মোহনীয় ফুটবল, গ্ল্যামার, ফ্যাশন আর প্যাশন—সবমিলিয়ে অন্য সবার থেকে তাঁকে খানিকটা আলাদা করে রেখেছিল। সবুজ গালিচায় তিনি যখন বল নিয়ে ছুটতেন, তখন নাকি ফুল ফুটতো! বিমোহিত করে রাখতেন দর্শকদের। অনন্য সাধারণ ফুটবল শৈলী, গোলের পর গোল, লিগে একের পর এক রেকর্ড—তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল অভূতপূর্ব উচ্চতায়। তিনি কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। বাংলাদেশ ফুটবলের প্রথম সুপারস্টার! সত্তর আর আশির দশক সালাউদ্দিন বিমোহিত করে রেখেছিলেন বাংলাদেশ, ভারতের কোটি ফুটবলপ্রেমীকে। তাঁর ক্যারিশম্যাটিক ফুটবলের টানে স্টেডিয়ামে ছুটে আসতেন আবালবৃদ্ধবনিতা। সৌন্দর্য আর দ্যুতি ছড়িয়ে তিনি গড়ে নিয়েছিলেন অনন্য অবস্থান। ফলত বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে খেলোয়াড় সালাউদ্দিনকে ভুলেও বিচ্ছিন্ন করা যায় না! তবে দৃশ্যকল্প কেবল একদিক নিয়েই হয় না, অন্যদিকও থাকে। আর তাই সংগঠক কাজী সালাউদ্দিনের খেরোখাতায় অন্য রঙ, অন্য আল্পনা! যেখানে ইতিহাসের সর্বোচ্চ সময় দেশের ফুটবলের নিয়ন্ত্রক হয়েও ব্যর্থতার কালো মেঘে ঢাকা পড়ে গেছে স্বপ্নের আকাশ।
২০০৮ থেকে ২০২৪। মধ্যখানে দীর্ঘ ১৬ বছর। চার মেয়াদ। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। এতো দীর্ঘ সময় ধরে আর কেউ দেশের ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাণ্ডারি ছিলেন না। সালাউদ্দিন সুযোগ পেয়েছিলেন, কিংবা তাঁকে সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল—কিন্তু কাজে লাগাতে পারলেন কই! যখন তাঁর বিদায়ঘন্টা বাজছে, তখন ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ভুটানেরও দুই ধাপ নিচে!
দুই.
১৯৮৪ সালে ফুটবল থেকে অবসরের পর কোচিংয়ে জড়ান কাজী সালাউদ্দিন। ঢাকা আবাহনী, মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়াচক্র, এমনকি জাতীয় দলের কোচিং প্যানেলেও ছিলেন তিনি। ১৯৯৪ সালে কোচিংকেও বিদায় বলে দেন। পরের প্রায় দশ বছর তিনি ছিলেন ফুটবল থেকে বিচ্ছিন্ন। ২০০৩ সালে ফিরে এসে বাফুফের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। তখন তাঁকে জাতীয় দল নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছিল। জাতীয় দলের ম্যানেজার হিসেবে আমিরুল ইসলাম বাবুর মনোনয়ন নিয়ে তৎকালীন বাফুফে সভাপতি এসএ সুলতানের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে সালাউদ্দিনের। একপর্যায়ে তিনি পদত্যাগ করেন। বাফুফেতে পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করার অভিপ্রায় থেকে সভাপতি পদে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেন কাজী সালাউদ্দিন। ২০০৮ সালে মেজর (অব.) আমিন আহমেদ চৌধুরীকে ১৩ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। ২০১২ সালে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় হন সভাপতি। ২০১৬ সালে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়লেও হারিয়ে দেন কামরুল আশরাফ খানকে। এরপর ২০২০ সালে বাদল রায় ও শফিকুল ইসলাম মানিককে হারিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো বাফুফের মসনদে বসেন কাজী সালাউদ্দিন। তিনি আরেক মেয়াদে চেয়ারে বসার স্বপ্ন এঁকেছিলেন। চলতি মাসে বাফুফের যে নির্বাচন হওয়ার কথা, সেখানেও তিনি সভাপতি পদে প্রার্থী হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। তবে দেশের পটপরিবর্তনে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হয়েছেন; বাফুফের আগামী নির্বাচনে আর প্রার্থী হচ্ছেন না তিনি।
তাঁর শুরুটা অবশ্য মন্দ ছিল না। দেশের ফুটবল তখন স্পন্সরবিহীন। সেই সময় তাঁর চেষ্টায় একটি মোবাইল ফোন কোম্পানি স্পন্সর হিসেবে এগিয়ে আসে। ২০০৯ সালে ফুটবলপাড়ায় হইচই পড়ে কোটি টাকার সুপার কাপ নিয়ে। ২০১১ সালে আর্জেন্টিনা ও নাইজেরিয়া জাতীয় দলকে ঢাকায় এনে একটি প্রীতি ম্যাচের আয়োজনও নজর কেড়েছিল ফুটবলপ্রেমীদের। এছাড়া কাজী সালাউদ্দিনের আমলে আরও কিছু ভালো কাজ হয়েছে। তাঁর সময়ে জাতীয় দল বিদেশি কোচ, পর্যাপ্ত কোচিং স্টাফ, বিদেশে অনুশীলন ম্যাচ, বিদেশ সফরে ভালো হোটেলে থাকাসহ বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে। দেশের ঘরোয়া ফুটবলের শীর্ষ স্তর, প্রিমিয়ার লিগ মোটামুটি একটা কাঠামো পেয়েছে, নিয়মিত লিগ হচ্ছে। দেশের একটি ক্লাব (বসুন্ধরা কিংস) এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের বাছাইয়ে খেলছে, এটাও অগ্রগতির সূচকে ধরা যায়। তাঁর আমলে নারী ফুটবল দলও দক্ষিণ এশীয় পর্যায়ে একাধিক সাফল্য পেয়েছে।
তিন.
আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হোন, কিংবা কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান—সফলতার স্বীকৃতি যেমন আপনার, ব্যর্থতার দায়ভারও বর্তায় আপনারই কাঁধে। গেল প্রায় ষোল বছরে দেশের ফুটবলে যেসব টুকটাক ‘সাফল্য’ এসেছে, অগ্রগতি হয়েছে—এগুলোর কৃতিত্ব যেমন কাজী সালাউদ্দিনের, উল্টোপিঠে থাকা ব্যর্থতার ঝুলিও তাঁকেই বইতে হবে।
জাতীয় দলের প্রসঙ্গই আগে টানা যাক। কাজী সালাউদ্দিন যখন প্রথমবার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন, এর ১৯ দিন আগে ফিফার নতুন র্যাঙ্কিং প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৮০’তে। দায়িত্ব নিয়ে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে দেশকে ১৫০-এর মধ্যে আনার আশা দেখিয়েছিলেন সালাউদ্দিন। সে আশায় তো গুড়েবালিই, তিনি যখন বিদায় নিচ্ছেন, তখন দেশ র্যাঙ্কিংয়ে আরও চার ধাপ পিছিয়ে এখন ১৮৪’তে! এমনকি ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৯৭ নম্বরে! যে ভুটানকে মোটামুটি বলেকয়েই হারাতো বাংলাদেশ, সালাউদ্দিনের আমলে সেই ভুটানের কাছে হারতে হয়েছে দুইবার। এই ভুটান এখন বাংলাদেশের উপরে (১৮২)। যে মালদ্বীপ একদা বাংলাদেশের কাছে ৮ গোল হজম করেছিল, সেই তারা এখন ১৬৩ নম্বরে!
২০০৩ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিল বাংলাদেশ। ‘দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্বকাপ’ খ্যাত সাফে সর্বশেষ ২০০৫ সালে ফাইনালে খেলেছিল বাংলাদেশ। কাজী সালাউদ্দিনের আমলে ২০০৯ ও ২০২৩ সাফে সেমিফাইনাল খেলাটাই সর্বোচ্চ সাফল্য! পাঁচবারই বিদায় নিতে হয়েছে গ্রুপপর্ব থেকে! সালাউদ্দিন পনেরো বছর ধরে সাফের সভাপতি; অথচ একবারও নিজের দেশের ফুটবলারদের হাতে চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি তুলে দিতে পারলেন না।
কাজী সাহেবের ‘শাসনামলে’ বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও প্রীতি ম্যাচ মিলিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় দল ম্যাচ খেলেছে ১২৮টি। বলাটাই বোধহয় বাহুল্য যে হারের পাল্লাটা অনেক ভারি। সংখ্যায় বললে হারতে হয়েছে ৬১ ম্যাচে। ড্র ছিল ৩৪টি ম্যাচ। আর ৩৩ ম্যাচে জয়। যদি সালাউদ্দিনের ১৬ বছরের সাথে মেলানো হয়, তবে প্রতি বছরে জয় মাত্র দুটি করে।
কাজী সালাউদ্দিন ২০১৩ সালে আচমকা বলে বসেন, ২০২২ বিশ্বকাপে ‘খেলবেই’ বাংলাদেশ। অথচ বিশ্বকাপের প্রাক-বাছাইও পেরোতে পারেনি দল।
অনস্বীকার্য যে, জাতীয় দলকে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন কাজী সালাউদ্দিন। তাহলে সাফল্য কোথায়? এলো না কেন? বস্তুত হুটহাট সাফল্যের পেছনে ছুটতে গিয়ে জাতীয় দল নিয়ে কার্যকর কোনোও পরিকল্পনা করেনি তাঁর পরিষদ। দীর্ঘমেয়াদি সঠিক উদ্যোগ নিয়ে সেটা বাস্তবায়নে মনোযোগ ছিল না তাঁর। দেশের ফুটবল পাইপলাইনকে শক্ত করার দিকে নজর না দিয়ে বিদেশে থাকা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফুটবলারদের এনে সাফল্য পেতে চেয়েছেন কাজী সালাউদ্দিন; যা আদতে তেমন কাজে আসেনি। দেশের ফুটবলারদের মানের যে সীমাবদ্ধতা, তা থেকে উত্তরণেও পদক্ষেপ নেননি তাঁরা। একটি আধুনিক ও পূর্ণাঙ্গ একাডেমির যে হাহাকার, সেটাও পূরণ করতে পারেনি সালাউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন পরিষদ। ফিফার অর্থায়নে সিলেট বিকেএসপিতে একাডেমির যাত্রা শুরু হলেও নিজেদের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অনিয়মের কারণে সেটিও চালু রাখতে ব্যর্থ হয় বাফুফে। ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় সভাপতি পদে থেকেও ক্লাবগুলোকে দিয়ে একাডেমি চালু করাতে পারেননি সালাউদ্দিন। ক্লাবগুলোকে বয়সভিত্তিক দল চালু করতেও বাধ্য করতে পারেননি।
দেশের ফুটবলের অন্যতম ভিত্তি জেলা লিগ। কিন্তু তাঁর সময়ে জেলার ফুটবল নিষ্ক্রিয়, উপেক্ষিত। সিংহভাগ জেলাগুলোতে নিয়মিত লিগ হয় না। বেশিদূর যেতে হয় না, ঢাকার পাশের জেলা নারায়ণগঞ্জে লিগ হয় না ছয় বছর ধরে! যে কয়টি জেলায় লিগ হয় সেগুলোতেও মান ঠিক নেই, নেই পেশাদারিত্বের ন্যুনতম ছিটেফোটা। জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন নামে আছে, কাজে নাই। বাফুফে সভাপতি চাইলে লিগ আয়োজনে ব্যর্থতার দায়ে জেলা পর্যায়ে শাস্তি দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সে পথে হাঁটেননি, পাছে নির্বাচনে নিজের ভোট নষ্ট হয়ে যায়! বাফুফের জেলা লিগ কমিটি আছে; ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সেই কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন কাজী সালাউদ্দিন। অথচ গেল দুই বছরে সেই কমিটির কোনো সভাই হয়নি! কার্যত কাজী সালাউদ্দিনের আমলে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছিল। কেউ কেউ তো হাস্যরসে ফেডারেশনকে ‘ঢাকা ফুটবল ফেডারেশন’ও বলে থাকেন! তবে শীর্ষ স্তর ছাড়া ঢাকাকেন্দ্রিক ফুটবলেও সঠিক মনোযোগ দিতে ব্যর্থ তাঁর পরিষদ। ঢাকায় নিচের স্তরের লিগগুলো নিয়মিত হয় না; যেগুলো হয় সেখানেও নানা অনিয়ম, পাতানো ম্যাচের দুর্গন্ধ।
জাতীয় দলের যে ব্যর্থতা, এর পেছনেও বাফুফের অদূরদর্শীতা দায়ী। কাজী সালাউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন পরিষদ একের পর এক মানহীন বিদেশি কোচ এনেছে, আর ছুঁড়ে ফেলেছে! ২০২২ সালে হাভিয়ের কাবরেরাকে জাতীয় দলের কোচ হিসেবে আনে বাফুফে। ১২ বছরের মধ্যে তিনি হচ্ছেন জাতীয় দলের ১২তম কোচ! কোচদের মেলা বসালেও তাদের প্রায় সবাই-ই ছিলেন মানহীন। একমাত্র টম সেইন্টফিট ছাড়া একজন কোচেরও জাতীয় দলে কোচিংয়ের পূর্বভিজ্ঞতা ছিল না! বাংলাদেশই ছিল তাদের প্রথম জাতীয় দল।
ফুটবলের জন্য একান্ত নিজস্ব একটি স্টেডিয়ামও করতে পারেননি কাজী সালাউদ্দিন। শেখ কামালের বন্ধু পরিচয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও ফুটবলের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বা সুবিধা আদায়ে তিনি ব্যর্থ। সবেধন নীলমণি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম গেল তিন বছর ধরে সংস্কারের অজুহাতে বন্ধ! কমলাপুর স্টেডিয়ামের টার্ফ ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে। ফিফার কাছ থেকে টার্ফ আনা যায়, কিন্তু এক্ষেত্রে গতি নেই। বাফুফে ভবনের পাশের মাঠ অনুপযুক্ত। কক্সবাজারে ফিফার অর্থায়নে ফুটবল কমপ্লেক্স হওয়ার কথা ছিল; এটিও এখন অবধি কাগজেকলমে আটকা।
আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে পারেননি কাজী সালাউদ্দিন। হ্যাঁ, এটা সত্য যে সরাসরি তাঁর গায়ে কলঙ্কের কালিমা লেপন হয়নি। কিন্তু তাঁর অধীনস্থদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে বারবার। খোদ বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা আর্থিক অনিয়মে বাফুফের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি ও অর্থ কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুল সালাম মুর্শেদীকে ১০ হাজার সুইস ফ্রাঁ (প্রায় ১৩ লাখ টাকা) জরিমানার সঙ্গে সতর্কও করে দেয়। এমন জরিমানা দেশের ফুটবল ইতিহাসে নজিরবিহীন। বাফুফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ, অর্থ কর্মকর্তা আবু হোসেন, অপারেশন্স ম্যানেজার মিজানুর রহমানকে জালিয়াতি ও অনিয়মের কারণে নিষিদ্ধ করে ফিফা। বাফুফের প্রকিউরমেন্ট ম্যানেজার ইমরুল হাসান শরীফকে সতর্ক করে দেয় সংস্থাটি। বাংলাদেশ সরকার থেকে প্রাপ্ত ২০ কোটি টাকাও নয়ছয় করার অভিযোগ বাফুফের বিরুদ্ধে। এই টাকার ১০ কোটি স্থায়ী আমানতের নির্দেশ দিয়েছিল সরকার, কিন্তু সালাউদ্দিন সাহেব তা করেননি। পুরো টাকার সঠিক হিসাব দিতে ব্যর্থ হন তাঁরা।
বাফুফেকে নিজের সাম্রাজ্যে পরিণত করেছিলেন কাজী সালাউদ্দিন। গঠনতন্ত্র অনুসারে বাফুফের মূল ক্ষমতা নির্বাহী কমিটির কাঁধে। কিন্তু সালাউদ্দিন গঠনতন্ত্রের তোয়াক্কা করেননি কখনো, নিজেই ছিলেন সর্বেসর্বা। বহু সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা নির্বাহী কমিটির সভায় উপস্থাপন করা হয়নি, তাঁদেরকে জানানো হয়নি। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে বাংলাদেশে আনার ঘোষণা নির্বাহী কমিটিকে কিছু না জানিয়ে নিজেই দিয়েছিলেন সালাউদ্দিন। গেল বছর অলিম্পিক বাছাইয়ে নারী দলকে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত কাউকে কিছু না জানিয়ে নিয়ে নেন তিনি। সালাউদ্দিনের কমিটির নির্বাহী সদস্য মাহফুজা আক্তার কিরণ পেয়েছেন বিশেষ সুবিধা। বাফুফে ভবনে কোনো নির্বাহী সদস্যের জন্য বসার আলাদা কক্ষ নেই। অথচ নির্বাহী সদস্য হওয়ার আগে থেকেই বাফুফে ভবনের তৃতীয় তলায় স্বতন্ত্র কক্ষ কিরণকে বরাদ্দ দেন সালাউদ্দিন। জ্যেষ্ঠ ও দক্ষ সংগঠকদের পাশ কাটিয়ে কিরণকে দিয়ে ফিফা ও এএফসিতে প্রতিনিধিত্ব করিয়েছেন কাজী সাহেব। বাফুফের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ছিলেন পল স্মলি। তিনি এ দেশের ফুটবলের উন্নতিতে উল্লেখযোগ্য কাজ করতে না পারলেও মাসে মাসে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের বেতন। অব্যাহত সমালোচনার মুখেও সালাউদ্দিনের প্রিয়পাত্রে পরিণত হয়ে এই পদে দীর্ঘদিন ছিলেন স্মলি। কাজী সালাউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন মঞ্জুর কাদের। ২০১০ সালে কাদেরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবকে সরাসরি প্রিমিয়ার লিগে খেলার সুযোগ করে দেন সালাউদ্দিন! বাফুফের নির্বাহী কমিটিতে ছিলেন না কাদের; কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৫ অবধি সালাউদ্দিনের আশকারায় প্রভাব খাটিয়ে লিগের ফিকশ্চার বদল, ফরম্যাট পরিবর্তন, বিদেশির সংখ্যা কমানো-বাড়ানো সব করেছেন মঞ্জুর কাদের। ২০১৬ বাফুফে নির্বাচনের আগে অবশ্য কাদের সাহেব সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন; যোগ দিয়েছিলেন সভাপতি প্রার্থী কামরুল আশরাফ শিবিরে।
চার.
ক্যারিশম্যাটিক ফুটবলার কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন সংগঠকের ভূমিকায় কেন ব্যর্থ হলেন—এটা একটা জরুরি প্রশ্ন। অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে। তাঁর ব্যর্থতার সুলুকসন্ধান সম্ভব হলে ভবিষ্যতের নেতৃত্ব হয়তো শিক্ষা নিতে পারবে, হয়তো পথের সঠিক দিশা খোঁজে পাওয়া যাবে।
তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কাজী সালাউদ্দিন যদি সত্যিই চাইতেন, তবে বদলে দিতে পারতেন দেশের ফুটবলকে। সেই সক্ষমতা তাঁর অবশ্যই আছে। ফিফা, এএফসি, সাফ—সবখানে তাঁর পরিচিতি আছে। কিন্তু সেটাকে ইতিবাচকতায় রূপ দিতে পারেননি তিনি। দেশের শাসকগোষ্ঠির সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা ছিল, এখানেও সুযোগ কাজে লাগাতে তিনি ব্যর্থ। সালাউদ্দিন আশার ফানুস উড়িয়ে মসনদে বসেছিলেন; তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠেছিল প্রত্যাশার পাহাড়। আশা হয়েছে হতাশা, প্রত্যাশার পাহাড়ে নেমেছে ধস। যিনি হতে পারতেন উদ্ধারকর্তা, তিনিই বিদায় নিচ্ছেন তরী ডুবিয়ে!
সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে