁচামালের আমদানি খরচ, প্যাকেজিং ম্যাটারিয়ালস এবং এর আমদানি খরচ, ওষুধের উৎপাদন খরচ এবং তার সঙ্গে যোগ হয় সেলার খরচ। তার মানে, যে ১১৭টা ওষুধ রয়েছে সেগুলোর দাম কিন্তু অন্য ওষুধের মতো হুটহাট করে বাড়ে না। যেমন- সম্প্রতি ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের টাকার মান কমে গেছে। কাঁচামাল আমদানি করতে খরচও বেড়ে গেছে। এসব বিবেচনায় সরকার ৫৩টি ওষুধের দাম পুনর্নির্ধারণ করে দিয়েছে।

‘এসেনশিয়াল ড্রাগের বাইরে যেসব ওষুধ রয়েছে, সেগুলোর দাম ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজেরাই নির্ধারণ করে। এক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসনের একটা কমিটি সেই দামটা ভেরিফিকেশন করে। ওই কমিটিতে আবার সেই ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিও থাকেন। যে কারণে কোম্পানিগুলো যে দামের প্রস্তাবনা দেয়, সেখানে খুব বেশি নড়চড় হয় না। তারা ইচ্ছা মতো চিকিৎসকদের পেছনে টাকা খরচ করে দামের মাধ্যমে সেটা সমন্বয় করতে পারে। অন্যদিকে, ১১৭টি নির্ধারিত ওষুধের পেছনে যদি তারা এক টাকাও অতিরিক্ত ব্যয় করে তাহলে তা তাদের পকেট থেকে দিতে হয়। এ কারণে এখানে ইচ্ছা মতো তারা দাম বাড়াতে পারে না।’

করণীয় প্রসঙ্গে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমাদের প্রস্তাবনা হলো, এখন থেকে বাজারে যত ধরনের ওষুধ আছে, সব ওষুধের দাম ফর্মুলার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা। ওষুধ কোম্পানিগুলোর ইচ্ছামতো দাম বাড়ানোর এই প্রক্রিয়া চেপে ধরতে হলে এটাই অত্যন্ত মোক্ষম প্রক্রিয়া। হ্যাঁ, আমরাও চাই না ওষুধ কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হোক। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে ফর্মুলা রিভাইজ করা যেতে পারে।’

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে আরও শক্তিশালী করা দরকার>>

সৈয়দ আব্দুল হামিদ আরও বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে আরেকটি কাজ আমাদের করতে হবে। সেটা হলো আমাদের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে আরও বেশি শক্তিশালী করা। এখানে যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তিনি হন একজন ব্রিগেডিয়ার বা মেজর জেনারেল, যিনি আবার একজন চিকিৎসকও। তিনি তো ওষুধ বিজ্ঞান পড়েননি। ওষুধের বিষয়ে তার জ্ঞানের গভীরতা কম। ওষুধের বিষয়ে তার কোনো লেখাপড়া নেই।

‘আরেকটা বিষয়, তার পদবি হলো জয়েন্ট সেক্রেটারি বা অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারির সমান। আবার অধিদপ্তরটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন। যে কারণে তার শক্ত অবস্থান নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, আলটিমেটলি ডিসিশন মেকার হলেন স্বাস্থ্য সচিব। এক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানিগুলো যদি সচিবকে কনভিন্স করতে পারে তাহলে আর ওষুধ প্রশাসনের কিছু বলার সুযোগ থাকে না।’

“এজন্য আমরা বারবার বলছি যে ঔষধ প্রশাসনকে এফডিএ’র (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ  অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) আদলে একটি শক্তিশালী কমিশন করা দরকার। যেটা থাকবে স্বাধীন। এখানে মন্ত্রণালয়ের সরাসরি কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি স্বাধীনভাবে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। আমরা দেখি যে আমাদের দেশে ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে যারা জড়িত, তারা রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত। এমনকি তাদের মধ্যে কয়েকজন এমপিও (সংসদ সদস্য) আছেন। সুতরাং এমন শক্তিশালী মানুষগুলোকে যদি আপনি শাসন বা পরিচালনা করতে চান, তাহলে আপনার কাজের ক্ষেত্রটাও যথেষ্ট শক্তিশালী হতে হবে।”

অডিট সিস্টেম আরও শক্তিশালী করতে হবে>>

প্রতি বছর ওষুধ কোম্পানিগুলোতে যে অডিট হয়, সেটা কিন্তু সরকার করে না। করে থার্ড পার্টির কোনো একটা অডিট ফার্ম। অডিটের সময় যদি কোম্পানিগুলোকে শক্ত করে দেখা হয় যে কত টাকার কাঁচামাল কেনা হয়েছে, প্রোডাকশন কস্ট কত হয়েছে, শ্রমিক-কর্মচারীদের কত দেওয়া হয়েছে, আর প্রমোশনে কত টাকা খরচ হয়েছে। সবগুলো মিলিয়ে যদি দেখা যায় প্রমোশনে অনেক বেশি খরচ হয়েছে, সেক্ষেত্রে অডিটে তাদের ধরা প্রয়োজন। কেন প্রমোশনে এত টাকা খরচ হয়েছে, কোথায় এই টাকা দেওয়া হচ্ছে, টাকার সোর্স কী— প্রভৃতি বিষয়ে কঠোরভাবে দেখা উচিত— বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইইনস্টিটিউটের এই অধ্যাপক।

তার মতে, ‘প্রমোশনে খরচ হলে প্রতিটি খরচের জন্য একটি করে আলাদা ভাউচার থাকবে। লিফলেট করা হলে স্পষ্ট দেখা যাবে যে এটা এখানে খরচ হয়েছে। কেউ যদি মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ রাখে, সেটাও বেতন-ভাতায় চলে আসবে। কেউ যদি সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে, সেক্ষেত্রেও একটা খরচের বিল থাকবে। কিন্তু চিকিৎসকদের যেটা দেওয়া হচ্ছে, সেটা তো কোনো স্বাক্ষর ছাড়াই দেওয়া হচ্ছে। তাহলে এই টাকা কোন খাতে যাচ্ছে? আমি যতটুকু জানি, কোনো চিকিৎসকই রিসিটে (রসিদ) স্বাক্ষর করে টাকা নেন না।’

‘আরেকটা বিষয় হলো, আমাদের চিকিৎসকদেরও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে হবে। তাদের অধিকাংশই এখন দূষিত হয়ে পড়েছেন। চেম্বারে এসে এমনিতেই টাকা পেয়ে যান, কোনো পরিশ্রম নাই, ভালোই লাগে। এভাবে নিতে নিতে তাদের জায়গাটা দূষিত হয়ে গেছে। এজন্য তাদের ইনকামের হিসাব নেওয়া উচিত। তাদের টাকাগুলো কোন সোর্স থেকে আসছে? প্র্যাকটিস করেন, সেখানে প্রতিদিন কয়টা রোগী দেখেন, রোগীপ্রতি কত টাকা পান, সবমিলিয়ে রোগী দেখা থেকে মোট কত টাকা আসে, ওষুধ কোম্পানিগুলো থেকে নেওয়া মাসোহারা কতটা বৈধ— এ বিষয়গুলো শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে তাদের কিছুটা নিয়মের মধ্যে আনা যাবে।’

ওষুধের অপব্যবহার মহান এ পেশার সঙ্গে প্রতারণা>>

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ আবদুস সবুর খান বলেন, ওষুধের ব্যবহার আছে, অপব্যবহারও আছে। ওষুধটা লেখার কথা রোগীর চিকিৎসার জন্য, এটা হলো ওষুধের ব্যবহার। কিন্তু ওষুধ যদি কেউ অন্য কোনো কারণে লেখে, যেমন- ওষুধ কোম্পানির প্ররোচনায়, বেশি বিক্রি হওয়ার প্রয়োজনে, কিন্তু রোগীর প্রয়োজন নয়- সেটা হলো ওষুধের অপব্যবহার।

‘যদি ওষুধ কোম্পানির প্ররোচনায় পড়ে বা প্রলুব্ধ হয়ে কোনো চিকিৎসক ওষুধ লেখেন, সেটা হলো তার নিজস্ব পেশার সঙ্গে প্রতারণা। এটা নিঃসন্দেহে পেশাগত অসদাচরণ বলা যায়। আগে হয়তো দু-একটা উপহারে সীমাবদ্ধ থাকত, এখন সেটা টাকার পর্যায়ে চলে এসেছে।’

সিনিয়র চিকিৎসকরাও এসব অপকর্মে জড়াচ্ছেন— বিষয়টি কীভাবে দেখছেন। জানতে চাইলে সবুর খান বলেন, ‘এখানে তো সিনিয়র-জুনিয়র বলে কিছু নেই। তাদের প্রত্যেকেই অপরাধী। বাস্তবতা হলো, যিনি অসৎ তিনি সিনিয়র হলেও জড়াবেন, জুনিয়র হলেও জড়াবেন।’

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে


সূত্র : ঢাকাপোস্ট