ছাত্র-জনতার আন্দোলন। ফাইল ছবি।
ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক আন্দোলনে সিলেটে অন্তত ৯ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে সিংহভাগেরই পোস্টমর্টেম (ময়নাতদন্ত) হয়নি। ফলে ভবিষ্যতে এসব হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার পাওয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। কারণ, হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে মরদেহের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে কাজ করে।
হাসপাতাল, পুলিশ, ছাত্র, জনতা এবং স্থানীয় সূত্র মারফত সিলেটে নিহতদের তথ্য পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী সিলেটভিউকে জানান, হাসপাতালে দু’জনের মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়। বাকিদের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই হস্তান্তর করা হয়।
কেন ময়নাতদন্ত হয়নি, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেসি সহায়তা না পাওয়ায় ময়নাতদন্ত করা সম্ভব হয়নি।
ডা. সৌমিত্র বলেন, ‘তখনকার পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত নাজুক। নিহতদের স্বজনরা ছিলেন ভীতসন্ত্রস্ত। তারা দ্রুত মরদেহ নিয়ে যেতে উদগ্রিব ছিলেন। ভয় কাজ করছিল তাদের মধ্যে। আমরা যে মরদেহ মর্গে রাখবো, সময় নেব, সেই অবস্থা ছিল না।’
ফৌজদারি আইনজ্ঞদের মতে, অস্বাভাবিক কোনো মৃত্যু ঘটলে অবশ্যই ময়নাতদন্ত করতে হবে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না থাকলে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা অনেক কঠিন।
আইন বিশেষজ্ঞদের অভিমত, অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে পুলিশ অবশ্যই মরদেহ দেখে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করবেন। এরপর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে ফরেনসিক চিকিৎসেরক কাছে মরদেহ পাঠানো হবে। ফরেনসিক চিকিৎসক ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করবেন, যেখানে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উল্লেখ থাকবে। বিচার যখন শুরু হবে, তখন আদালতে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা না গেলে সঠিক বিচার পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে।
অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরির বিষয়টি আইনেও বর্ণিত রয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ১৭৪ ধারা এবং পুলিশের প্রবিধানের (পিআরবি) ২৯৯ ধারায় এ বিষয়ে বলা আছে।
সিআরপিসির ১৭৪ ধারা অনুসারে, সংশ্লিষ্ট থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বা কোনো পুলিশ কর্মকর্তা কোথাও কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংবাদ পেলে সেই ব্যক্তির মরদেহ কী অবস্থায় পাওয়া গেছে, বাহ্যিক আঘাতের চিহ্ন আছে কিনা প্রভৃতি তথ্য সহকারে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করবেন। মৃত্যুর কারণ বিস্তারিত জানতে এরপর মরদহে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠাবেন।
পিআরবির ২৯৯ ধারায়ও অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি ও ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করার কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। এ ধারায় বলা আছে, অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে পুলিশ ৪৮ নম্বর ফরমে অভিযোগ লিপিবদ্ধ করবেন। প্রত্যেক অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে কেস ডায়েরি তৈরি করে সেটি সংরক্ষণের কথাও বলা আছে এ ধারায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, হাসপাতালের মর্গে ফরেনসিক চিকিৎসক ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন। তিনি প্রথমে মৃতদেহের বাহ্যিক অবস্থার বিশ্লেষণ করেন। শরীরের কোথাও আঘাত আছে কিনা, ক্ষতচিহ্ন আছে কিনা, আঘাতের ধরন কেমন প্রভৃতি বিষয় পরীক্ষা করেন তিনি। শরীরে গুলির চিহ্ন আছে কিনা, চিহ্ন থাকলে সেটি কী ধরনের গুলি, কতো দূর থেকে গুলি করা হয়েছিল, কতোক্ষণ আগে গুলিবিদ্ধ হয় প্রভৃতি তথ্যও চিকিৎসকের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ওঠে আসে। এ ছাড়া মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করে মস্তিষ্ক, লিভার, ফুসফুস প্রভৃতি পরীক্ষা করে দেখেন চিকিৎসক। ফলে শরীরে আঘাত থাকলে, রক্তক্ষরণ হলে বা বিষক্রিয়া হয়ে থাকলে চিকিৎসক সেটা নির্ণয় করতে পারেন।
মূলত এসব কারণেই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
সিলেটের যারা নিহত হয়েছেন, তারা গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন বলে স্বজনদের দাবি। এসব হত্যার ঘটনায় মামলাও হচ্ছে। মামলায় প্রভাবশালীরাও আসামি হয়েছেন। কিন্তু ময়নাতদন্ত না হওয়ায় ভবিষ্যতে মামলায় ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়ে যাচ্ছে।
সিলেটে নিহতদের মধ্যে কেবলমাত্র শাবির রুদ্র সেন এবং সাংবাদিক এ টি এম তুরাবের মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে। বাকি ৭ জনের কারো ময়নাতদন্তই হয়নি।
সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদউল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন সিলেটভিউকে বলেন, ‘হত্যা মামলায় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন অতি অবশ্যই থাকতে হবে। যদি না থাকে, তাহলে বিচার নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যাবে। কারণ, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য।’
তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক আন্দোলনে সিলেটে যারা মারা গেছেন, তাদের সিংহভাগের ময়নাতদন্ত হয়নি, এটা উদ্বেগজনক। এখনও ময়নাতদন্তের সুযোগ আছে। মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে দ্রুত এ কাজ করা যায়।’
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে সিলেট মহানগর পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামকে দুইদিন ধরে কল দিয়ে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। গতকাল বুধবার একাধিকবার তাকে কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। আজ বৃহস্পতিবার তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
পরে উপ-কমিশনার (প্রসিকিউশন) বিএম আশরাফ উল্যাহ তাহেরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সিলেটভিউকে বলেন, ‘ময়নাতদন্ত না হয়ে থাকলে মামলা যখন বিচারিক প্রক্রিয়ায় যাবে, তখন আদালত চাইলে কবর থেকে মরদেহ উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করা সম্ভব। এটা আদালতের এখতিয়ার। তবে ময়নাতদন্ত না হলেও কোনো মরদেহ যখন হাসপাতালে আসে বা হাসপাতালে মারা যায়, তখন অবস্থা দেখে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা নোটস রাখেন। এটিও অনেক সময় আদালতে গ্রহণ করা হয়।’
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ১৮ জুলাই সিলেটের আখালিয়ায় বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া করে পুলিশ। সঙ্গে চলে রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল। পুলিশের ধাওয়ায় ভেলায় চড়ে একটি খাল পার হতে গিয়ে পানিতে ডুবে নিহত হন শাবিপ্রবির কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও পলিমার সায়েন্সেস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রুদ্র সেন।
১৯ জুলাই নগরীর বন্দরবাজার এলাকায় মিছিল বের করে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠন। কিন্তু বাধা দেয় পুলিশ। শুরু হয় সংঘর্ষ। গুলি করে পুলিশ। গুলিতে গুরুতর আহত হন সাংবাদিক এ টি এম তুরাব। হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান তিনি।
৪ আগস্ট সিলেটের গোলাপগঞ্জের ঢাকাদক্ষিণে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানো হয়। এতে নিহত হন গোলাপগঞ্জের দত্তরাই গ্রামের আলাই মিয়ার ছেলে মিনহাজ আহমদ (২৬), নিশ্চিন্তপুর গ্রামের তৈয়ব আলীর ছেলে নাজমুল ইসলাম (২২), আমুড়া ইউনিয়নের শিলঘাট গ্রামের কয়ছর আহমদের ছেলে সানি আহমদ (১৮) ও বরকোট গ্রামের মকবুল আলীর ছেলে তাজ উদ্দিন (৪০), গোলাপগঞ্জ পৌর এলাকার ঘোষগাঁওয়ের মোবারক আলীর ছেলে গৌছ উদ্দিন (২৯), উত্তর কানিশাইল গ্রামের রফিক উদ্দিনের ছেলে ক্বারি মো. কামরুল ইসলাম পাবেল, ও রায়গড় গ্রামের সুরাই মিয়ার ছেলে হাসান আহমদ (২০)। ঘটনার দিন মারা যান ৫ জন। পরে হাসপাতালে ৫ আগস্ট একজন ও ৬ আগস্ট আরেকজন মারা যান।
সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে