গত ১ মে ছিলো শ্রমিক দিবস। দিবসটি বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে নানা কর্মসূচিতে পালিত হয়। প্রতিবছরই এভাবে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হলেও দেশে শ্রমিকদের ভাগ্যবদলের গল্প নেই বললেই চলে। বিশেষ করে চা শ্রমিকদের জীবনগাঁথা খুবই বেদনাদায়ক, কোনো মে দিবসই ফেরাতে পারে না তাদের ভাগ্য।

জানা গেছে, দেশে বর্তমানে চা-জনগোষ্ঠী ৭ লক্ষাধিক। তার মধ্যে দেশের নিবন্ধিত ১৬৭টি চা-বাগানে নিবন্ধিত শ্রমিক রয়েছেন প্রায় ৯৪ হাজার। আর অনিয়মিত শ্রমিক রয়েছেন ৪০ হাজার। ২০০৭ সালে প্রথম শ্রেণির বাগানগুলোতে নিবন্ধিত শ্রমিকের মজুরি ছিল দৈনিক ৩২ টাকা ৫০ পয়সা; ২০০৯ সালে ৪৮ টাকা; ২০১৩ সালে হয় ৬৯ টাকা; ২০১৫ সালে ৮৫ টাকা; ২০১৬ সালে ১০২ টাকা; ২০১৮ সালে ১২০ টাকা এবং বর্তমানে ১৭০ টাকা।


দেশের চা-বাগানে কর্মরত শ্রমিকরা তাদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে গত বছরের ৯ আগস্ট আন্দোলনে নামেন। চলে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট, সড়ক-মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ। দফায় দফায় শ্রমিকদের সঙ্গে বাগান মালিকপক্ষ ও সরকারের প্রতিনিধিরা বৈঠক করলেও তা সফল হয়নি।

পরে ওই বছরের ২৭ আগস্ট গণভবনে মালিকপক্ষ ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে আড়াই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চা-শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ১৭০ টাকা ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে প্লাকিং বোনাস (বাড়তি পাতা তোলার জন্য অর্থ), ভর্তুতি মূল্যে রেশন বৃদ্ধি, চিকিৎসাসুবিধা, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের পেনশন, চা-শ্রমিকদের পোষ্যদের শিক্ষা বাবদ ব্যয়, রক্ষণাবেক্ষণ, গোচারণভূমি বাবদ ব্যয়, বিনামূল্যে বসতবাড়ি ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ শ্রমিককল্যাণ কর্মসূচি, উৎসব ভাতা, ভবিষ্যৎ-তহবিল, বার্ষিক ছুটি, অসুস্থতা ছুটি বৃদ্ধি, বেতনসহ উৎসব ছুটি আনুপাতিক হারে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে। কিন্তু এসব সিদ্ধান্তের অনেকগুলো আজও বাস্তবায়ন হয়নি। এ নিয়ে শ্রমিকরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ।

তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত তারা বিনাবাক্যে মেনে নিয়েছেন। তবে এখনও মালিকপক্ষ অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রেখেছে তাদের।

দেশের চা-শিল্পের ইতিহাস ১৬৯ বছরের হলেও আজও তাদের ভূমির অধিকার দেওয়া হয়নি। বাগানের জমিতে মালিকপক্ষের নির্মিত ঘরের অধিকাংশই জরাজীর্ণ। ৮ হাত বাই ১২ হাতের ঘরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন তারা। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতে ঘরগুলো মেরামতের বিধান থাকলেও তা করা হচ্ছে না। এমনকি নিজেরা ঘরের মেরামত করতে চাইলেও কোম্পানি (বাগান কর্তৃপক্ষ) বাধা দেয়। এ ছাড়া চা-শ্রমিকদের বকেয়া মজুরির ৪ হাজার টাকা করে প্রথম কিস্তি মালিকপক্ষ পরিশোধ করলেও বাকি টাকা দেওয়া হচ্ছে না। কবে দেওয়া হবে তা-ও তাদের জানানো হচ্ছে না।

কয়েকজন চা শ্রমিকের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতে চা-শ্রমিকদের কাঁচা ঘরবাড়ি কোম্পানি মেরামত করে দেওয়ার কথা। এখন বর্ষা মৌসুমের শুরুতে ঘর মেরামত করে না দেওয়ায় অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে তারা বসবাস করছেন। এ ছাড়া আরও সমস্যায় রয়েছেন চা-বাগানের শ্রমিকরা। এ নিয়ে গত ২৫ এপ্রিল সিলেট বিভাগের বিভিন্ন চা বাগানে তিন ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করেন শ্রমিকরা।

তারা আরও বলেন, ‘এখনও দেশে চা-বাগানগুলোর শ্রমিকরা নিগৃহীত ও অবহেলিত। শত শত বছর ধরে আমরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে সংসার চালালেও মালিকপক্ষ আমাদের ব্যাপারে উদাসীন। অমানুষিক পরিশ্রমের পরও আমরা শ্রমবৈষম্যের শিকার। প্রতিবছর শ্রমিক দিবসে সভা-সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে আমাদের কথা বলা হলেও পরে তা আড়ালেই থেকে যায়।’

সাবিত্রী মৃধা নামের এক নারী শ্রমিক বলেন, ‘চা-বাগানে আমাদের মজুরি হলো ১৭০ টাকা। কিন্তু বাজারে তো জিনিসের অনেক দাম। বর্তমানে এ টাকা দিয়ে চলা দায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি আমাদের প্রতি আরেকটু সদয় হতেন, তবে আমরা পরিবার নিয়ে একটু শান্তিতে বাঁচতে পারতাম। আমাদের ঘরগুলোও বসবাসের অনুপযোগী। এগুলো মেরামত ও আমাদের ভূমির অধিকার দেবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাচ্ছি।’

ব্রিটিশ ঘাটুয়াল নামের এক শ্রমিক বলেন, ‘চা-বাগানের অনেক শ্রমিক পরিবারে সদস্যসংখ্যা ৭ থেকে ১০ জন। তবে বাগানের কাজ পায় পরিবারের ১ জন সদস্য। অধিকাংশ শ্রমিক পরিবারই ওই ১৭০ টাকা মজুরির ওপর নির্ভরশীল। এবারের মে দিবসে আমাদের মজুরি বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও মালিকপক্ষের কাছে দাবি জানাচ্ছি।’

চা শ্রমিক নেতা মানিক গোয়ালা বলেন, ‘বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়টি বিবেচনা করে আমাদের মজুরির বিষয়টি যদি পুনর্বিবেচনা করা হতো, তাহলে আমরা দুবেলা দুমুঠো খেয়ে বাঁচতে পারব।’

তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও আমাদের বাড়তি হাজিরা যেটা দেওয়ার কথা, তা দেওয়া হচ্ছে না। এ পর্যন্ত মাত্র ৪ হাজার টাকা পেয়েছি। বাকি টাকা দ্রুত দেওবার দাবি জানাচ্ছি।’

সিলেট চা জনগোষ্ঠী ছাত্র যুব কল্যাণ পরিষদের নেতা সুজিত বাড়াইক বলেন, ‘আমরা প্রতিবছর শ্রমিক দিবসে শ্রমিকদের অধিকারের কথা বলি। কিন্তু পরিস্থিতি যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে গেছে। ২০২২ সালে আন্দোলনের পর প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে। যখন মজুরি বেড়েছে তখন বাজারে দ্রব্যমূল্য যা ছিল তা থেকে এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে শ্রমিকদের ভাগ্যের পরিবর্তনের যে প্রত্যাশা ছিল তা হয়নি। আশা করছি প্রধানমন্ত্রী মমতাময়ী মা হিসেবে চা-শ্রমিকদের বিষয়টি বিবেচনা করে আরও কিছুটা মজুরি বৃদ্ধি করে দেবেন।’

সিলেটভিউ২৪ডটকম / ডালিম