আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন প্রক্রিয়ায় বিএনপিকে নিয়ে আসা যায়, সে বিষয়ে পর্দার অন্তরালে চলছে অনানুষ্ঠানিক সংলাপ। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার গ্রিন সিগন্যাল নিয়েই এ প্রক্রিয়া শুরুর কথা জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো। অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় উভয়পক্ষ একমত হলে অল্প সময়ের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপের দ্বার খুলতে পারে।

জানা গেছে, নির্বাচনের অংশগ্রহণের জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে যেসব দাবি-দাওয়া উত্থাপন করা হয়েছিল, তা পূরণে অনেকটাই নমনীয় ক্ষমতাসীন দল। এরই মধ্যে ইভিএমে ভোট আয়োজন থেকে সরে আসাও নমনীয়তার অংশ বলে মনে করেন অনেকেই। অর্থাৎ ব্যালটেই হচ্ছে আগামী নির্বাচন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনীতি করার বিষয়টি ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। গত কয়েক দিনে আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতার বক্তব্যে বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট হয়েছে। আইনি বাধ্যবাধকতা কাটিয়ে আগামী নির্বাচনে খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণের বিষয়টি নিয়েও আওয়ামী লীগ ভাবছে বলে জানা গেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, বিএনপি এখন মুক্ত পরিবেশে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে।


২০২৪ সালের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের আগে সরকার পতনের লক্ষ্যে ধারাবাহিক আন্দোলন করে আসছে বিএনপি। তাদের সঙ্গে এরই মধ্যে যুক্ত হয়েছে ৬০টির মতো মিত্র দল। সরকারকে চাপের মুখে ফেলতে ইতোমধ্যে বিএনপির সংসদ সদস্যরাও পদত্যাগ করেছেন।

এদিকে নানা শর্তের কথা বলে বিএনপি সরকারকে বেকায়দায় রাখার চেষ্টা করলেও নেতাকর্মীদের চাপের মুখে আছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। তৃণমূল থেকে দাবি আছে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে। তেমনি দলটির সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থীদের অনেকেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে। তারাও চান সরকারের সঙ্গে যে কোনো মাধ্যমে দূতিয়ালির মধ্য দিয়ে সমঝোতার পথ তৈরি হোক। তেমনি এবারের নির্বাচনে অংশ না নিলে দলের পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে; এমন ভাবনাও রয়েছে নেতাদের মধ্যে। এর কারণ হিসেবে দলটির নেতারা বলছেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হলে ২০১৪ সালে সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার ধোয়া তুলে দলটি নির্বাচন বর্জন করে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে নামমাত্র অংশ নেওয়ায় অসন্তুষ্ট খোদ দলের নেতাকর্মীরাই। তাই আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে পার্টির শীর্ষ নেতারা চাপের মুখে রয়েছেন। তারাও অংশ নেওয়া-না নেওয়া ইস্যুতে দলের লাভক্ষতির হিসাব করছেন বলে জানা গেছে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে তারেক রহমানের সবুজ সংকেতের ওপর।

বিএনপির একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিএনপি ধারাবাহিক নির্বাচন বর্জন করায় স্থানীয় সরকার বিভাগগুলোতে দলের নির্বাচিত প্রতিনিধি একেবারেই নামমাত্র। পার্টির সমর্থন ছাড়া নিজ দায়িত্বে নির্বাচন করে কেউ কেউ বিজয়ী হলেও নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি হামলা-মামলায় জর্জরিত। তেমনি সংসদে দলের প্রতিনিধিত্ব নেই। ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে দিন দিন হতাশা বাড়ছে। সেইসঙ্গে সরকার পতনের জোড়ালো আন্দোলনের হুঙ্কার দিন দিন খেলনায় পরিণত হচ্ছে।

বিএনপির পক্ষ থেকে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের ঘোষণা দেওয়া হলে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার পর দেশে জঙ্গিবাদের ভয়াবহ উত্থান ঘটে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পাশাপাশি একসঙ্গে ৬৩ জেলায় বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। সারা দেশে হত্যা, ধর্ষণসহ সন্ত্রাসী কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে-পরে আন্দোলনের নামে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, হত্যার ঘটনার দায় কার্যত বিএনপির ঘাড়েই বর্তায়। ফলে সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন ঘটাতে গিয়ে ভোটাররা মুখ ফিরয়ে নিতে পারেন—এমন ভাবনাও রয়েছে দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে।

তেমনি সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগও। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকেই এ অভিযোগ জোড়ালো হচ্ছে, যে কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে দলকে। দেশে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর থাকতে দেখা যায়।

শেষ পর্যন্ত নির্বাচন ইস্যুতে কঠোর অবস্থানের বরফ গললেও উভয় দল দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এখনও অনড় অবস্থানে রয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ী রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চায়। আর বিএনপিসহ তাদের মিত্র দলগুলোর পক্ষ থেকে শুরু থেকেই বলা হচ্ছে, তারা রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। এজন্য তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন চলমান রয়েছে।

দুই পক্ষের এমন অবস্থানের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার পথ খোঁজা হচ্ছে। বিএনপি যাতে নির্বাচনে অংশ নেয় আওয়ামী লীগও তা চাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন ইস্যুতে নেওয়া পদক্ষেপ তা স্পষ্ট করেছে।

২০০৮ সাল থেকে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে বিএনপির প্রধান দুই নেতা বিভিন্ন মামলায় দণ্ডিত হলেও তাদের পক্ষ থেকে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাসহ ফোরামের কাছে ধারাবাহিকভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার নালিশ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে আগামীতে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। নির্বাচনে বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণ চায় তারা। ফলে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার ব্যাপারে সরকারের ওপর পরোক্ষ চাপ রয়েছে আন্তর্জাতিক মহলের।

সব মিলিয়ে সরকারও চায় একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করতে। তাই প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে বিএনপির সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা পর্ব শুরু হয়েছে। জানা গেছে, দলপ্রধানের নির্দেশে আওয়ামী লীগের অন্তত চারজন নেতা বিএনপি মহাসচিবসহ শীর্ষ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে কিছু শর্ত পূরণের কথা বলা হয়েছে। সরকার কৌশলে সেপথে হেঁটে মন গলানোর চেষ্টা করছে দলটির। সব মিলিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে রাজনীতিতে সুবাতাস বইতে পারে—এমন আভাস মিলেছে উভয় দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে।

গত ২৬ জানুয়ারি সুইজারল্যান্ডের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত নাথালি চুয়ার্ডের সঙ্গে সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে সরকার সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

সর্বশেষ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের উপদেষ্টা ডেরেক শোলে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেন। বিদায়ের আগে শোলে বলেছেন, আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে—এ ব্যাপারে সরকার আশ্বস্ত করেছে, সে আশা নিয়ে ফিরে গেলাম।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির লোগো।

নমনীয়তার বিষয়টি স্পষ্ট মন্ত্রী ও নেতাদের কথাতেও। গত বুধবার আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে বাধা নেই। তিনি জেলে থেকেও দল পরিচালনা করতে পারবেন, বিভিন্ন নির্দেশনা দিতে পারবেন। তবে সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে আইন অনুযায়ী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে বর্তমান নির্বাচনী আইনে যা আছে, তাই মানতে হবে।

তবে গতকাল বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, (দণ্ড স্থগিতের) শর্ত অনুযায়ী খালেদা রাজনীতি করতে পারবেন না। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কেউ যদি দুই বছরের বেশি শাস্তিপ্রাপ্ত হন, তিনি নির্বাচন করতে পারেন না। খালেদা জিয়া দুই বছরের অনেক বেশি সময়ের জন্য দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার তো নির্বাচন করার প্রশ্নই আসে না। কেউ যদি বলে থাকে, সেটা বলতে পারে। যতদূর আইন-কানুন জানি ও বুঝি, আমি এরই মধ্যে খোঁজখবর নিয়েছি। একই দিন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে নির্বাচন করতে পারবেন না, রাজনীতি করতে পারবেন। আইনমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয় দুটি শর্তে। একটি হলো বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন। আরেকটি হলো দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। রাজনীতি করতে পারবেন না, এমন কোনো শর্ত ছিল না।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন না এ জাতীয় কোনো শর্ত তাঁর সাজা স্থগিত করার সময় উল্লেখ ছিল না। দুই দলের যোগাযোগ বিষয়ে তিনি বলেন, সংলাপ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে না হলেও, একেবারে যে হচ্ছে না তা নয়।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, শেখ হাসিনা ও বর্তমান প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন কখনো সুষ্ঠু হবে না। অতীতে সেটা তো একাধকিবার প্রমাণিত হয়েছে। তাই শেখ হাসিনা ও এই প্রশাসনের অধীনে আমরা কোনো নির্বাচনে যাব না। অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শেখ হাসিনাকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে, সংসদ বিলুপ্ত করতে হবে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে না।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ বলেন, সংলাপের মূল বাধা খালেদা জিয়া ও তারেক। বিশেষ করে তারেক জিয়া। এরা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে একুশে আগস্টে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল, হাওয়া ভবন থেকে নির্দেশনা দিয়েছিল। এই জায়গায় আওয়ামী লীগ কখনো ছাড় দেবে না। আওয়ামী লীগ কখনো তাদের সমঝোতায় নিয়ে সংলাপ করবে না বলেও জানান তিনি।

বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ বলেন, বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে তাহলে দলটির আর অস্তিত্ব থাকবে না। কারণ তারা ১৬ বছরের বেশি ক্ষমতার বাইরে। তারা ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছে। ’১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আন্দোলন করছে। কোনো লাভ হয়নি। এবার সুযোগ আছে নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাই করার। তাছাড়া বিএনপি এখন জামায়াতমুক্ত। এটাকে অনেকেই ভালো চোখে দেখছে। এর সুফল পেতে হলে তো নির্বাচন ছাড়া বিকল্প নেই। এর বাইরে গিয়ে আন্দোলন করলে আরও বেশি জনবিচ্ছিন্ন হবে বিএনপি। কাজেই সরকার যদি তাদের নির্বাচনে আনতে পদক্ষেপ নেয় তাহলে তাদের ইতিবাচক সাড়া দেওয়া উচিত। মান-অভিমান, জেদ ভুলে গিয়ে আরও বেশি সামনে এগিয়ে আসতে হবে।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে


সূত্র : কালবেলা