সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পর্তুগাল থেকে পরিচয়। পরিচয় থেকে পরিণয়। ভালোসার টানে একপর্যায়ে পরিবারের অমতে টেলিফোনে বিয়েও করে ফেলেন দেশে থাকা ‘প্রেয়সীকে’। অভিভাবকরা শুরুর দিকে রেগে থাকলেও শেষমেষ মেনে নেন।

কথা হয়- ‘ভালোসার রাণীকে’ আইইএলটিএস করিয়ে প্রথমে নিয়ে যাবেন যুক্তরাজ্যে, নিজেও চলে আসবেন সেখানে। কিন্তু সব হিসেবে গুলিয়ে যায় ভালোবাসার মানুষটির ‘প্রতারণায়’। পর্তুগালে থাকা স্বামীকে রেখে অন্যকে স্বামী বানিয়ে যুক্তরাজ্য পাড়ি জমাতে চান স্ত্রী। অনেক বুুঝিয়েছিলেন স্ত্রীকে। এমনকি আত্মহত্যা করে ফেলতে পারেন বলে হুঁশিয়ারও করেছিলেন লুৎফাকে। কিন্তু পারেননি বুঝাতে- মানাতে। অবশেষে একবুক অভিমান নিয়ে- ভালোবেসে বিয়ে করা লুৎফাকে চিরদিনের মতো ‘মুক্ত’ করে সাজু চলে যান পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে, নিজের প্রাণ নিজেই হনন করে।


সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার দয়ামীর ইউনিয়নের খাগদিওর গ্রামের সুরুজ আলীর ছেলে নুরুল ইসলাম সাজু (২৫) পর্তুগালে আত্মহত্যা করেন গত ১৬ মে। ওই দিন স্থানীয় সময় বিকাল ৩টার দিকে পর্তুগালের লিসবন শহরে তার থাকার কক্ষে দরজার পর্দা দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন প্রবাসী এই যুবক। রাত ১১টার দিকে দেশে থাকা পরিবারের কাছে খবরটি পৌঁছান সে দেশে থাকা সাজুর বন্ধু আতিকুর রহমান।

৬ ভাই-বোনের মধ্যে সাজু সবার ছোট। ২০১৯ সালে প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ উমান যান তিনি। দুই বছর পর সেখান থেকে পরিবারের সুখের কথা চিন্তা করে পাড়ি জমান স্বপ্নের ইউরোপে। ২০২১ সালে গ্রিস হয়ে তিনি পুর্তগালে পৌঁছান। সেখানে থাকা অবস্থায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পরিচয় হয় একই উপজেলার তাজপুর ইউনিয়নের দরাজপুর গ্রামের কুয়েত প্রাবাসী লুৎফুর রহমানের মেয়ে লুৎফা বেগমের সঙ্গে।

মোবাইল ফোনে ভিডিও কলের মাধ্যমে ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর লুৎফাকে বিয়েও করে ফেলেন সাজু। প্রথমে অসম্মতি থাকলেও কিছুদিন পর দুই পরিবার এ বিয়ে মেনে নেয়। পরে সাজু তার বাড়িতে লুৎফাকে উঠার জন্য বললে তিনি রাজি হননি। 

কিছুদিন আগে স্ত্রী লুৎফা আই.ই.এল.টি.এস করার ইচ্ছে প্রকাশ করে স্বামীর কাছে টাকা চান। তখন সাজু আই.ই.এল.টি.এস করার সকল খরচ বহনসহ যুক্তরাজ্যে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন। কথা ছিলো- লুৎফা সেখানে গেলে সাজুও যুক্তরাজ্যে চলে আসবেন। স্ত্রীকে যুক্তরাজ্য নিতে অনেক টাকার প্রয়োজন তাই পরিবারের সদস্যদেরও টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেন সাজু এক সময়।

২ মাস আগে ছেলের কথায় একটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ১ লক্ষ টাকা যুক্তরাজ্য যাওয়ার জন্য ছেলের বউ লুৎফার হাতে তুলে দেন সাজুর মা আসিয়া বেগম। সব কিছু ঠিকাক থাকলেও বিপত্তি বাধে যুক্তরাজ্য ভিসার আবেদনে। সাজুর কথামতো স্ত্রী লুৎফা স্টুডেন্ট ভিসার আবেদন করেন। কিন্তু অর্থলোভে অন্য একজনকে স্বামী বানিয়ে যুক্তরাজ্যে নেওয়ার পায়তারা করেন। বিষয়টি জেনে ফেলে সাজু এবং এতে বাধা দেন। বিষয়টি নিয়ে গত কয়েকদিন থেকে সাজু ও লুৎফার মধ্যে ঝগড়া চলছিলো। 

কিছুদিন আগে সাজু তার মায়ের কাছে ফোনে বিষয়টি জানায় এবং লুৎফাকে বুঝাতে বলেন। এসময় সাজুর মা ছেলেকে সান্তনা দিয়ে লুৎফার সঙ্গে কথা বলার আশ্বাস দিয়ে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কলে দিলেও রিসিভ করেনি লুৎফা। তাই আর এ বিষয় নিয়ে কথা বলারও সুযোগ হয়নি সাজুর মায়ের। এরই মাঝে গত মঙ্গলবার রাতে খবর পান- তার ছেলে আত্মহত্যা করেছেন।

শুক্রবার বিকেলে এ প্রতিবেদক যান সাজুর বাড়িতে। নিস্তব্ধ বাড়ির পরিবেশ কিছুক্ষণ পর পরই কাতরে উঠছিলো সাজুর মা-বাবা, ভাই-বোনদের কান্নায়। 

সাজুর মা ধরা কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে টাকা-পায়সা দিয়ে তার স্ত্রীকে লন্ডন নেওয়ার জন্য সকল কাজ করেছে। কিন্ত তার স্ত্রী লুৎফা স্টুডেন্ট ভিসার কথা বলে অন্য ব্যক্তির সঙ্গে (কন্ট্রাক্ট ম্যারিজে) চুক্তিবদ্ধ হয়ে যুক্তরাজ্যে যাওয়ার পায়তারা করলে সাজু তা মেনে নিতে পারেনি। কিছুদিন আগে সে আমাকে কল দিয়ে এসব বিষয়ে বলে। আমি তখন আমার ছেলেকে অনেক বুঝালেও আর বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। আমার ছেলেকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে তার স্ত্রী লুৎফা। আমি এর বিচার চাই।’

সাজুর বড় বোন মিলি বেগম বলেন, ‘প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আত্মসাত ও আত্মহত্যার প্ররোচণার বিষয়টি তুলে ধরে বৃহস্পতিবার ওসানীনগর থানায় লুৎফার সঙ্গে আমার ভাইয়ের বিয়ের সকল প্রমাণসহ একটি লিখিত অভিযোগ দিলেও পুলিশ তা মামলা হিসেবে গ্রহণ করছে না। আমার ভাই আত্মহত্যা করলেও লুৎফার পরিবারের কেউ আমাদের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ করেনি। আমরা খবর পেয়েছি- দুই-এক দিনের ভিতরে লুৎফা যুক্তরাজ্যে চলে যাচ্ছে। আমি প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অনুরোধ জানাই- বিষয়টি যেন গুরুত্ব দিয়ে আইনিভাবে দেখা হয়।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাজুর স্ত্রী লুৎফা বেগম ও শ্বাশুড়ি ছাবিলা বেগমের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তারা রিসিভ করেননি। 

ওসমানীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাছুদুল আমিন সিলেটভিউ-কে বলেন, ‘সাজু প্রবাসে আত্মহত্যা করেছেন বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে জানতে পেরেছি। কিন্তু এই বিষয়ে পরিবার ডেথ সার্টিফিকেটসহ অনান্য প্রমাণাদী দিতে না পারায় মামলা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। সঠিক কাগজপত্র পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’


সিলেটভিউ২৪ডটকম / আর.পি / ডালিম