তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, আমাদের প্রান্তিক মানুষদের সমস্যা সুনির্দিষ্ট করা ও কৌশলী চিন্তার মাধ্যমে সমধানের দিকে আগানো খুবই জরুরি। এবং এই পদ্ধতির ধারাবাহিকতা ধরে রাখাটাও সমানভাবে জরুরি।
 

মঙ্গলবার দুপুরে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলস্থ ব্র্যাক লার্নিং সেন্টারে (বিএলসি) সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড) ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)-এর উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য তিনি  এসব কথা বলেন।
 


তিনি আরও বলেন, প্রান্তিকতার সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো মানুষের নিজেকে প্রান্তিক ভাবা, ক্ষমতাহীন ভাবা। নিজেদের শক্তির বহিঃপ্রকাশের সক্ষমতা থাকাটা তাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এ ধরণের কাজেই সাহায্য করছে ব্রাত্যজন রিসোর্স সেন্টার। ধারাবাহিক গবেষণার মাধ্যমে তারা এই কাজ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সাংবাদিকদের দায়িত্বও অনেক, এই গবেষণা তাদেরকে সামনে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

আলোচনার সভায় মূল বিষয় ছিল, “চা শ্রমিক ও হরিজন পরিছন্নতা কর্মীদের ন্যায়্য মজুরির প্রশ্ন ও কর্মপরিবেশ”।
 

অনুষ্ঠানের শুরুতেই চা শ্রমিকের অধিকার নিয়ে দেউন্দি চা বাগানের সাংস্কৃতিক দল 'প্রতীক থিয়েটার'-এর মনোরম গান, নাচ ও নাটক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়।

আলোচনা সভায়  মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সেড’র পরিচালক মি. ফিলিপ গাইন। তিনি বলেন “ শ্রমিকরা যদি কাজ না করতো তবে আমাদের কী হতো? তারপরও তাদের প্রতি এতো বঞ্চনা। চা শ্রমিকরা সারাদিন হাঁটেন, ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সারাদিন দাঁড়িয়ে পাতা তুলেন। ৫-৭ টা বাগান ছাড়া অন্য কোনও বাগানের সেকশনে তাদের জন্য নাই কোনও শৌচাগার। নি:সন্দেহে তাদের কর্মপরিবেশ শোভন নয়। আবার শ্রীমঙ্গলে ৩৬ জন হরিজনের মাসিক বেতন ৫৫০ টাকা। এই বেতন কি কোনও ভাবে ন্যায্য ও গ্রহণযোগ্য?।

আলোচনা সভায় মৌলভীবাজারের বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদ শাখার সভাপতি কান্তি লাল বাসফর সিলেট বিভাগের ৯টি সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভায় হরিজনদের মাসিক বেতনের একটি সার্বিক চিত্র তুলে ধরেন। এই তালিকার সবচেয়ে নিম্নতম বেতন শ্রীমঙ্গলের হরিজন পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের।

তাদের নিয়ে তিনি মন্তব্য করে বলেন, মাসিক বেতন কম হওয়াতে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের কাজের মানের উন্নয়ন হচ্ছে না।
 

অন্যদিকে পেটে ক্ষুধা থাকলে আমরা হিতাহিত জ্ঞান ভুলে যাই, আমাদের অনেকে মদ গাঁজা বিক্রি করে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ৫টি দাবি তুলে ধরার মাধ্যমে এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের হরিজন প্রতিনিধি সুকন বাসফর বলেন, আমরা প্রতিদিন ৪ ঘন্টা কাজ করি, ঝড় হোক তুফান হোক। এমনকি কালকের (বুধবার) মে দিবসেরও ছুটি নাই। এরজন্য আমরা মাসে পাই ৫৫০ টাকা। আমার ছেলে ও স্বামী বেতন ছাড়াই আমাকে সাহায্য করে কাজে। আমার ছেলের খাতা কিনলে কলম কিনতে পারিনা। মাছ-মাংস তো দূরের কথা।” তার বক্তব্যের সাথে সুর মিলিয়ে সাগর হরিজন জানান,“আমরা হরিজনরা কোনও স্বাস্থ্য সুরক্ষা পাই না, পেনশন পাই না, এমনকি দুর্ঘটনা কবলিত হলে কোনও ক্ষতিপূরণ বা ছুটিও পাই না।
 

ট্রেড ইউনিয়ন নেতা রামভজন কৈরী বলেন, আইনের মাধ্যমে বঞ্চনার শিকার করা হচ্ছে বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা, “যখনই চায়ের দাম কমে, এর ফলাফল ভোগ করতে হয় প্রত্যেক চা শ্রমিককে। কিন্তু যখন লাভ হয়, তখন এর ফলাফল আর পৌঁছায় না শ্রমিক পর্যন্ত।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন (বিসিএসইউ)-এর সহ-সভাপতি মিজ জেসমিন আক্তার বলেন, চা বাগানের নারী চা শ্রমিক সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্তে¡ও তাদের কোনও মূল্যায়ন নাই, না বাগানে, না তাদের সংসারে। ন্যায্য পাওনা চাইলেই মালিকের লোকসানের কথা চলে আসে। আবার, প্রতিবাদ করলে নারীদের উপর করা হয় নানা নির্যাতন।’

কমিউনিটির কণ্ঠস্বর হিসেবে আরও বক্তব্য রাখেন চা শ্রমিক ইউনিয়নের কোষাধ্যক্ষ পরেশ কালিন্দি এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল।
শ্রীমঙ্গল কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মাহবুবুল হাসান চা শ্রমিকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “আপনারা বিভিন্ন সেবাদানকারী এনজিও বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিয়ে হলেও আমাদের কাছে আসেন। আপনাদের বাগানের কোনও ছাত্র-ছাত্রী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ণরত থাকলে আমাদের খোঁজ দেন। আমরা তাদের সাহায্য করতে চাই, উপবৃত্তি দিতে চাই।’
 

ভারতের আসামের চা শ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক আইনজীবী সংগঠন নাজদীক-এর উপদেষ্টা মিজ কাত্যিয়ানী চান্দোলা বলেন,  বর্তমানে আসামে চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ২৫০ রুপি, কিন্তু অন্যান্য বেশ কিছু জায়গা যেমন তামিল নাড়–তে মজুরি ৪০০ রুপি। এখন ভারতের সকল রাজ্যের  চা শ্রমিকদের দাবি নিম্নতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সুপ্রীম কোর্টের ফর্মূলা ব্যবহার করে সকল রাজ্যের জন্য নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হোক। কেননা কোভিড পরবর্তীকালীন সময়ে জিনিসপত্রের যেভাবে দাম বেড়েছে, সে অনুযায়ী মজুরি আনুপাতিক হারে বাড়ছে না। যদি ফর্মূলা ব্যবহার করে মজুরি নির্ধারণ করা হতো তবে তাদের মজুরি এখন ৫০০ রুপির বেশি হতো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজিমুদ্দিন খান বলেন,‘ খাত ভিত্তিক মজুরি নির্ধারণ না করে, সব ইউনিয়নের উচিৎ এক হয়ে একটি সার্বজনীন নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা।’


 


সিলেটভিউ২৪ডটকম/সাইফুল/এসডি-১৮৭৭