সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে। বুধবার (২১ জুন) সকাল ৮টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়া সিলেটে চলে ভোটগ্রহণ। ভোটগ্রহণের সময় বিকাল ৪টা পর্যন্ত থাকলেও কয়েকটি কেন্দ্রের ভেতরে ভোটারদের লাইন থাকায় ৪টার পরেও কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ করা হয়। 

সকাল ৮টা থেকে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)-এর মাধ্যমে সিলেটে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। ভোটগ্রহণ শুরুর আগে- সকাল ৭টা থেকেই লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন ভোটাররা। ইভিএম-এ ভোট দেওয়া নিয়ে এক ধরণের কৌতুহল কাজ করে তরুণ ভোটারদের মধ্যে। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় নারী-পুরুষ ভোটাররা ভোট দিতে শুরু করেন। প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রে পুরুষদের চাইতে নারী ভোটারের ছিলো লাইন দীর্ঘ। তাদের মাঝেও ছিলো বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা। 


এবারের সিসিক নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র ছিলো মোট ১৯০টি। এর মধ্যে  ১৩২ কেন্দ্রকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ (ঝুঁকিপূর্ণ) হিসেবে চিহ্নিত করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এবার বর্ধিত এলাকাসহ এবার মোট ৪২টি ওয়ার্ড নিয়ে সিসিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৮৭ হাজার ৭৪৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩৬৩ জন ও ২ লাখ ৩৩ হাজার ৩৮৪ জন নারী ভোটার।

এবারের সিসিক নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জাকের পার্টি- এই তিনটি রাজনৈতিক দলের প্রার্থীসহ মোট ৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। প্রার্থী ছিলেন ৮ জন। তবে বরিশাল সিটি নির্বাচনের দিন ভোট থেকে সরে দাঁড়ান ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী হাফিজ মাওলানা মাহমুদুল হাসান।

মেয়র পদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী নৌকা প্রতীকে, জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল লাঙ্গল প্রতীকে, স্বতন্ত্র প্রার্থী যথাক্রমে মো. আব্দুল হানিফ কুটু ঘোড়া প্রতীকে, মো. ছালাহ উদ্দিন রিমন ক্রিকেট ব্যাট প্রতীকে, মো. শাহজাহান মিয়া বাস প্রতীকে ও মোশতাক আহমেদ রউফ মোস্তফা হরিণ প্রতীকে এবং জাকের পার্টির প্রার্থী জহিরুল ইসলাম গোলাপ ফুল প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী সিসিক নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। মেয়র পদে ৭ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও মূল লড়াই হয় নৌকা আর লাঙ্গলের প্রার্থীর মধ্যে।

সিসিক নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ৪২ নির্বাহী ও ১৪ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে ছিলেন। ১০ প্লাটুন বিজিবি, র‍্যাব, পুলিশ ও আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ৭ হাজার সদস্যকে মাঠে নামানো হয়। ১৯০ প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ দায়িত্ব পালন করেন সাড়ে ৪ হাজারেরও অধিক ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা।

গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকেই কেন্দ্রগুলোতে ভোট গ্রহণের সরঞ্জামাদি পাঠানো শুরু হয়। সন্ধ্যার মধ্যেই সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে নির্বাচন কমিশন।

রাজধানীর আগারগাঁও নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ ইসি সিসিক নির্বাচনের সবকটি ভোটকেন্দ্র ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা দিয়ে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হয়।

গতকাল মঙ্গলবার ভোর থেকেই মহানগরজুড়ে টহল দেওয়া শুরু করে বিজিবি। ১০ প্লাটুন বিজিবি সদস্য বর্তমানে মাঠে ছিলেন। ছিলেন র‍্যাবের বিপুল সংখ্যক সদস্যও। ভোটকেন্দ্র ও কেন্দ্রের বাইরে মোট ২ হাজার ৬০০ পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়। রয়েছে প্রায় ৩ হাজার আনসার সদস্য। সব মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ৭ হাজার সদস্য নির্বাচনী মাঠে ছিলেন।

ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে একজন এসআই, একজন এএসআই ও পাঁচ জন কনস্টেবলসহ মোট ৭ জন পুলিশ সদস্য এবং একজন পিসি, একজন সহকারী পিসি, ৭ জন পুরুষ ও ৫ জন মহিলা আনসারসহ মোট ১২ জন আনসার মিলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মোট ১৭ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। আর সাধারণ ভোটকেন্দ্রে একজন এসআই, একজন এএসআই, চার জন কনস্টেবলসহ মোট ৬ পুলিশ, একজন পিসি, একজন সহকারী পিসি,৭ জন পুরুষ ও ৫ জন মহিলা আনসারসহ মোট ১২ জন আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মোট ১৬ জন সদস্য ছিলেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯০ ভোটকেন্দ্রে ১ হাজার ২৭২ পুলিশ সদস্য ও ২ হাজার ২৮০ জন আনসার সদস্য মিলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মোট ৩ হাজার ৫৫২ জন সশস্ত্র সদস্য নিয়োজিত ছিলেন। এছাড়াও ছিলেন পুলিশের এপিবিএন-এর সদস্যরাও।

ভোটকেন্দ্রের বাইরেও ছিলো বিশেষ নিরাপত্তা বলয়। সিসিকের প্রত্যেক সাধারণ ওয়ার্ডে পুলিশের একটি করে মোট ৪২ ওয়ার্ডে ৪২টি মোবাইল টিম নিয়োজিত করা হয়। প্রতি তিনটি সাধারণ ওয়ার্ডের জন্যে ছিলো পুলিশের ১৪টি স্পেশাল স্ট্রাইকিং ফোর্স। ৪২টি ওয়ার্ডের জন্যে ছিলো র‍্যাবের ২২টি মোবাইল টিম। প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে মোট ৪২ ওয়ার্ডের জন্যে ছিলেন ৪২ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

এছাড়াও নির্বাচনী অপরাধসমূহ আমলে নিয়ে তা সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে বিচার সম্পন্নের লক্ষ্যে ছিলেন বিচার বিভাগের ১৪ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। গত সোমবার থেকেই এই ১৪ জন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে কাজ করছেন। নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে টানা ৫ দিন অর্থাৎ- আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২২ জুন) পর্যন্ত তারা মাঠে থাকবেন।

উল্লেখ্য, ১৮৭৮ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে সিলেট পৌরসভা প্রতিষ্ঠা হয়। পৌরসভা প্রতিষ্ঠার টানা ১২৪ বছর পরে ২০০২ সালের ২৮ জুলাই প্রতিষ্ঠা হয় সিলেট সিটি করপোরেশন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই সিসিকের ৪র্থ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে পরাজিত করে দ্বিতীয় বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন।

ওয়ান-ইলেভেনের সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের ২০০৮ সালে সিসিকের দ্বিতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনের আগেই গ্রেফতার হন কামরান। কারাগারে বন্দি কামরানকেই মেয়র পদে সমর্থন দেয় আওয়ামী লীগ। কারাবন্দি কামরান আনারস প্রতীকে এক লাখেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে আ ফ ম কামালকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন।

২০০৩ সালে সিসিকের প্রথম নির্বাচনেও কামরান বাইসাইকেল প্রতীকে বিজয়ী হয়েছিলেন। বিএনপির এম এ হক মাছ প্রতীকে কামরানের কাছে পরাজিত হন।

প্রতিষ্ঠার প্রায় ১৯ বছর পর ২০২১ সালে সিসিককে বর্ধিত করা হয়েছে। বর্তমানে সিসিকের মোট আয়তন ৭৯ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটার। নতুন করে ১৫টি সাধারণ ওয়ার্ড ও ৫টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড বেড়েছে। বিএনপির দলীয় সিদ্ধান্তে সিসিকের পঞ্চম এই নির্বাচন থেকে বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বিরত থাকেন।


সিলেটভিউ২৪ডটকম / ডালিম