টেস্টে সাফল্যের জন্য নিয়তির দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশ।

সন্দেহ নেই, ক্রিকেটের আভিজাত্যের মুকুট টেস্ট। পাঁচদিনের এই ক্রিকেটে প্রতিটা সেশনেই দিতে হয় টেম্পারমেন্ট, মনোসংযোগ, দৃঢ়তা, ধৈর্য্যরে পরীক্ষা। আক্ষরিক অর্থেই টেস্ট ক্রিকেট ক্রিকেটারদের ‘টেস্ট’ নেয়। স্বাভাবিকভাবেই তাই টেস্ট ক্রিকেটে যারা যতো ভালো, তাদের খ্যাতি, যশ, সুনাম ততো বেশি। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুতে অভিজাত ক্রিকেটের মর্যাদা লাভের পর প্রায় দুই যুগের পথচলায় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বিভীষিকার নাম টেস্ট। অপর দুই সংস্করণে পারফরম্যান্স মোটামুটি মানের হলেও টেস্টে এসে বেরিয়ে পড়ে আমাদের হাড্ডিসার কঙ্কাল!

টেস্ট ক্রিকেটে পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে বাংলাদেশ যে এখনও ‘অবোধ শিশু’—এ নিয়ে সম্ভবত কারোরই দ্বিমত থাকবে না। সাদা পোশাকের এই খেলায় দুই যুগ পূর্ণ করেও আমাদের ভিত বড্ড নড়বড়ে—যেন পলকের ঝড়েই ওড়ে যাবে সব! পরিসংখ্যানকে টানলে অবস্থার দূরবস্থা বোঝাটা সহজ হবে। এখন অবধি টাইগার-বাহিনী খেলেছে ১৪৮ টেস্ট ম্যাচ। এর মধ্যে জয় মাত্র ২১টিতে, শতকরা হিসেবে ১৪.১৯ ভাগ। ড্র করা গেছে ১৮ টেস্টে, ১২.১৬ ভাগ। আর পরাজয়ের সেঞ্চুরি পেরিয়ে সংখ্যাটা এখন ১০৯ টেস্টে এসে দাঁড়িয়েছে! অর্থাৎ, ৭৩.৬৫ ভাগ টেস্টেই আমাদের নিদারুণ ব্যর্থতা।


বাংলাদেশের টেস্ট-ব্যর্থতার ময়নাতদন্ত করতে গেলে কারণের অভাব থাকে না! টেম্পারমেন্ট, মনোসংযোগ ও ধৈর্য্যরে ঘাটতি, ব্যাটে রানের অভাব, বোলিংয়ে অধারাবাহিকতা, পরিকল্পনায় গলদ, দুর্বল নেতৃত্ব—অনেকগুলো কারণ দৃশ্যমান।

একেকটা টেস্ট ম্যাচ মানে নতুন ‘পরীক্ষার হল’। প্রতিটা সেশনে দৃঢ়তার পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয় এখানে। খেলতে হয় প্রতিটা সেশন ধরে। টেম্পারমেন্টে সামান্য ঘাটতি দেখা দিলেই সমস্যা। অথচ এই সমস্যা যেন বাংলাদেশের মজ্জাগত। বছরের পর বছর গড়ালেও টেস্ট ক্রিকেটের প্রকৃতির সাথে যেন আমরা খাপ খাওয়াতে পারি না। এক সেশনে ভালো ব্যাটিং করে পরের সেশনে হুড়মুড় করে ধসে পড়া, মনোসংযোগের ঘাটতিতে ক্যাচ মিস করা, কখনো বোলিংয়ে টপাটপ কয়েকটা উইকেট নিয়ে প্রতিপক্ষকে যখন চেপে ধরার সুযোগ তখন ভালো বোলিং করতে ব্যর্থ হওয়া, সেশনের পর সেশন উইকেটের জন্য খাবি খাওয়া—দলের সমস্যা অনেক। আমাদের পরিকল্পনাও ঠিকমতো হয় না। ঘরের মাঠে খেলেও হোম অ্যাডভান্টেজ নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে থাকি। সাম্প্রতিক সময়ের ছোট্ট একটা উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। ক’দিন আগেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঘরের মাঠে টেস্ট সিরিজ খেলেছেন নাজমুল হোসেন শান্তরা। সিরিজের প্রথম ম্যাচে মিরপুরে বাংলাদেশ একাদশে ছিলেন মাত্র এক পেসার। অথচ ম্যাচের শুরু থেকেই উইকেট (পিচ) ছিল পেসবোলিং সহায়ক। ওই ম্যাচে উভয় ইনিংসে অলআউট হয় টাইগার-বাহিনী। দক্ষিণ আফ্রিকার দুই পেসার শিকার করেন ১৩ উইকেট। ম্যাচে সফরকারীরা ১৩ উইকেট খোয়ায়; এর ৩টি শিকার করেন টাইগার পেসার হাসান মাহমুদ। অর্থাৎ, ম্যাচে উভয় দল মিলিয়ে উইকেট পড়ে ৩৩টি; এর ১৯টিই শিকার করেন পেসাররা। অথচ বাংলাদেশ খেলে একমাত্র পেসার নিয়ে! ঘরের মাঠের উইকেটই যদি না বুঝেন, সে অনুসারে যদি পরিকল্পনা সাজাতে না পারেন, তাহলে তো বলাই যায় যে আপনাদের টেস্ট-পরিপক্বতা এখনও আসেনি।

টেস্ট ক্রিকেটে দুর্বল নেতৃত্বও বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যা। প্রতিভাবান, অমিত সম্ভাবনাময় দেখে যাকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়, দেখা যায় তিনিই দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। অধিনায়ক যদি পারফর্ম না করেন, স্বভাবতই তিনি দলের বাকিদের পারফর্মের জন্য তাগদা দেওয়ায় পিছিয়ে থাকবেন। নাজমুল হোসেন শান্তর কথাই ধরা যাক। তার প্রতিভা, নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ একেবারেই কম। এই শান্তও অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর যেন নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন। পরিসংখ্যান টানা যাক। অধিনায়ক হওয়ার আগে ২৩ টেস্টের ৪৪ ইনিংসে শান্তর রান ১২৮৩। গড় ২৯.৮৩, চারটি সেঞ্চুরি, তিনটি ফিফটি। অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পাওয়ার পর ১০ টেস্টের ১৯ ইনিংসে শান্ত করেছেন ৪৮৩ রান। গড় কমে হয়েছে ২৫.৪২, একটি করে সেঞ্চুরি ও ফিফটি। এই আধুনিক ক্রিকেটে ২৫ গড়ের অধিনায়ক দিয়ে টেস্টে ভালো ফলাফল তো দূর অস্ত, টিকে থাকাই দুষ্কর! অধিনায়কত্বের এই ‘বোঝা’ কেবলমাত্র শান্তর জন্যই প্রযোজ্য নয়, পূর্বসূরীদের জন্যও। মুমিনুল হকের বেলায়ই দেখেন, ‘বাংলাদেশের ব্র্যাডম্যান’ বলা হয় যাকে। অধিনায়কত্ব ছাড়া তার টেস্ট গড় ৩৯.৯৮। অধিনায়কত্বের সময় ছিল ৩১.৪৪।

বাংলাদেশের টেস্টকেন্দ্রিক যতো সমস্যা, এগুলো নতুন কিছু নয়। সূচনা থেকেই এগুলো আমাদেরকে ভুগিয়ে আসছে। আমরাও বারবার বলে গেছি—ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা গ্রহণের কথা। কিন্তু দুই যুগেও শিক্ষাগ্রহণকাল আমাদের জন্য শেষ হয়নি। গেল সেপ্টেম্বরে ভারতের গিয়ে দুই টেস্ট সিরিজে শোচনীয় পারফরম্যান্সের পর মেহেদী হাসান মিরাজের কণ্ঠে তাই সেই ‘হাজার বছরের পুরনো উক্তি’ শোনাই গেছে—‘আমরা এখনও শিখছি’! অথচ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শেখার জায়গা নয়। আপনাকে ঘরোয়া ক্রিকেটেই শিখে তবেই আন্তর্জাতিক ময়দানে নামতে হবে।

বস্তুত আমাদের ক্রিকেট সংস্কৃতিতে বড় সমস্যা আছে। শর্টকাটে সাফল্যের দিকেই আমাদের ঝোঁক বেশি। দীর্ঘস্থায়ী, দীর্ঘমেয়াদের যথাযথ পরিকল্পনা ও সেগুলোর বাস্তবায়নে আমাদের মনোযোগ কম। জাতীয় ক্রিকেট লিগ হয় প্রতি বছর। কিন্তু সেখানে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের অংশ নিতে অদ্ভূত এক অনীহা আমরা ফি বছর প্রত্যক্ষ করে আসছি। আবার ঘরোয়া টি-২০ কিংবা ওয়ানডে ফরম্যাটের খেলায় তাদেরকে আবার ঠিকই দেখা যায়। অথচ লংগার ভার্সনের ক্রিকেটটাই সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে লম্বা সময় ধরে উইকেটে পড়ে থাকতে হয়, ওভারের পর ওভার বোলিং করে যেতে হয়, শরীর, মন সবকিছুর পারস্পরিক যোগস্পর্শে তবেই এখানে ভালো করতে হয়। কিন্তু আমরা ঘরোয়া লংগার ভার্সন না খেলেই টেস্ট ক্রিকেটে ভালো করার স্বপ্ন দেখি। স্বভাবতই সেই স্বপ্ন ডানা মেলার আগেই ধপাস!

টেস্ট ক্রিকেটের দুই যুগ পূর্তির দিনে (১০ নভেম্বর) সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল নিজের এক কলামে লিখেন, ‘আমরা টেস্ট ক্রিকেটকে কখনো বুঝতে চাইনি। কখনো গুরুত্ব দেইনি। ফলশ্রুতিতে আমরা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি।’ বাংলাদেশের সামগ্রিক টেস্ট পারফরম্যান্সকে বিবেচনায় নিয়ে তিনি দশ নম্বরের মধ্যে মাত্র আড়াই নম্বর দিতে পারবেন বলেও উল্লেখ করেন। কিছুদিন আগে জাতীয় দলের ক্রিকেটার মুমিনুল হক আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনার কাছে কি মনে হয়, আমাদের ফার্স্ট ক্লাস ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মান সমান? আমি বুঝি, কারণ, আমি পঞ্চাশের বেশি টেস্ট ম্যাচ খেলেছি। শুনলে হয়তো খারাপ লাগবে, তবে এটাই সত্য যে আমাদের ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মধ্যে অনেক তফাৎ। আকাশ-পাতাল তফাৎ। ঘরোয়া ক্রিকেট আমি অতটা চ্যালেঞ্জ ফেস করি না, যতটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেস করি।’ সম্প্রতি বাংলাদেশ দলের ভারত সফরের সময় ধারাভাষ্যকার হিসেবে সেখানে গিয়েছিলেন তামিম ইকবাল। সেখানে স্পোর্ট স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘২৪ বছর টেস্ট খেলার পর আমরা এখনও উন্নতির কথাই বলি, মোটেই ভালো কিছু না। মাঝেমধ্যে লজ্জা লাগে যে এতোদিন খেলার পরেও আমরা তেমন কিছু অর্জন করতে পারিনি।’

সাবেক অধিনায়ক কিংবা বর্তমান ক্রিকেটার—সবার মুখেই টেস্ট নিয়ে হাহাকার, ব্যর্থতা অনুধাবনের কথা আছে। তবুও আমরা যেন এক ঘোর দুর্বিপাকে পড়ে গেছি। যে দুর্বিপাক থেকে মুক্তির পথ জানা নেই! কিংবা আমরাই হয়তো পথ খুঁজতে রাজি নই!

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে