কোন কিছুইতেই যেন থামছে না শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ছাত্র আন্দোলন। বেগম সিরাজুন্নেছা চৌধুরী হলের প্রভোস্টের পদত্যাগসহ তিন দফা দাবির আন্দোলন এখন পরিণত হয়েছে উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনে। তৃতীয় দিনের মতো আজ অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদের পদত্যাগ বা অপসারণ ছাড়া আন্দোলন থেকে সরে না দাঁড়ানোর ঘোষণায় অনড় তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অচলাবস্থা নিরসনে সিলেটের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা কি ভাবছেন? তাদের সাথে কথা বলে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

উপাচার্যের পদত্যাগ বা ছুটিতে যাওয়া উচিত
-ফারুক মাহমুদ চৌধুরী
সভাপতি, সুজন- সিলেট


শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছোট-খাটে ছিল। কিন্তু উপাচার্যের ভুল সিদ্ধান্তই এটিকে বড় রূপ দিয়েছে। এখন চলমান সংকট নিরসন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে পদত্যাগ বা ছুটিতে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন, সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী।
 
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান সংকট নিয়ে ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা একদফা নিয়ে আন্দোলন করছে। তাদের দাবির পেছনে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। এই সংকটের জন্য উপাচার্যই দায়ি। তাই তার উচিত পদত্যাগ করে সংকট নিরসন করা। যদি পদত্যাগ করতে নাও চান তবে তিনি ছুটিতে যেতে পারেন। তার অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে কাউকে দায়িত্ব দেয়া যাতে পারে। ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করতে পারেন।’

ফারুক মাহমুদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ইস্যু খুব বড় ছিল না। সেটি পর্যায়ক্রমে বড় করেছে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। তিনি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পিঠিয়েছেন। একজন উপাচার্যের কাছ থেকে এমনটা আশা করা যায় না। এটা খুবই দুঃখজনক। শিক্ষার্থীরা তো তার সন্তানতুল্য। তিনি তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর আগেও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময় উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন করেছেন শিক্ষার্থীরা। বিএনপির সময় উপাচার্য অধ্যাপক মুছলেহ উদ্দিন আহমদকে ২২ ঘন্টা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কিন্তু তিনি ওই সময়ও পুলিশ ডেকে শিক্ষার্থীদের উপর অ্যাকশন নিতে বলেননি। অথচ অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন অধৈর্য হয়ে তাড়াহুড়ো করে পুলিশ ডেকে ঘটনাকে বড় করেছেন। শিক্ষার্থীদের একদফা আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিয়েছেন তিনি। তাই সংকট নিরসনে এখনো তাকেই উদ্যোগী হতে হবে।’

 


উপাচার্যের পদত্যাগ সমস্যার সমাধান নয়
-অধ্যাপক ড. মো. আতি উল্লাহ
সাবেক বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি

উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদের পদত্যাগ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান সংকটের স্থায়ী কোন সমাধান নয় বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ইংরেজি বিভাগের সাবেক প্রধান ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক মো. আতি উল্লাহ। শিক্ষাজীবনের কথা চিন্তা করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত করে পড়ালেখায় ফিরে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। একই সাথে বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের অভিযুক্ত প্রভোস্ট বডিকে সরিয়ে দিয়ে নতুন প্রভোস্ট বডি গঠনেরও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

অধ্যাপক ড. মো. আতিউল্লাহ শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান হিসেবে ২৪ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। অবসর নেওয়ার আগে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদের অধীনে কাজ করেছেন প্রায় আড়াই বছর। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) বর্তমান পরিস্থিতির মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদ বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বান্ধব উপাচার্য। তার নেতৃত্বে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় অনেক দূর এগিয়ে গেছে। গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার নেতৃত্ব দিতে যেখানে কোন বিশ্ববিদ্যালয় সাহস পায়নি সেখানে শাবি সফলতা দেখিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, গবেষণা ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে তিনি সরকারের কাছ থেকে বড় বড় ফান্ড এনেছেন। তার সাড়ে ৪ বছরের সময়কালে যে উন্নয়ন হয়েছে তা অকল্পনীয়।’

ড. আতি উল্লাহ মনে করেন, মূল সমস্যাটা বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্ট বডিই তৈরি করেছে। তারা অনেক সত্য গোপন করেছে। উপাচার্যকে ভুল তথ্য দিয়েছে। অর্থকরী পদে থেকে তারা দায়িত্ব পালনে খামখেয়ালিপনা করেছে। যে কারণে শিক্ষার্থীরা কষ্ট পেয়ে আন্দোলনে নেমেছে। ধীরে ধীরে ঘটনা বড় হয়েছে। এর পেছনে বাইরের কোন মহলেরও ইন্ধন থাকতে পারে। বহিরাগত শক্তি শিক্ষার্থীদের ভুল বোঝাতে পারে। তা না হলে তারা উপাচার্যের পদত্যাগের একদফা দাবিতে যাওয়ার কথা নয়। কারণ শিক্ষার্থীরাও জানে ফরিদ উদ্দিন তাদের প্রতি কতটুকু আন্তরিক। এই উপাচার্যের সময় কোন সেশনজট তৈরি হয়নি। সময় মতো ক্লাস, পরীক্ষা ও ফলাফল ঘোষণা হয়েছে। এনিয়ে তো শিক্ষার্থীরাই উপাচার্যকে নিয়ে গর্ব করতো।

উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন ভুল করতে পারেন, কারণ মানুষ মাত্রই ভুল হয় এমন মন্তব্য করে ড. আতি উল্লাহ বলেন, ‘এর মানে এই নয় যে, ফরিদ উদ্দিন পদত্যাগ করলেই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়ে যাবে। বরং উপাচার্য পদত্যাগ করলে শাবিতে ভাল কোন উপাচার্য এসে ঠিকতে পারবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। সমস্যা সমাধানে বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলে আগের প্রভোস্ট বডি বাদ নিয়ে নতুন করে নতুন প্রভোস্ট বডি গঠন করা উচিত। সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত থেকে উপচার্যকে এই বডি তৈরি করতে হবে। নতুন প্রভোস্ট বডি শিক্ষার্থীদেরকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে তারা ২৪ ঘন্টা শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধার খোঁজখবর নিবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোন হলে এরকম সমস্যা থাকলে তারও সমাধান করা উচিত।’

‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অনেকে অন্যায় সুযোগ সুবিধা প্রত্যাশা করেন। হয়তো বর্তমান সময়ে এই সুবিধা না পেয়ে হয়তো কোন মহল বিশেষ এই আন্দোলনে ঘি ঢালার চেষ্টা করতে পারেন। তা না হলে যে শিক্ষার্থীদের উপাচার্য আমানত মনে করতেন তার পদত্যাগ চেয়ে এভাবে তারা আন্দোলনে নামার কথা নয়।’

নিজেদের শিক্ষাজীবন, ভবিষ্যত ও পরিবারের কথা চিন্তা করে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে ড. আতি উল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের সমস্যা সমাধানে সময় বেঁধে দিয়ে আন্দোলন স্থগিত করে ফিরে যাও। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সমস্যার সমাধান না হলে আবারও আন্দোলনের সুযোগ তো রয়েছে।’ শাবির চলমান সংকট নিরসনে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে উদ্যোগ নেয়ারও দাবি জানান এই শিক্ষাবিদ।

শিক্ষার্থীদের জীবন বিপন্ন করা যাবে না
-গৌতম চক্রবর্তী
সাধারণ সম্পাদক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট

চলমান আন্দোলনে অনশনকারী শিক্ষার্থীদের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনও বিপন্ন। এই অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। এর আশু সমাধান প্রয়োজন। এজন্য সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে সমাধানের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, সিলেটের সাধারণ সম্পাদক গৌতম চক্রবর্তী।

তিনি বলেন, ‘শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে তা মোটেই কাম্য নয়। এটা দু:খজনক, অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর গুলি ছোঁড়া, সাউন্ড গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটানো এটা খুবই দুঃখজনক। এতে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে নিজেদেরকে অনিরাপদ ভাবতেই পারে। উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদ এই পরিস্থিতিতে অদক্ষতা ও অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন বলে আমার মনে হয়। তা না হলে এমন পরিস্থিতিতে তিনি আরও কৌশলী ও শিক্ষার্থীবান্ধব ভূমিকা রাখতে পারতেন।’
 
গৌতম চক্রবর্তী বলেন, ‘৮ দিন ধরে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে। তিন দিন ধরে অনশন করছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেছেন। উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অনেকে অসুস্থ অবস্থায় অনশন করছেন। তাদেরকে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। সন্তানদের এভাবে খোলা আকাশের নিচে রেখে কোন অভিভাবকই ঘরে শান্তিতে থাকতে পারে না। এই অবস্থায় একদিকে যেমনি তাদের জীবন রয়েছে শঙ্কা, তেমনি তাদের শিক্ষাজীবনও হুমকির মুখে পড়েছে। তাই এই পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত করা শুভনীয় হবে না। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিগুলো বিশ^বিদ্যালয়ের প্রশাসনের উচিত দ্রুত মেনে নেয়া। তা না হলে মহল বিশেষ এই আন্দোলনের সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করতে পারে।’

এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাইরের কোন অপশক্তি যাতে শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করতে না পারে সেদিকেও শিক্ষার্থীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানান গৌতম চক্রবর্তী।


সিলেটভিউ২৪ডটকম/শাদিআচৌ/আরআই-কে