গত বছরের সিলেটে হওয়া ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতিতে অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার নওয়াগাওঁয়ের গৃহবধূ জয়নব বিবি। ওইসময় চারদিকে যখন বিপদঘণ্টা, একদিন রাতে বন্যাদুর্গত অবস্থায় আশ্রয়কেন্দ্রে জয়নবের ঘরে জন্ম নেয় ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান। নবজাতকের নাম রাখা হয় ‘বন্যা’।

একসময় বন্যা চলে যায়, আশ্রয়কেন্দ্র থেকে একে একে বাড়ি ফেরেন লোকজন। কিন্তু জয়নব ‘বন্যা’-কে নিয়ে যাবেন কোথায়! তাঁর যে নিজস্ব মাথাগোঁজার ঠাঁই নেই! অবশেষে তার ভাগ্যে জুটলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর। গোয়াইনঘাট নওয়াগাওঁয়ে নির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলোর একটি পেয়েছেন তিনি। এবার আর নির্বিঘ্নের ‘বন্যা’র বেড়ে উঠা নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই জয়নবের।


এই বন্যার অন্ধকার সময়ের কথা, চারদিকে থৈ থৈ পানির মাঝে সন্তানের জন্ম নেওয়া আর স্বপ্নের উপহারের ঘর পাওয়ার সুখ-গল্প বুধবার প্রধামন্ত্রীকে শুনানোর কথা ছিলো গোয়াইনঘাটের জয়নবের। কিন্তু নেটওয়ার্ক বিড়ম্বনায় তার সেই আশার গুড়ে বালি। 

বুধবার তৃতীয় ধাপের অবশিষ্ট ও চতুর্থ ধাপে সিলেট জেলায় ভূমি ও গৃহহীন ৬শ’ ৬টি পরিবারকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর উপহার দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গোয়াইনঘাটে ঘর পেয়েছে ১৭০টি পরিবার। 

ঘরগুলোর চাবি ও দলিল হস্তান্তর উপলক্ষে গোয়াইনঘাট উপজেলার নন্দিরগাঁও ইউনিয়নের নওয়াগাঁও আশ্রয়ণে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে সিলেট জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমানের সভাপতিত্বে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন উপহারদাতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধান অতিথি ছিলেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ এমপি। 

অনুষ্ঠানে এক পর্যায়ে উপহার পাওয়া লোকজনের অনুভূতি জানতে চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক কথা বলা শুরুও করেন উপকারভোগীর। কিন্তু বেশিক্ষণ কথা বলতে পারেননি তারা, বাধা হয়ে দাঁড়ায় নেটওয়ার্ক বিড়ম্বনা। এ কারণে জয়নব বিবিও বলতে পারেননি তার মনের গভীরের কথাগুলো, প্রাণ খুলে কৃতজ্ঞতা জানানো হয়নি প্রধানমন্ত্রীকে। 

পরে ‘বন্যা’র মা জয়নব বিবি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন- ‘আমি দীর্ঘদিন থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলার অপেক্ষায় ছিলাম।  প্রধানমন্ত্রী আমাকে ঘর দিয়ে যে উপকার করেছেন- এজন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বড় একটি স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে আমার স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেলো।’

জয়নব আর বলেন- ‘আমার ভিটে-ঘর কিছুই ছিলো না। আমি ও আমার স্বামী স্ত্রী-ছেলে সন্তান নিয়ে মানুষের বাড়ি-বাড়ি বসবাস করেছিলাম। সর্বশেষ প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র নিয়ে নওয়াগাওঁ একটি বাড়ীতে ৭-৮ মাস থেকেছি। কিন্তু ২০২২ সালের জুন মাসে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ভাসিয়ে নেয় আমাদের সবকিছু। এই চরম বিপদের সময় গোয়াইনঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও নন্দিরগাওঁ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস কামরুল হাসান আমিরুল বন্যার পানিতে আটকে পড়াদের উদ্ধার করে দশগাওঁ নয়াগাঁও উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজে আশ্রয় দেন। এই আশ্রয়কেন্দ্রে আমারসহ নন্দিরগাওঁ ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পানিবন্দী মানুষ আশ্রয়ন নেন। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পরই আমার প্রসবব্যথা উঠে। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আমার জন্য পৃথক একটি কক্ষের ব্যবস্থা করেন এবং এদিন আমার এক কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। পরের দিন আমি ও আমার সন্তানকে দেখতে আসেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মজিবুর রহমান ও গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাহমিলুর রহমানসহ সরকারি উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। জেলা প্রশাসক মহোদয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে আমার মেয়ের নাম রাখেন বন্যা। তারা সবাই আমার মেয়েকে কাপড় উপহার দেন ও আর্থিক সহায়তা করেন। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলে মানুষজন নিজ বাড়িতে ফেরা শুরু করেন। কিন্তু আমাদের বসতঘর না থাকায় আমরা আরো ৭ মাস আশ্রয়কেন্দ্রে কাটাই। অবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেওয়া নওয়াগাওঁ আশ্রয়ন প্রকল্পে আমাদের জন্য একটি ঘর বরাদ্দ করেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ। আমার নিজের একটি ঘর হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আমি হৃদয়নিংড়ানো কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। দোয়া করি- আল্লাহ তায়ালা প্রধানমন্ত্রীকে দীর্ঘজীবি করুন।’

জয়নব তাঁর একটি শেষ ইচ্ছা ব্যক্ত করে বলেন- ‘জীবনের একটি শেষ ইচ্ছে হচ্ছে- একদিন সরাসরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা অথবা কথা বলা। এ ইচ্ছেটা পূরণ না হলে আমার জীবনে অপূর্ণতা থেকেই যাবে।’


সিলেটভিউ২৪ডটকম / মতিন / ডালিম