নীরব ক্ষোভের অনলে পুড়ছে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ নেতা আনেয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে আগামী সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার গুঞ্জনে এই ক্ষোভ ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়নের আশায় থাকা নেতা ও তাঁদের বলয়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে পুঞ্জীভূত হচ্ছে ক্ষোভ। তবে মনোনয়নপ্রত্যাশী কেউ এখনই মুখ খুলতে চাইছেন না। অবশ্য নগর আওয়ামী লীগের কেউ কেউ বলছেন, আনোয়ারুজ্জামানই যে দলের মেয়র প্রার্থী, তা আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড থেকে বলা হয়নি; এটা ‘ভাওতাবাজি’ও হতে পারে।

যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী গত ২২ জানুয়ারি দেশে ফিরেন। এরপর গত বৃহস্পতিবার (২৬ জানুয়ারি) ঢাকায় গিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাতীয় সংসদ ভবনের সংসদ নেতার কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন।


আনোয়ারুজ্জামানের দেশে ফেরা ও শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের পর তাঁর অনুসারীদের মধ্যে উৎফুল্ল ভাব দেখা যাচ্ছে। সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) আগামী নির্বাচনে তাঁকেই দলের মেয়র প্রার্থী করা হচ্ছে বলেও প্রচার করছেন তারা। এক্ষেত্রে দলের হাইকমান্ড তাঁকে ‘গ্রিন সিগনাল’ দিয়েছে বলেও প্রচারণা চলছে। আনোয়ারুজ্জামান নিজেও বলেছেন, তাঁকে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

এমন গুঞ্জন আর প্রচারের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগে। মেয়র পদে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা ক্ষুব্ধ, তাঁদের অনুসারীদের মধ্যে হতাশা।

জানা গেছে, সিসিকের প্রথম দুই নির্বাচনে মেয়র পদে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগ নেতা বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। কিন্তু পরের দুই নির্বাচনে বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র পদে জয়ী হন।

আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, সিসিকের আগামী নির্বাচনে মেয়র পদে দল থেকে অন্তত পাঁচজন মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন। তন্মধ্যে গেলবার মেয়র পদে জোর আলোচনায় ছিলেন  নগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সহসভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ। এবারও আসাদের নাম রয়েছে ওপরের দিকে। তাঁর সাথে আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ ও এটিএম হাসান জেবুলকে ঘিরে আছে আলোচনা।

এসব নেতা গেল কয়েক বছর ধরেই নানাভাবে প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে সক্রিয় থাকার পাশাপাশি ব্যক্তিগত নানা তৎপরতায় নগরবাসীর কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেছেন তাঁরা। এখন মেয়র পদে হুট করে প্রবাসী এক নেতাকে ঘিরে চলা গুঞ্জনকে মেনে নিতে পারছেন না এসব নেতার কর্মী-সমর্থকরা।

সিলেট নগর আওয়ামী লীগের এক দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিলেটভিউকে বলেন, ‘যাঁরা দেশে থেকে বছরের পর বছর দলের জন্য কাজ করে গেলেন, বিপদে-আপদে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করলেন, তাঁদেরকে বাদ দিয়ে প্রবাসে বিলাসী জীবন কাটানো কোনো নেতাকে যদি মেয়র পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়, সেটা হবে আওয়ামী লীগের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। সিলেট নগরবাসীর জন্য তো তাঁর কোনো অবদান নাই। বিগত ভয়াবহ বন্যায়ও তাঁকে পাশে পায়নি নগরবাসী। বিপদে-আপদে যাঁরা পাশে ছিলেন, তাঁদেরকে রেখে কেন প্রবাসী নেতাকে ভোট দিতে যাবে নগরবাসী?’

মহানগর আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলছিলেন, ‘আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী এতোদিন সিলেট-২ আসনে এমপি হওয়ার জন্য দৌড়াদৌড়ি করলেন। এখন কোন কারণে তিনি সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান? আনোয়ারুজ্জামানের কারণেই সিলেট-২ আসনে আওয়ামী লীগের এমপি নেই। তিনি যদি এমপি হওয়ার জন্য দৌড়াদৌড়ি না করতেন, তাহলে এ আসনে নিশ্চিতভাবেই শফিকুর রহমান চৌধুরী দলের মনোনয়ন পেতেন। কিন্তু বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনে আনোয়ারুজ্জামান বাধা হয়ে দাঁড়ানোয় এ আসনে প্রার্থীই দেয়নি আওয়ামী লীগ। অন্য দলের প্রার্থীরা এমপি হয়ে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করতে পারেননি, ফলে সিলেট-২ আসনে আওয়ামী লীগ সরকারকে নিয়ে মানুষের ক্ষোভ আছে।’

আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর অনুসারীরা মেয়র পদে তাঁকেই দলীয় প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়ে গেছে বলে জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন। কিন্তু নগর আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন ভিন্ন কথা।

মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির এক সদস্য সিলেটভিউকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া কী এতোই সোজা? এই দলে কী সঠিক নেতার এতো অভাব যে প্রবাস থেকে আসা একজনকে হুট করে মেয়র প্রার্থী করা হবে? বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের মতো হেভিওয়েট প্রার্থীও দলের মনোনয়ন পাবেন কিনা, তা নিশ্চিত ছিলেন না। মনোনয়ন পেতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সভা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে তাঁকে। সেখানে নির্বাচনের ছয় মাস আগে একজনকে প্রার্থী করার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে গেছে বলে প্রচারণা, এটা আসলে ভাওতাবাজি।’

এদিকে, আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী নিজে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন একেবারে নিশ্চিত হওয়ার বিষয়ে খোলাসা করে কিছু বলেননি। গত ২২ জানুয়ারি দেশে ফেরার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তৃণমূল থেকে উঠে আসা রাজনৈতিক কর্মী। প্রধানমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কর্মী হিসেবে কাজ করতে চাই। মনোনয়নের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটা মাথা পেতে নেব।’

নগরীতে রাজনীতির অভিজ্ঞতার বিষয়ে বলেছিলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি এই শহরেই বড় হয়েছি, পড়ালেখা করেছি। তাই সিলেট নগরীর মানুষ আমার আপনজন।’

গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর আনোয়ারুজ্জামান সিলেটভিউকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। সিটি নির্বাচনের জন্য তিনি আমাকে কাজ করার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। সিলেটবাসীকে সঙ্গে নিয়ে আমি জাতির জনকের কন্যার আস্থার প্রতিদান দেব ইনশা আল্লাহ।’

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন সিলেটভিউকে বলেন, ‘অফিসিয়ালি ডিক্লারেশনের আগে কে প্রার্থী হবেন, তা বলা যাবে না।’

তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে গুঞ্জন থাকবে।এটা নিয়ে বিভ্রান্তির অবকাশ নেই।’

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে