মহান আল্লাহ্ তাআলা বলেন, মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য, কিন্তু রোজা কেবল আমারই জন্য, আমিই নিজেই এর প্রতিদান দেবো (বোখারি)। পবিত্র রমজান মাসে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে রোজা রাখা মুসলমানদের উপর ফরজ। পৃথিবীজুড়ে মুসলমানরা রোজার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার কাছে নিজেদের নিবেদন করেন। তাঁদের এ আত্মনিবেদনের পেছনে থাকে না কোনো ইহলৌকিক চাওয়া। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিই কেবল চেয়ে থাকেন মুমিনরা।
আল্লাহ তাআলাও মুমিনদের এ ভালোবাসাকে কবুল করে নিয়ে জান্নাতি প্রতিদান দিয়ে তাঁদের জীবনকে কানায় কানায় পূর্ণ করে দেন। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমান ও সাওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখে, আল্লাহ তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেন। ’ (বুখারি ও মুসলিম)
রোজাদারদের সংবর্ধিত করতে জান্নাতে থাকবে একটি বিশেষ গেট। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জান্নাতে রাইয়ান নামে একটি দরজা আছে। ওই দরজা দিয়ে কেবল রোজাদাররাই প্রবেশ করবে। ঘোষণা করা হবে, রোজাদাররা কোথায়?
তখন তারা উঠে দাঁড়ালে তাদের জান্নাতে প্রবেশ করতে বলা হবে। তারা প্রবেশ করার পর ওই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং তা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। ’ (সহিহ বুখারি)
রোজা হলো সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার, পঞ্চইন্দ্রিয়ের দ্বারা গুনাহের কাজ ও যৌনসঙ্গম থেকে বিরত থাকা। রমজান মাসে ইবাদত করলে সত্তর গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়।
রোজাদারের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত ইফতারের সময়। কারণ এ সময় আল্লাহতাআলা তাঁর রোজাদার বান্দাদের দোয়া কবুল করেন এবং ইফতারের মাধ্যমেই একজন রোজাদার তাঁর রোজা সম্পন্নের পর মহান আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করেন।
প্রিয় নবী (সা.) খেজুর ও কয়েক ঢোঁক পানি দিয়েই ইফতার শুরু করতেন। রাসুল (সা.) এর জীবনের প্রতিটি কাজই মুসলমানদের জীবেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যেসব কাজ করতেন-যা আহার বা পানীয় রূপে গ্রহণ করতেন তাই আল্লাহতায়ালা সুন্নাত করে দিয়েছেন। আল্লাহর আদেশ মতে, যে রাসূল (সা.)-এর আদর্শকে জীবনে বাস্তবায়িত করতে পারবে সেই হবে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলকাম। নিয়মিত খাবারই মহানবী (সা.) সেহরি ও ইফতারে খেতেন। তবে খেজুর দিয়ে সেহরি ও ইফতার করা তিনি পছন্দ করতেন।
রাসুল (সা.) বেশ কিছু খাবার খেতে বেশি পছন্দ করতেন এবং আহারের সময় বিশেষ কিছু নিয়ম মেনে চলতেন। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) যেসব খাবার গ্রহণ করেছেন, তা ছিল সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। ব্যক্তিগত জীবনে রাসুল (সা.) নিজেকে সুস্থ, সবল ও ফিট রাখতে বেশ কিছু খাবারকে গুরুত্ব দিয়েছেন যা আমরা হাদিস থেকে জানতে পারি। আসুন জেনে নেয়া যাক সেই খাবারগুলো সম্পর্কে।
খেজুর দিয়ে সেহরি খাওয়াকে সেরা সেহরি বলেছেন মহানবী (সা.)। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) বলেন, ‘খেজুর কতই না উত্তম সাহরি!’ (আবু দাউদ: ২৩৪৫)
ইফতারও মহানবী (সা.) খেজুর দিয়ে করতে পছন্দ করতেন। তাঁর ইফতারের পাতে বেশির ভাগ সময় কাঁচা খেজুর থাকত। কাঁচা খেজুর না থাকলে শুকনো খেজুরও খেতেন তিনি। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘নবী (সা.) নামাজের আগে কয়েকটি কাঁচা খেজুর খেয়ে ইফতার করতেন। যদি কাঁচা খেজুর না থাকত, তাহলে শুকনো খেজুর দিয়ে। যদি শুকনো খেজুরও না থাকত তাহলে কয়েক ঢোক পানি দিয়ে।’ (তিরমিজি: ৬৩২)
অন্য হাদিসে হজরত সালমান ইবনে আমির (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ রোজা রাখলে খেজুর দিয়ে যেন ইফতার করে, খেজুর না হলে পানি দিয়ে; নিশ্চয়ই পানি পবিত্র।’ (আহমাদ, তিরমিজি, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ ও দারেমি)
খেজুর ছাড়াও তৎকালীন আরবে প্রচলিত অন্যান্য খাবারও খেতেন মহানবী (সা.)। আবদুল্লাহ ইবনে আবি আউফ (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রোজায় আমরা রাসুল (সা.)-এর সফরসঙ্গী ছিলাম। সূর্যাস্তের সময় তিনি একজনকে ডেকে বললেন, ছাতু ও পানি মিশিয়ে ইফতার পরিবেশন করো।’ (মুসলিম: ১০৯৯)
হযরত মোহাম্মদ ( সা.) এর পছন্দের প্রতিটি খাবার ছিল পুষ্টিগুণে অতুলনীয়। তিনি কখনও এমন খাবারকে প্রাধান্য দিতেন না যা শরীরের জন্য কষ্টকর বা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বিশ্বনবীর পছন্দের খাবারের মধ্যে রয়েছে মধু ও কালোজিরা। এই দুটি খাবার মানুষের জন্য বিশেষ উপকারী হওয়ায় তিনি আমাদের বলেছেন, মৃত্যু ছাড়া সব রোগের শ্রেষ্ঠ ওষুধ এটি।
রাসুল (সা.)-এর পছন্দের খাবারের মধ্যে আরও একটি খাবার হলো বার্লি। এটি গমের মতো একটি খাবার। যা মহানবী খেতে খুবই পছন্দ করতেন। এছাড়া তার পছন্দের খাবারের মধ্যে ছিল সবুজ সবজি লাউও। লাউয়ে থাকা বিশেষ উপাদান মস্তিষ্কের জন্য বিশেষ উপকারী হওয়ায় তিনি এই খাবারটিকে ভীষণ পছন্দ করতেন।
তরমুজ এবং শসা মহানবী (সা.) এক সঙ্গে খেতে পছন্দ করতেন। জায়তুন বা জলপাইও রাসূল (সা.)-এর প্রিয় খাবার ছিল। এই ফল থেকে যে তেল হয় তা খাওয়ার পরামর্শও তিনি হাদিসে আমাদের বলে গেছেন। জলপাইয়ের তেল বা অলিভ ওয়েলের উপকারিতা সম্পর্কে তিনি আমাদের বলেছেন, তোমরা জায়তুনের তেল খাও এবং জায়তুনের ফল খাও। কারণ এই বৃক্ষের মাঝে আল্লাহ বরকত ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
পনির খেতে পছন্দ করতেন রাসুল (সা.)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তাবুকের যুদ্ধে রাসুল (সা.)-এর কাছে কিছু পনির উপস্থাপন করা হয়। রাসুল (সা.) বিসমিল্লাহ পড়ে একটি চাকু দিয়ে সেগুলো কাটেন এবং কিছু আহার করেন। (আবু দাউদ : ৩৮১৯)
মাখন ও খেজুর পছন্দ করতেন। হজরত ইবনাই বিসর আল মুসলিমাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, তাঁরা উভয়ে বলেন, ‘একবার আমাদের ঘরে রাসুল (সা.) আগমন করেন। আমরা তাঁর সম্মুখে মাখন ও খেজুর পরিবেশন করি। তিনি মাখন ও খেজুর পছন্দ করতেন।’ (তিরমিজি : ১৮৪৩)
মিষ্টান্ন ও মধু পছন্দ করতেন। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) মিষ্টান্ন ও মধু পছন্দ করতেন।’ (বুখারি, ৫১১৫; মুসলিম, ২৬৯৫) বুখারি শরিফের আরেকটি হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মধু হলো উত্তম ওষুধ।’ (৫৩৫৯)
ঘি মাখা রুটি খেতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) একদিন বলেন, ‘যদি আমাদের কাছে বাদামি গমে তৈরি ও ঘিয়ে সিক্ত সাদা রুটি থাকত, তাহলে সেগুলো আহার করতাম।’ আনসারি এক সাহাবি এই কথা শুনে এ ধরনের রুটি নিয়ে আসেন...। (ইবনে মাজাহ : ৩৩৪০)
দুধ পান করতে পছন্দ করতেন। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘মিরাজের রাতে বায়তুল মাকদিসে আমি দুই রাকাত নামাজ পড়ে বের হলে জিবরাইল (আ.) আমার সম্মুখে শরাব ও দুধের আলাদা দুটি পাত্র রাখেন। আমি দুধের পাত্রটি নির্বাচন করি। জিবরাইল (আ.) বললেন, ‘আপনি প্রকৃত ও স্বভাবজাত জিনিস নির্বাচন করেছেন।’ (বুখারি : ৩১৬৪, তিরমিজি, ২১৩)
কিশমিশ খেতেন। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর জন্য কিশমিশ ভিজিয়ে রাখা হতো এবং তিনি সেগুলো পান করতেন।’ (মুসলিম)
সারিদ অত্যন্ত প্রিয় ছিল। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.)-এর কাছে রুটির সারিদ ও হায়সের সারিদ অত্যন্ত প্রিয় ছিল।’ (আবু দাউদ : ৩৭৮৩)
সারিদ হলো গোশতের ঝোলে ভেজানো টুকরো টুকরো রুটি দিয়ে তৈরি বিশেষ খাদ্য। আর হায়স হলো মাখন, ঘি ও খেজুর দিয়ে যৌথভাবে বানানো খাবার।
সিরকা পছন্দ করতেন। হজরত জাবের (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) তাঁর পরিবারের কাছে সালন কামনা করেন। তাঁরা বলেন, আমাদের কাছে তো সিরকা ছাড়া আর কিছু নেই। মহানবী (সা.)-এর কাছে সেগুলো নিয়ে আসা হলে তিনি তা থেকে খেতে শুরু করেন। তারপর বলেন, ‘সিরকা কতই না উত্তম সালন! সিরকা কতই না উত্তম সালন!’ হজরত জাবের (রা.) বলেন, ‘সেদিন থেকে আমি সিরকা পছন্দ করতে শুরু করি।’ (মুসলিম : ২০৫১)
এছাড়া রাসুল (সা.) খরগোশের গোশত, মোরগ, খাসির পায়া, সামুদ্রিক মাছ খেতেন।
পছন্দের খাবারের পাশাপাশি তার কিছু অপছন্দের খাবারও ছিল। তিনি তিনটি খাবারকে ভীষণ অপছন্দ করতেন। এর মধ্যে প্রথমে যে খাবারটি রয়েছে তা হলো গরম খাবার। রাসুল (সা.) কখনই খুব বেশি গরম খাবার খেতে পছন্দ করতেন না। কারণ অতিরিক্ত গরম খাবার আমাদের শরীরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যা তিনি সেই সময়েই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।
বাসি খাবারও নবীজি (সা.)-এর একটি অপছন্দের খাবার ছিল। কারণ বাসি খাবার খেলে শরীরে নানা রোগ জীবাণু প্রবেশ করার সুযোগ পায়। তাই তিনি সব সময় এই খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতেন।
সুস্থ থাকতে নবীজি (সা.)-এর কখনও দুর্গন্ধযুক্ত খাবার খেতেন না। অনেকেরই দুর্গন্ধযুক্ত সিগারেট, মদ পান করার মতো বদঅভ্যাস রয়েছে। যা নবীজি (সা.)-এর সবচেয়ে অপছন্দের খাবারের মধ্যে রয়েছে। সুস্থ ও সুন্দর জীবনের জন্য এই সব খাবার থেকে তিনি আমাদের দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
সিলেটভিউ২৪ডটকম/ইআ-০২