তার বাবা জোসে দিনিস ছিলেন পৌরসভার মালি; মা মারিয়া ডলোরেস ছিলেন রাঁধুনি। স্বভাবতই তার শৈশব ছিল নিদারুণ দারিদ্রতার। ছোট্ট একটামাত্র ঘর ছিল তাদের; যেখানে চার সন্তানকে নিয়ে থাকতেন দিনিস-মারিয়া। এই অভাব-অনটনের জীবন পেরিয়ে একটা পর্যায়ে তিনিই হয়ে গেলেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী অ্যাথলেটদের একজন!
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো-পর্তুগিজ যুবরাজ! বিভীষিকার দিন পেরিয়ে বহু বছর ধরে যার জীবনে কেবলই আলোর বর্ণচ্ছটা। সাফল্যের অবিশ্বাস্য সব মণি-মুক্তায় ভরপুর যার অর্জনের ঝুড়ি। অপ্রতিরোধ্য ‘গোলমেশিনে’ পরিণত হওয়া রোনালদোর ভাণ্ডারে সর্বশেষ যুক্ত হওয়া রত্ন হচ্ছে ৯০০ গোলের মাইলফলক! পর্তুগালের লিসবন থেকে যে কিশোরের যাত্রা শুরু, ক্যারিয়ারের গোধূলিবেলায় এসেও তার পায়ে লুটিয়ে পড়ছে সোনালি সাফল্য।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এখন দুনিয়ার একমাত্র ফুটবলার, যিনি অফিশিয়াল ম্যাচে ৯০০ গোলের রেকর্ড গড়েছেন। ২০০২ সালের ৭ অক্টোবর নিজের পেশাদার ক্যারিয়ারের পঞ্চম ম্যাচে প্রথম গোলের দেখা পেয়েছিলেন তিনি। গেল ৫ সেপ্টেম্বর রাতে উয়েফা নেশনস লিগে নিজের ক্যারিয়ারের ১,২৩৬তম ম্যাচে ৯০০ গোলের মাইলফলক ছুঁয়ে যান রোনালদো।
যাত্রাপথ
পর্তুগালের মাদেইরা অঞ্চলের ফানচালে ১৯৮৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জন্ম ক্রিস্টিয়ানে রোনালদোর। যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের নাম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে জোসে দিনিস ও মারিয়া ডলোরেস কনিষ্ঠতম ছেলের নাম রাখেন রোনালদো। অভাব-অনটনের সংসারে খানিকটা স্বস্তির জন্য তার বাবা মালির চাকরির বাইরে স্থানীয় ফুটবল ক্লাব অন্দোরিনহার কিটম্যানের দায়িত্ব পালন করতেন। সে সুবাদেই ওই ক্লাবে যখন রোনালদোর হাতেখড়ি, তখন তার বয়স মাত্র ৭। তার জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়ার শুরুটা হয় ১০ বছর বয়সে; স্পোর্টিং সিপির তিন দিনের ট্রায়ালে যোগ দিয়ে। ট্রায়ালে মনোযোগ কেড়ে নেওয়া রোনালদোর নতুন ঠিকানা হয় লিসবন স্পোর্টিংয়ের ইয়ুথ একাডেমি। ফুটবলে মনোযোগ বাড়াতে ১৪ বছর বয়সে ছেড়ে দেন পড়ালেখা। পরের বছর আসে ভীষণ এক ঝড়-হৃদস্পন্দনে ধরা পড়ে সমস্যা! তবে অস্ত্রোপচার করিয়ে সেই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া রোনালদোকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
৬ ফুট ১ ইঞ্চি উচ্চতার এই ফরোয়ার্ড ২০২২ সালে স্পোর্টিং লিসবনের মূল দলে জায়গা করে নেন, পঞ্চম ম্যাচে করেন পেশাদার ক্যারিয়ারের প্রথম গোল; তাও ছিল জোড়া গোল। এরপর কেবলই এগিয়ে যাওয়া। তার দুরন্ত ফুটবল ঝড় তুলে ক্রীড়াঙ্গনে। ২০০৩ সালের ১২ আগস্ট ইংলিশ ফুটবলের ‘পাওয়ার হাউস’ হিসেবে খ্যাত ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে নাম লেখান রোনালদো। সেখানে মাতিয়ে ২০০৯ সালের জুলাইয়ে স্প্যানিশ ফুটবলে পা রাখেন তিনি; তখনকার রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে যোদ দেন রিয়াল মাদ্রিদে। রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ে শেষমেশ ২০১৮ সালের জুলাইয়ে রোনালদো পাড়ি দেন ইতালিতে; এবারের ক্লাব জুভেন্টাস। সেখান থেকে ২০২১ এর আগস্টে ফের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। তবে এবার আর সুখকর হয়নি ইংলিশ ক্লাবটিতে তার যাত্রা। পরের বছরই ক্লাব থেকে মুক্ত হয়ে যান সিআর৭। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সৌদি প্রো-লিগের ক্লাব আল নাসরে যোগ দিয়ে খেলে চলেছেন সেখানেই।
অনন্য ৯০০
বয়স ছাড়িয়ে গেছে ৩৯। কিন্তু এখনও মাঠে ক্ষিপ্র। সঙ্গে গোলের অদম্য ক্ষুধা। আর তাই রোনালদো করে চলেছেন গোলের পর গোল, গড়ছেন রেকর্ড।
সৌদি প্রো-লিগে গেল ২৮ আগস্ট আল ফেইহার বিপক্ষে ৪-১ গোলের ব্যবধানে জিতে আল নাসর। সে ম্যাচে ফ্রি কিক থেকে দারুণ এক গোল করেন রোনালদো। এটাও একটা রেকর্ড যে, ইতিহাসের একমাত্র ফুটবলার হিসেবে টানা ২৩ মৌসুমে ফ্রি কিক থেকে এক বা একাধিক গোল করলেন তিনি। এ গোলে তার পেশাদার ক্যারিয়ারের গোলসংখ্যা হয় ৮৯৯। এরপর চূড়ায় পা রাখতে কেবলই আরেকটি ম্যাচের অপেক্ষা। সে ম্যাচটি হয় গত ৫ সেপ্টেম্বর রাতে, উয়েফা নেশনস লিগে। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে জেতা পর্তুগালের জয় পুরোটাই রাঙিয়ে দেন ‘গোলমেশিন’ রোনালদো। ম্যাচের ৩৪ মিনিটে গোল করে ৯০০’র মাইলফলকে পা রাখেন তিনি। অবিশ্বাস্য এই অর্জনের পর কোথায় বাঁধভাঙা উল্লাসে মাতবেন, তা না। বরং বসে পড়েন হাঁটু মুড়ে সবুজ গালিচায়, হয়ে পড়েন আবেগাপ্লুত। সতীর্থদের অভিনন্দনের ঢালিতে ভেসে যান সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার।
ম্যাচ শেষে নিজের উচ্ছ্বাস গোপন রাখেননি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। বলেন, ‘আমার কাছে এই গোলটা বিশেষ কিছু, বিশেষ মুহূর্ত। অনেকদিন ধরে এই মাইলফলক ছোঁয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। জানতাম একদিন পৌঁছে যাবো। আমি বিশ্বাস করতাম, খেলা চালিয়ে গেলে এই মাইলফলকে পৌঁছাতে পারবো।’ তবে এখানেই থেমে থাকতে চান না তিনি। তার লক্ষ্য যে এক হাজার গোল, সেটাও আরেকবার জানিয়ে দিয়েছেন দৃঢ়তায়।
কোন জার্সিতে কতো গোল
স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদে আক্ষরিক অর্থেই রাজকীয় সময় কাটিয়েছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। এ ক্লাবের হয়ে ৪৩৮ ম্যাচে তার গোলসংখ্যা ৪৫০টি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জার্সি গায়ে সিআর৭ খেলেছেন ৩৪৬ ম্যাচ, গোল করেন ১৪৫টি। ইতালির ক্লাব জুভেন্টাসের হয়ে পর্তুগিজ যুবরাগ ১৩৪ ম্যাচে করেন ১০১ গোল। সৌদির আল নাসরের হয়ে এখন অবধি ৬৮ গোল পেয়েছেন তিনি। নিজের প্রথম পেশাদার ক্লাব স্পোর্টিং লিসবনের হয়ে ৩১ ম্যাচে ৫টি গোল করেছিলেন তিনি।
ক্লাবের বাইরে জাতীয় দলের জার্সিতেও সমুজ্জ্বল রোনালদো। ২১৩ ম্যাচে করেছেন ১৩১ গোল। আন্তর্জাতিক ফুটবলে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা এবং সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডটাও রোনালদোর।
যেভাবে এতো গোল
ডান পায়ের ফুটবলার রোনালদো। মেসির শক্তি যেমন বাম পা, রোনালদো তেমনই ডান পা। তিনি সবচেয়ে বেশি গোলও করেছেন এই পা দিয়ে। ডান পায়ের শটে রোনালদোর গোলসংখ্যা ৫৭৪টি। বাম পা দিয়ে এই তারকা করেছেন ১৭৩টি গোল।
এর বাইরে হেড দিয়ে গোল করায়ও কম যান না সিআর৭। হেড থেকে তিনি করেছেন ১৫১টি গোল। এছাড়া দুটি গোল তিনি অন্যভাবে করেন; একটি ডান উরুর স্পর্শে, আরেকটি বাঁ কনুই দিয়ে।
যে মৌসুমে যতো গোল
শুরুর সময়, অর্থাৎ ২০০২-০৩ মৌসুমে রোনালদো খুব বেশি গোল করতে পারেননি। ওই মৌসুমে তার গোলসংখ্যা ছিল ৫টি। পরের মৌসুমে করেন ৮টি। এর পরের পাঁচ মৌসুমে তার গোলসংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৬টি, ১৫টি, ২৮টি, ৪৬টি ও ২৭টি। পর্তুগিজ মহাতারকা ২০০৯-১০ মৌসুমে ৩৪টি গোল করেন। ২০১০-১১ মৌসুম থেকে শুরু করে ২০১৭-১৮ মৌসুমের প্রতিটিতে পঞ্চাশের বেশি গোল করেন রোনালদো! এ সময়ে তার গোলসংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৫৬টি, ৬৯টি, ৫৯টি, ৬২টি, ৬৬টি, ৫৭টি, ৫৬টি ও ৫৪টি। এর মধ্যে ২০১১-১২ মৌসুমে করা ৬৯টি গোল এক মৌসুমে তার ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ। এগুলোর মধ্যে রিয়ালের হয়ে ৬০ গোল আর পর্তুগাল জাতীয় দলের হয়ে ৯ গোল করেন তিনি। ওই মৌসুমে ঠিক ৬৯টি ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি।
জুভেন্টাসে যোগ দেওয়ার পর ২০১৮-১৯ মৌসুমে তার গোল করায় কিছুটা ধাক্কা আসে। সেবার করেন ৩১ গোল। পরের মৌসুমে অবশ্য ছন্দে ফিরেন, করেন ৪৮ গোল। ২০২০-২১ মৌসুমে ৪৬ গোল করার পর ফের খানিকটা ছন্দহারা। পরের দুই মৌসুমে করেন ৩২ ও ২৩ গোল। গত মৌসুমে অবশ্য মুড়িমুড়কির মতো গোলের ধারায় ফেরেন, করেন ৫৭ গোল। চলতি মৌসুমে এখন অবধি (৬ সেপ্টেম্বর) করেছেন ৫ গোল।
‘প্রিয়’ প্রতিপক্ষ
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো যখন যেখানে খেলেছেন, তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ‘গোল’। ফলে সবখানেই তাকে সফল হিসেবে দেখা যায়। তবে যে লিগে তিনি বেশি খেলেছেন, সেই লা লিগারই কোনো দলের বিপক্ষে তার গোলসংখ্যা সবচেয়ে বেশি হবে, এটা অনুমেয়ই। স্প্যানিশ লা লিগার দল সেভিয়ার বিপক্ষে রোনালদো করেন ২৭ গোল। একই লিগের আরেক দল, যারা রিয়াল মাদ্রিদের ‘নগর প্রতিদ্বন্দ্বি’, সেই অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে তার গোলসংখ্যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৫টি। এছাড়া হেতাফের বিপক্ষে ২৩টি, সেল্টা ভিগোর বিপক্ষে ২০টি, বার্সেলোনার বিপক্ষে ২০টি, বিলবাও ও মালাগার বিপক্ষে সমান ১৭টি করে এবং সোসিয়েদাদ, এস্পানিওল ও ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে সমান ১৫টি করে গোল করেন রোনালদো।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে রোনালদো সবচেয়ে বেশি ১১টি গোল করেছেন লুক্সেমবার্গের বিপক্ষে। লিথুনিয়া ও সুইডেনের বিপক্ষে সমান ৭টি করে গোল, অ্যান্ডোরা ও হাঙ্গেরির বিপক্ষে সমান ৬টি করে গোল এবং আর্মেনিয়া, লাটভিয়া ও সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে সমান ৫টি করে গোল আছে তার।
তার পেছনে কারা
১২৩৬ ম্যাচে ৯০০ গোল। এবং ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ছুটছেন। তার এই রেকর্ড কী ভাঙতে পারে ভবিষ্যতে? সেই সম্ভাবনা আসলে কম। সিআর৭-এর পেছনে থাকা আর্জেন্টাইন তারকা লিওনেল মেসির গোলসংখ্যা ১০৬৯ ম্যাচে ৮৩৮টি। ঘন ঘন চোট, বয়সের ভার, তুলনামূলক দুর্বল দলে খেলা--সবমিলিয়ে মেসির পক্ষে আর হয়তো আগের মতো ছোটা সম্ভব হবে না। পেশাদার ক্যারিয়ারে হাঙ্গেরির কিংবদন্তি জোসেফ বিকান ৫৩০+ ম্যাচে গোল করেন অন্তত ৮০৫। বলা হয়ে থাকে, ১৯৩১ থেকে ১৯৫৬ সাল অবধি বিকান গোল করেন প্রায় দেড় হাজার। তবে ফিফা কর্তৃক স্বীকৃতি পায় ৮০৫টি।
ব্রাজিলের কিংবদন্তি রোমারিও ৯৯৪ ম্যাচে ৭৭২ গোল করে আছেন চতুর্থ স্থানে। সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে অনেকেই যাকে মেনে নিয়েছেন, সেই তিনবার বিশ্বকাপজয়ী পেলের ফিফা স্বীকৃত পেশাদার ক্যারিয়ার গোলসংখ্যা ৮৩১ ম্যাচে ৭৫৭টি। যদিও পেলে এরচেয়ে অনেক বেশি গোল করার কথা বহুবার দাবি করেন।
সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে