বিলাতে বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রতীক হয়ে উঠছে এখানে নির্মিত শহীদ মিনারগুলো। প্রতিবছর ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে সেখানে মিলন ঘটে ব্রিটেনের বিভিন্ন প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা হাজারো বাঙালির। নিজ শিকড়ের কাছে ফিরে যাওয়ার এই অদম্য ইচ্ছের কাছে ফেব্রুয়ারীর এই হিম শীতল রাতও বার বার পরাস্ত হচ্ছে বাঙালির কাছে।

প্রতি বছরই জ্যামিতিক হারে ২০-ফেব্রুয়ারির মধ্যরাতের সমাগম বাড়ছে শহিদ মিনারে। যা দেখলে মনে হয় একখন্ড বাংলাদেশ।


এছাড়া শুধু বাংলা ভাষার মানুষের কাছেই নয়, ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের কাছেও শ্রদ্ধার প্রতীক হয়ে উঠেছে শহীদ মিনারগুলো। একুশে ফেব্রুয়ারি ছাড়াও ব্রিটেনের সাধারণ পর্যটকদের কাছে এগুলো ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। যেনো পৃথিবীর বিলুপ্ত এবং বেঁচে থাকা সব ভাষার গৌরবোজ্জ্বল প্রতীক এই শহিদ মিনারগুলো।

নিজ সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সঙ্গে নিয়ে ব্রিটেনে বাঙালির আজকের এই শক্ত ভিত্তির অবস্থান, সদ্য ব্রিটেনে পাড়ি জমানো অনেককে আবেগে আপ্লুত করলেও এই পর্যায়ে পৌঁছতে বাঙালির দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস হয়তো অনেকেই জানেন না। বাংলা ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের স্মরণ করতে এই শহীদ মিনারগুলো নির্মাণের পেছনে রয়েছে বাংলাদেশি কমিউনিটির সংগ্রামের ইতিহাস। প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো স্মরণীয় ঘটনাগুলো।

জানা যায়, ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশি কমিউনিটির উদ্যোগে এখন পর্যন্ত ছয়টি স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ হয়েছে। মূলত ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকেই এর ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। এরপর থেকে ব্রিটেনে একে একে তৈরি হতে থাকে শহীদ মিনারগুলো। এ ছাড়া বিভিন্ন শহরে ভাষা দিবস উপলক্ষে নির্মিত হয় অস্থায়ী শহীদ মিনার।

ওল্ডহ্যামে প্রথম শহীদ মিনার
১৯৯৭ সালের ৫ অক্টোবর ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের উদ্যোগে প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয় ওল্ডহ্যামে। লন্ডন থেকে এই শহরের দূরত্ব প্রায় ২৬৩ কিলোমিটার। এটি ব্রিটেনের তৃতীয় বৃহত্তম বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল। ওল্ডহ্যাম বাংলাদেশ ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে ও স্থানীয় বাংলাদেশি ও কাউন্সিলের সহযোগিতায় তৈরি হয় ব্রিটেনের এই প্রথম শহীদ মিনার। তবে স্থানীয় বাংলাদেশি কাউন্সিলর আবদুল জব্বার ওল্ডহ্যাম কাউন্সিলের অনুমোদন লাভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

শুরুর দিকে ওল্ডহ্যাম বাংলাদেশি হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে অস্থায়ী শহীদ মিনারে ভাষা দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলির আয়োজন করা হতো। স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের পর থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের জন্য ওল্ডহ্যামের আশপাশের শহর ম্যানচেস্টার, ব্র্যাডফোর্ড ও লিডসে বসবাসরত বাংলাদেশিরা সমবেত হন।

লন্ডনে দ্বিতীয় ও ব্রিটেনের বৃহত্তম শহীদ মিনার
১৯৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পূর্ব লন্ডনের আলতাবী আলী পার্কে স্থাপিত হয় লন্ডনের একমাত্র স্থায়ী শহীদ মিনার। এটাই ইংল্যান্ডে স্থাপিত শহীদ মিনারগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ। তবে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের কাছে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য স্থানীয় বাংলাদেশিরা দাবি জানিয়ে আসছিলেন ১৯৮১ সাল থেকে। ১৯৮৫ সালে শহীদ দিবস উদযাপন কমিটি গঠনের পর টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল পূর্ব লন্ডনে শহীদ মিনারের স্থান দিতে সম্মতি জানায়। এটি নির্মাণ করতে কাউন্সিলকে অর্থসহায়তা হিসেবে কমিউনিটির ৪৫টি সংগঠনের প্রত্যেকে ৫০০ পাউন্ড করে মোট ২২ হাজার পাউন্ড অনুদান দিয়েছিলেন। এসব সংগঠনের তালিকা রয়েছে শহীদ মিনারের পাশে।

এদিকে ১৯৭৮ সালে বর্ণবাদী হামলাকারীদের আক্রমণে নিহত বাঙালি আলতাব আলীর স্মৃতিতে নির্মিত পার্কের শহীদ মিনারে গত ৮ ফেব্রুয়ারি শ্রদ্ধা জানান রাজা তৃতীয় চার্লস ও কুইন কনসর্ট।

ব্রিটেনের তৃতীয় শহীদ মিনার লুটনে
২০০৪ সালের ৮ আগস্ট লুটনে উদ্বোধন করা হয় ব্রিটেনের তৃতীয় শহীদ মিনার। লন্ডন থেকে লুটনের দূরত্ব ৪৬ কিলোমিটার। লুটনের ব্যারিপার্ক অঞ্চলেই অধিকাংশ বাংলাদেশি কমিউনিটির বসবাস। সত্তরের দশকে ব্রিটেনে বর্ণবাদীদের কর্মকাণ্ড চরম আকার ধারণের সময় লুটনে বর্ণবাদী হামলা রুখে দিতে বাংলাদেশি কমিউনিটির তরুণদের উদ্যোগে গঠিত হয়েছিলো বাংলাদেশ ইয়ুথ লীগ। বর্তমানে লুটনের লে-গ্রিব রোডের যে স্থানে সিওয়াই সিটি সেন্টার তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেখানেই ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ ইয়ুথ লীগ স্থাপিত হয়েছিলো। বাংলাদেশ ইয়ুথ লীগের ২৫ বছর পূর্তিকে স্মরণীয় করে রাখতে লুটনে শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে সংগঠনটির উদ্যোক্তারা।

চতুর্থ শহীদ মিনার বার্মিংহ্যাম শহরে
ব্রিটেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাংলাদেশি অধ্যুষিত অঞ্চল হলো বার্মিংহ্যাম। লন্ডন থেকে এই শহরের দূরত্ব ১৬৪ কিলোমিটার। এখানে বার্মিংহ্যাম বাংলাদেশ মাল্টিপারপাস সেন্টারের উদ্যোগে ২০১১ সালে নির্মাণ করা হয় ব্রিটেনের চতুর্থ শহীদ মিনার। তবে বার্মিংহ্যামের স্মলহিথ পার্কে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে একাধিক কমিউনিটি গ্রুপ উদ্যোগ নিলেও স্থানীয় কাউন্সিল থেকে নানান কারণে চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি।

পরবর্তীতে বাংলাদেশ মাল্টিপারপাস সেন্টারের উদ্যোগে ও সেন্টারের নিজস্ব অর্থায়নে শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় সেন্টারের নিজস্ব স্থানে। শহীদ মিনারটির নির্মাণ ব্যয়ের ২০ হাজার পাউন্ডের পুরো অর্থ যোগান দিয়েছেন বাংলাদেশ মাল্টিপারপাস সেন্টার। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১১ সালে বার্মিংহ্যামে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয় ব্রিটেনের চতুর্থ শহীদ মিনারটি।

ইপ্সউইচে ব্রিটেনের পঞ্চম শহীদ মিনার
সাফোর্ক বাংলাদেশি সোসাইটি ইপ্সউইচে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে ২০১২ সালে। সেই সময় স্থানীয় বাংলাদেশিরা শহীদ মিনারের কাঠের প্রতিকৃতি বানিয়ে বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছিলেন। ভাষার প্রতি এমন শ্রদ্ধাবোধ ও বাঙালির আত্মত্যাগের কথা ইপ্সউইচের কাউন্সিলকে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণে অনুপ্রাণিত করে। ২০১৫ সালে স্থানীয় কাউন্সিলের সম্পূর্ণ অর্থায়নে ইপ্সউইচের আলেকজান্দ্রা পার্কে শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ২০১৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আলেকজান্ড্রা পার্কে উদ্বোধন হয় ব্রিটেনের পঞ্চম স্থায়ী শহীদ মিনার।

কার্ডিফে ব্রিটেনের ষষ্ঠ শহীদ মিনার
কার্ডিফ শহরের বে এলাকার ঐতিহ্যবাহী গ্রেইঞ্জমোর পার্কে ১৩ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ও কমিউনিটির প্রচেষ্টায় শহীদ মিনারটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠান পালন করার মাধ্যমে শুরু হয় এই শহীদ মিনারের যাত্রা। এ শহিদ মিনার নির্মানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬৬ হাজার পাউন্ড অনুদান দিয়েছিলেন।

মনুমেন্ট ফাউন্ডার ট্রাস্ট কমিটির সেক্রেটারি মকিস মনসুর বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুবিধাজনক সময়ে শহীদ মিনারটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন— এমনটিই প্রত্যাশা করছি আমরা।'

সিলেটভিউ২৪ডটকম/মাহবুব/ইআ-১৫