পরম পুরুষ শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন, “বংশে যদি মহাপুরুষ জন্মে থাকেন, তাহলে হাজার দোষ থাকুক, তিনিই টেনে নিয়ে যাবেন”। একটি বংশে যদি একজনও মহাপুরুষ জন্মগ্রহন করেন, তাহলে সকলকে তিনিই আলোর পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যান। বংশ এখানে প্রতিকী অর্থে ব্যবহৃত। মহাপুরুষের এই বাণী যেমন সত্য সমাজের জন্য, তেমনি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে। একটি পিছিয়ে পড়া সমাজকে উন্নয়নের পথ দেখাতে এবং এগিয়ে নেয়ার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানসম্পন্ন একটি শ্রেণি দরকার। অনেক ক্ষণজন্মা, মানুষ এ বঙ্গভুমিতে জন্মেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের অকাল প্রয়ান ঘটেছে শুধুমাত্র স্বাধিকার আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভুমিকা রাখার কারনে। তাঁরা নির্মম হত্যার শিকার হয়ে নিহত না হলে হয়তো আরও দীর্ঘদিন বেঁচে থেকে দেশ ও সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতেন। মহাবিজয়ের এই ৫০ বছরের ব্যবধানে অনেকেরই হয়তো স্বাভাবিক প্রয়ান ঘটতো। হয়ত অনেকেই আজও বেঁচে থাকতেন। আর যদি তাই হতো, তাহলে তাঁরা জাতিকে আরও অনেক কিছু দিয়ে যেতেন। জাতীর বড় দুর্ভাগ্য যে তাঁরা অকাল প্রয়াত হয়েছেন নির্মম-নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের মাধ্যমে।

স্বৈরাচারী পাক-সরকারের বুলেটে শিক্ষাঙ্গন সর্বপ্রথম কলুষিত হয় ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে। আন্দোলনমুখর সেই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের উপর গুলিবর্ষনের আদেশ দেয়া হয়। প্রিয় শিক্ষার্থীদের জীবন বাঁচাতে বুক পেতে দিয়ে সেদিন শহীদ হলেন অধ্যাপক ড. সামসুজ্জোহা। দেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী। তিনি ছিলেন রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং বিশ^বিদ্যালয়ের প্রক্টর। অত্যন্ত জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের নিকট পরিচিত ছিলেন ‘জোহা স্যার’ নামে। পরবর্তীতে এক গভীর কালো ইতিহাস রচিত হয় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য এক বিশ^মানব। বহুমুখী প্রতিভা, অসামান্য পান্ডিত্য এবং দর্শনশাস্ত্রে বৈপ্লবিক যুগের সূচনা করা এই মহামনিষীকে আমরা চিনি অধ্যাপক ড. জি সি দেব নামে। সদা হাস্যোজ্জ্বল, পরোপকারী এই কীর্তিমান বাঙ্গালি জাতি ও বাংলাদেশের দর্শনশাস্ত্রে সৃষ্টি করে গেছেন নুতন ধারা। এ জন্য তাকে প্রাচ্যের সক্রেটিস হিসেবে অভিহিত করা হয়। দর্শনশাস্ত্রে তার পান্ডিত্যে এবং নুতন পথের আলোকবর্তিকা হিসেবে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর দর্শনকে আরও ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে স্থাপিত হয়-‘দ্য গোবিন্দ দেব ফাউন্ডেশন ফর ওয়ার্ল্ড ব্রাদারহুড’। জাতির বড় দুর্ভাগ্য, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই এই মনিষী, সাধক, দার্শনিক এর কর্মময় জীবন প্রদীপ এক মুহুর্তে নিভে যায়, বড্ড অসময়ে।


অসামান্য প্রতিভাধর একজন নাট্যকার ও প্রবন্ধকার ছিলেন অধ্যাপক আবু নইম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী। তিনি ছিলেন একজন খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক ও ভাষাবিজ্ঞানী। উন্নতমানের বাংলা কী-বোর্ড ‘মুনীর অপটিমা’ তাঁরই সৃষ্টি। কৃতি এই শিক্ষাবিদ রকফেলার বৃত্তি নিয়ে হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয় থেকে আধুনিক ভাষাতত্ত্বে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। এক পর্যায়ে কারাবন্দী অবস্থায় বাংলা সাহিত্যে এম এ পরীক্ষায় অবতীর্ন হয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। পাক-ভারত যুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর লেখা রচনা সংকলন ‘রনাঙ্গন’ এর জন্য পাকিস্থান সরকারই তাঁকে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ উপাধিতে ভুষিত করে, যা পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় আন্দোলনের সমর্থনে সেই খেতাব তিনি বর্জন করেন। ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ ও ‘কবর’ নাটক তাঁর অমর সৃষ্টি।

শহীদুল্লাহ কায়সার ছিলেন একজন খ্যাতিমান লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক, যিনি সমসাময়িক রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় ভুমিকা রাখেন। তিনি ‘দেশপ্রেমিক’ ছদ্মনামে রাজনৈতিক পরিক্রমা ও ‘বিশ^কর্মা’ ছদ্মনামে বিচিত্রাকথা শীর্ষক উপ-সম্পাদকীয় লিখতেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি যোগ দেন এবং তার রাজনৈতিক ভুমিকার কারণে গ্রেফতার হন এবং এক নাগাড়ে প্রায় সাড়ে তিন বছর কারাভোগ করেন। ‘সারেং বৌ’, ‘সংশপ্তক’, ‘রাজবন্দীর রোজনামচা’, ‘পেশোয়ার থেকে তাসখন্দ’ এর মত অনেক কালজয়ী সাহিত্যের তিনি রচয়িতা।

সেই রক্ষণশীল সমাজে একজন নারী হয়েও যিনি সাংবাদিকতার জগতে বলিষ্ঠ ও সংগ্রামী ভুমিকা রেখেছেন, তিনি সেলিনা পারভীন। ১৯৬৯ সালে টাকার অভাবে ঋন নিয়ে প্রকাশ করেন ‘শিলালিপি’ পত্রিকা। নিজে তিনি এটি সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন যা এক পর্যায়ে নিষিদ্ধ করে দেয় পাকিস্থান সরকার। বুদ্ধিজীবীদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত ‘শিলালিপি’ সেদিন সকলের নজর কেরেছিল।

কৃতি সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন ছিলেন বাংলাদেশের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জনক। মুক্তিযুদ্ধের সময় দৈনিক ইত্তেফাকে কাজ করেছেন এবং ইত্তেফাকের পাতায় সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয় লিখেছেন এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতেন। তার বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রচারিত হওয়ার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের পক্ষে বিশ^ জনমত গড়ে ওঠে।

দেশের বরেণ্য শিল্পোদ্যোক্তা, দানবীর, শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক ছিলেন রনদা প্রসাদ সাহা। স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করে কয়েকবার কারাবরণ করেছেন, ছিলেন দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সাহসী সৈনিক। পরবর্তীতে ব্যবসায়ে নিজ মেধা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশের শীর্ষ ধনকুবেরে পরিনত হন। তিনি একে একে প্রতিষ্ঠা করেন মায়ের নামে কুমুদিনী হাসপাতাল, নারী শিক্ষার জন্য প্রপিতামহী ভারতেশ^রী দেবীর নামে ভারতেশ^রী হোমস্ ও টাঙ্গাইলে কুমুদিনী কলেজ। পিতার নামে মানিকগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করেন দেবেন্দ্র কলেজ এবং মীর্জাপুরে কুমুদিনী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। ১৯৪৭ সালে রনদা প্রসাদ তার সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ গরীবদের উদ্যেশ্যে ব্যয় করার জন্য কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন। মানবতাধর্মী কাজে সম্পৃক্ত থাকায় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাকে রায়বাহাদুর উপাধিতে ভুষিত করে।

অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহও ছিলেন দেশের অন্যতম নারী শিক্ষার অগ্রদূত, সমাজ সংস্কারক এবং দানবীর। তিনি চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করেন কুন্ডেশ^রী বালিকা মহাবিদ্যালয়, কুন্ডেশ^রী বালিকা বিদ্যামন্দির, কুন্ডেশ^রী আয়ুর্বেদিক কলেজ ও কুন্ডেশরী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় যা মানুষকে শ্রদ্ধাভরে এই মহামানবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এছাড়াও তিনি গহিরা হাই স্কুল, গহিরা কলেজ, রাউজান স্কুল, রাউজান কলেজ, হাটহাজারী কলেজ, বাঁশখালী কলেজ সহ বহু প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন্। মানবতার সেবায় উপ মহাদেশের অন্যতম আয়ুর্বেদিক প্রতিষ্ঠান কুন্ডেশ^রী ঔষধালয় প্রতিষ্ঠা করেন। কুন্ডেশ^রী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট তাঁর নামে প্রতি বছর ‘শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ স্মৃতি বৃত্তি ও গুণীজন সংবর্ধনা’ প্রদান করে থাকে।

অধ্যাপক যোগেশ চন্দ্র ঘোষ ছিলেন প্রখ্যাত আয়ুর্বেদ শাস্ত্র বিশারদ এবং শিক্ষাবিদ। তিনি সাধনা ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা এবং একজন প্রখ্যাত রসায়নবিদ। তিনি ছিলেন লন্ডন ক্যামিকেল সোসাইটির ফেলো এবং মর্কিন যুক্তরাস্ট্রের ক্যামিকেল সোসাইটির সদস্য। তাঁর গবেষণা ও সাধনার ফলে বাংলাদেশে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা প্রণালী আধুনিক মানে উন্নিত হয়। তিনি রোগ-ব্যাধির কারণ ও লক্ষন, আয়ুর্বেদ চিকিৎসার তত্ত্ব, এবং এর ব্যবহার পদ্ধতি সম্পর্কে বহু বই লিখে গেছেন।

জহির রায়হান ছিলেন একজন খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক, গল্পকার এবং চলচ্চিত্রকার। তাঁর রচিত ‘আরেক ফাগুন’, ‘হাজার বছর ধরে’, ‘বরফ গলা নদী’, ‘একুশে ফেব্রুয়ারির’ মতো কালজয়ী সব সাহিত্য কর্ম। তিনি শহীদ না হলে, আজ দেশের যে চলচ্চিত্র শিল্পটিই ধ্বংস হওয়ার উপক্রম, এমন দিনটি হয়ত আসতো না। তার নির্মিত অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেওয়া’ দেখে সত্যজিৎ রায়, মৃনাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋত্তিক ঘটকের মত চলচ্চিত্রকারও ভুয়সী প্রসংসা করেছেন।

আলতাফ মাহমুদ ছিলেন একজন সুরকার, সংস্কৃতিকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৫০ সালের দিকে তিনি ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য গনসঙ্গীত গাইতেন। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো....’ শিরোণামের আলোরন সৃষ্টিকারী গানটিতে সুর সংযোজন করে খ্যাতির শীর্ষে আরোহন করেন। পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তার দেশাত্মবোধক গান প্রচারিত হতে থাকে যা অগনিত মুক্তিযোদ্ধাকে অনুপ্রাণীত করেছিল।

উল্লেখিত ক’ জন ছারাও শত-সহস্র বুদ্ধিজীবী যুদ্ধকালীন শহীদ হয়েছেন। জাতির বড় দুর্ভাগ্য, তাঁরা চলে গেছেন বড় অকালে, বড় অসময়ে, অবেলায়। একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী পুরো মুক্তিযুদ্ধকালীন সারা দেশে বুদ্ধিজীবী শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত এমন এক হাজার সত্তর জন লোক শহীদ হয়েছিলেন। তন্মধ্যে বড় একটি অংশ ছিল একেবারে তৃনমূল পর্যায়ে পাঠদান কারী প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। আমরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে তাদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করি। তাঁদের শিক্ষা অন্তরে ধারণ করে নুতন প্রজন্মকে জানাতে হবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জীবন উৎসর্গের ইতিহাস। আজকের এই শহীদ বুদ্ধিজিবী দিবসের প্রাক্কালে সকল শহীদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে তাঁদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক: অধ্যাপক, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।