সাধারণত পাঁচ বছর পরপর নতুন পে-স্কেল ঘোষণা করে সরকার। সবশেষ ২০১৫ সালে নতুন পে-স্কেল পান সরকারি চাকরিজীবীরা। তারপর কেটে গেছে আট বছর। করোনা পরবর্তী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় নতুন পে-স্কেলের দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। কিন্তু এবারও তারা পে-স্কেল পাচ্ছেন না।

 


অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলমান মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াকে বিবেচনায় নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বস্তি দিতে নতুন পে-স্কেলের পরিবর্তে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার চিন্তাভাবনা রয়েছে সরকারের। আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আগামী অর্থবছরের বাজেট চূড়ান্ত করার বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে এ বিষয়ে প্রস্তাব উঠতে পারে।

 

২০০৯ সালে সপ্তম পে-স্কেল কার্যকর করার পর ২০১৫ সালে প্রায় শতভাগ বেতন বাড়িয়ে নতুন পে-স্কেল কার্যকর করে সরকার। তারপর থেকে প্রতিবছর জুলাই মাসে ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পাচ্ছেন চাকরিজীবীরা। কিন্তু বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দাবি করে নতুন পে-স্কেলের দাবি তুলেছের তারা। তবে অর্থনীতিতে সংকটের কারণে আপাতত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো বা পে-স্কেল দেওয়ার পরিকল্পনা সরকারের নেই।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সরকারি চাকরিজীবীরা দীর্ঘদিন ধরে আসন্ন বাজেটে নতুন পে-স্কেলের আশা করছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তা নাকচ করে দিয়েছেন। সরকারি চাকরিজীবীরা পে-স্কেলের বদলে আগামী অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত মহার্ঘভাতা পেতে পারেন। চলমান মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াকে বিবেচনায় নিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বিশেষ এ ভাতার জন্য প্রস্তাব তৈরি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

 

এ বিষয়ে অর্থবিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, ‘২০১৫ সালে বাস্তবায়ন করা বেতন স্কেলের জন্য গঠিত পে-কমিশন নতুন করে আর কোনো কমিশন গঠন না করার সুপারিশ করেছিল। তার বদলে এটি সরকারি চাকরিজীবীদের প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার সুপারিশ করেছিল।’

 

তিনি আরও বলেন, ‘বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার ৫ শতাংশের বেশি হলে ইনক্রিমেন্টের হারও সে অনুযায়ী সমন্বয় করার পরামর্শও দিয়েছিল পে-কমিশন। কিন্তু সরকার ওই সুপারিশ বাস্তবায়ন করেনি। ফলে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হলেও চাকরিজীবীরা ৫ শতাংশ হারেই ইনক্রিমেন্ট পাচ্ছেন।’

 

চলতি বছরের জানুয়ারিতে সংসদে পে-স্কেলের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে নতুন করে পে-স্কেল দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন।

তারপরও নির্বাচনী বছর হওয়ায় পে-স্কেল পাওয়ার আশা নিয়ে আন্দোলন করছেন সরকারি চাকরিজীবীরা। যদি পে-স্কেল না দেওয়া হয় তবে মহার্ঘ ভাতার ক্ষেত্রে চাকরিজীবীদের দাবি হলো ৫০ শতাংশ। তাদের এ দাবিও পূরণ হচ্ছে না। সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হতে পারে। এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে যে কয়টি মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হয়েছে সবকটি ছিল ২০ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১৩ সালেও ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দিয়েছিল বর্তমান সরকার। ওই সময় সর্বনিম্ন ১৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন বেড়েছিল।

জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘নতুন পে-স্কেল দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। তবে চিকিৎসা ভাতা, শিক্ষা ভাতা, টিফিন ভাতা গ্রেড অনুসারে বাড়তে পারে। এ মুহূর্তে এর চেয়ে অন্য কোনো চিন্তা আপাতত নেই। সরকারের ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক সংকটের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।’

 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘তাদের দাবি-দাওয়ার বিষয়টি আমরা অবগত। কিন্তু অধিকাংশ দাবি-দাওয়াই অর্থ সংশ্লিষ্ট। এগুলো পূরণের জন্য সরকারের শীর্ষ মহল ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন। তাই এখানে আমাদের তেমন কিছু করার নেই।’

 

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাজেটে বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে মহার্ঘ ভাতা খাতে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। আজ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাজেট চূড়ান্তকরণ-সংক্রান্ত বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠকে উপস্থিত থাকার কথা।

 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি চাকরিজীবী প্রায় ১৪ লাখ। তবে বিভিন্ন করপোরেশন এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকসহ এ সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ। চলতি অর্থবছরে বিভিন্ন খাতে ব্যয়সংকোচ করেছে সরকার। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা থেকে ১,০৯৩ কোটি টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে।

 

২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বেতন-ভাতার জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ৭৩,১৭৩ কোটি টাকা। তবে আসন্ন অর্থবছরে বেতন-ভাতাখাতে ৭৭,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রাক্কলন করেছে অর্থবিভাগ। মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে এ অঙ্ক বাড়বে।

 

মূল্যস্ফীতির চাপ ও বকেয়া ভর্তুকির দায় মেটানোর বাড়তি ব্যয় মাথায় রেখে আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ের খসড়া করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়, যা আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাক্কলিত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট দেওয়া হয়।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/সুনু/ইআ-০৪