কত নদীর পানি যে কত দিকে গড়ায়, তা, কে-ই বা বলতে পারে? মূল কারণ ছিল একটি ছাত্রী হল। কষ্টে আর সত্যিকারের ক্ষোভে-আবেগে শুরু হল ভিসি-বিরোধী আন্দোলন। আমি স্বয়ং যদি ছাত্র হতাম, তা হলে ঐ রকম কষ্ট ও ক্ষোভে আমি নিজেও অনশনে নিশ্চয় বসতাম এবং ওরকম অনড়ও থাকতাম।

কারণ, তখন আমিও ভাবতাম এত কষ্টের লেখাপড়া, পিতা-মাতার দেয়া কত কষ্টের টাকা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকার আমাদেরকে কি পাইছে, আর কি মনে করছে? আমি তো হাওয়ায় বা স্রোতে ভেসে এখানে আসি নাই, বরং যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতেই এখানে স্থান করে নিয়েছি। তাই বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকার আমাকে করুনা দেখিয়ে এখানে আনে নাই এবং আমার সাথে যখন যা ইচ্ছা, তা করতে পারে না। কখনো রাখবে গণরুমে, কখনো বাহিরের কোন এ্যটাচ্ড জায়গায়, আর ভাগ্যে জুটলে কোনদিন আভ্যন্তরীন কোন আবাসিক হলে। আবার দোহাই দেবে মাস্ক আর করোনার? আমি বাধ্য হয়ে বসব মৃত্যুর পথিমধ্যে! এ সবছিুই তো আমার জীবন নিয়ে খেলা? তা হলে তাদের এ খেলার শেষ কোথায়, আমিও তা দেখেই ছাড়ব, এবং এর জন্য আমি একাই যথেষ্ট।


একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে মা-বাবা আত্মতৃপ্ত হন। তাঁরা আত্মপ্রসাদ লাভ করছেন যে, আমাদের সন্তানকে আমরা ভাল একটা জায়গায় পাঠিয়েছি। সব আত্মতৃপ্তি ও আত্মপ্রসাদের পরিবর্তে এখন যদি ঐ মা-বাবাই শুনেন যে, তাদের সন্তানটি কষ্টে ও ক্ষোভে মরার জন্য তৈরি হয়ে পথিমধ্যে বসে রয়েছে, তা হলে আমার সাথে সাথে আমার মা-বাবাও ঐ একই পথে নিদ্বির্ধায় অগ্রসর হতেন।

সিলেটের স্বনামধৈন্য শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টি সত্যিই ভাগ্যবান। কারণ, এই শীত, প্রতিকুল আবহাওয়া ও অতিমারির দিনেও আন্দোলনকারি সকল শিক্ষার্থীর একজনেরও সিরিয়াস কিছু হয় নি, বা কোন জীবনহানী ঘটে নি। কিন্তু যদি সত্যিই কোন একজনের বেলায়ও ওগুলোর কোন একটিও ঘটে যেত, তা হলে একটিমাত্র ছাত্রী হলকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া এ আন্দোলনটি হয়তো জাতীয় আন্দোলনেই রূপ নিতে পারত। কারণ, ’৫২-র জাতীয় আন্দোলনকালে অভিশপ্ত বানানো পূর্বপাকিস্থানে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মাত্র ৫/৬ টি। আর আজকের সোনার বাংলাদেশে শুধু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই ৫০টি। নিজ দেশের নিজ সরকার কন্ট্রোল করতে পারতই বা কয়টি বিশ্ববিধ্যালয়কে বা কত জন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীকে?

যে ছাত্রী হলটি নিয়ে সাম্প্রতিক ভিসি হঠাও আন্দোলন, সেই বেগম সিরাজুন্নেছা চৌধুরী হলের ইতিপূর্বেকার প্রভোষ্ট ছিলেন আমার ইংরেজি বিভাগের একজন সিনিয়র শিক্ষক অধ্যাপক শরীফা ইয়াসমীন। দেশ-বিদেশ মিলিয়ে তাঁর চাকুরির অভিজ্ঞতা প্রায় ৩০-৩২ বছর। আমি নিজে দেশ-বিদেশে উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষকতায় এখন ঢুকেছি টানা ৪৬ বছরে। শাহজালালে ইংরেজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাকালীন ও তৎপরবর্তী দীর্ঘদিনের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন ছাড়াও অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে, আড়াই বছর দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের প্রধানের এবং মাঝে মধ্যে পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বও। এক নাগাড়ে আমাকে আরো ৭ বছর দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে একটি আবাসিক ছাত্র হলেরও।

শাহজালালের সকল ভিসিগণকে দেখার এবং তাঁদের সকলের সাথে কাজ করার ও কাজ শেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তাই, বর্তমান মাননীয় ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন আহমেদকেও আমি ভাল করেই চিনতে পেরেছিলাম একজন ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে, আমার বিভাগীয় প্রধানের জায়গা থেকে। আর তাই, অদ্যাবধি যে ১১/১২ জন ভিসি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন এবং গেছেন, তাঁদেরকে নিয়ে যদি কোন তুলনামূলক প্রতিবেদন তৈরি করতে আমাদের দু’-চারজনকে বলা হত, তা হলে, আমারটাই হয়ত হত ‘বেস্ট অব দ্য বেস্ট’, যেহেতু এ বিশ্ববিদ্যালয়ে একমাত্র আমিই সবচেয়ে বেশি দীর্ঘকালীন বিভাগীয় প্রধান। যাক, এ প্রসঙ্গে প্রয়োজনে পরবর্তীতে আমি আবার ফিরে আসব।

আমার বিভাগের প্রফেসর শরীফা ইয়াসমীন যে মেয়াদে ঐ ছাত্রীহলের প্রভোষ্টের দায়িত্বে ছিলেন, উনাকে আমি নিজ বিভাগে পেতাম খুব কম। পেতাম শুধু উনার ক্লাশ-পরীক্ষা-থিসিস্ গাইডিং এর সময়ে। বাকি সময়টা উনি কাটাতেন ঐ ছাত্রীহলে। কখনো কোন প্রয়োজনে তাঁকে ডেকে আনলে সাথে সাথে ঐ কাজ শেষ; ‘ভাই, আমি হলে চলে যাচ্ছি’। আর উনি হলে যেতেন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, এমন কি সন্ধ্যায়ও। আমি ধরে নিতাম, ‘ঝটিকা অফিসে ঝটিকা যাওয়া’। কোন এ্যনোমেলি পাওয়া যায় কি না, আবার ফিরতেন কিন্তু ঐদিনের সকল কাজ শেষ করে, কোন কাজ পরের দিনের জন্য ফেলে না রেখে। ফিরলেন কয়টায়- এর কোন বালাই নেই। অতএব, হলের সবকিছুই ছিল, যাকে বলা যায়, ‘একেবারে টাইট’। অবশ্য মাঝে-মধ্যে হলের কোন কোন বিষয় উনি আমার সাথে নিজ থেকে শেয়ার করতেন অনেকটা গল্পচ্ছলে।

আন্দোলনের সূচনালগ্নে ছিল ঐ নির্দিষ্ট একটি ছাত্রীহলের ছাত্রীদের বার্স্ট করার মতো এক বিক্ষোভ। যেটি তারা আর কোন অবস্থাতেই মেনে নিতে পারছিল না। এর পেছনের মূল কারণ ছিল, সদ্য অব্যাহতি দেয়া বা চাপের কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়া প্রভোষ্ট মিজ লীজা। আমি সঠিক জানি না, এ খুবই জুনিয়র একজন শিক্ষককে খুব বড় ধরনের এক অর্থকরি প্রভোষ্টের দায়িত্ব দেয়াটা হয়েছিল ভিসি মহোদয়ের স্বীয় পছন্দে, না শিক্ষকদের দলীয় কোন চাপে। এ দু’টোর যেটিই কারণ হয়ে থাকুক না কেন, অব্যাহতিপ্রাপ্ত প্রভোষ্ট সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত প্রভোষ্টেরও ১০/১১ বছরের জুনিয়র। আর, এটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল স্বয়ং বর্তমান ভিসির জন্য।

আমি নিদ্বির্ধায় বলতে পারি, ভিসি হিসেবে বর্তমান উপাচার্য মহোদয়ের দক্ষতার তিল পরিমানও কোন ঘাটতি নেই। কিন্তু, প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ছে আমার এক গুরুজনের একটি উক্তি। আর তা হল- “দ্যায়ার ইজ এ টাইনী করর্ণার অব ফোলি ইন এ্যভরি ওয়াইজ ম্যান’স ব্রেইন”, অর্থাৎ, সকল জ্ঞানী মানুষের মগজেই রয়ে গেছে বোকামীর ছোট্ট একটি কর্ণার, যে কর্ণার যে কোন মূহুর্তে তাকে বিপদে ফেলে দিতে পারে”। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এ ছোট্ট কর্ণারটি-ই ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে সাম্প্রতিক মহাবিপদে ফেলেছিল।

সত্যি কথা বলতে আমার বিন্দুমাত্র কোন সংশয় নেই। কারণ, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘সত্য যে কঠিন, (কিন্তু) সে কখনো করে না বঞ্চনা’। ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদের এ টানা প্রায় সাড়ে চার বছরে সকল দিক থেকে শাবিপ্রবি ন্যূনতম ১৫ বছর এগিয়েছে। উনিই দূর করতে পেরেছেন প্রায় ১৩ বছরের সমাবর্তন-জট। ছাত্রবান্ধব, শিক্ষাবান্ধব এবং উন্নয়নবান্ধব এ ভিসিই শাবিতে প্রথমবারের মত করতে পেরেছেন ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অব ভাইস চেন্সেলরস’। আমি যদি একজন সফল ভিসি হিসেবে উনাকে অন্য কোন উপাধী দিতে চাই, তা হলে ঐ উপাধীগুলো হবে- ১. একজন ‘জ্যায়েন্ট-ভিসি’ আর, ২. একজন ‘মোন্সটর-ভিসি’। শাহজালালে এ রকম একজন ‘জ্যায়েন্ট-মোন্সটার’ ভিসিরই প্রয়োজন ছিল; কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়টির পূর্বেকার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করেই প্রফেসর ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম একদিন কমেন্ট করেছিলেন- ‘মফস্বলের বিশ্ববিদ্যালয় এ রকমই হয়’।
 
তবে ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ আসার পর থেকেই শাহজালালে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়টির ইতিহাসের এক স্বর্নযুগ। যে কোন কারণে যখনই উনি চলে যাবেন, এক আছাড়ে শাহজালাল আবার পিছাবে ১৫ বছর। আর পরবর্তী ভিসিও যদি আরেকজন ‘জ্যায়েন্ট-মোন্সটর’ ভিসি হন, তা হলে অতিরিক্ত আর আগাক বা না আগাক, যে ১৫ বছর উনি এগিয়ে রেখে যাবেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি অন্তত এ ১৫ বছর এগিয়েই থাকবে। তবে একদিন তো উনাকে চলে যেতেই হবে , যদিও সেটা হয় পূর্ণ মেয়াদ সমাপ্ত হওয়ার পর। ঈভেন  দ্যান, আই শেল স্যালিউট হিম্ ফ্রম হার্ট। চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখন মহামান্য আচার্যের হাতে।

যোগদানের পর থেকেই (নিশ্চয় অভিজ্ঞতা কম থাকার কারণে) সদ্য-অব্যাহতিপ্রাপ্ত প্রভোষ্ট ছাত্রীদের উপর হয়ে উঠেছিলেন অসম্ভব ডিক্টেটোরিয়্যাল এবং ডোমিনেটিং। যখন যা ইচ্ছা আইন চাপিয়ে দিতেন হল-বোর্ডারদের উপর। ধৈর্য্য সহকারে তিনি ছাত্রীদের কোন অভিযোগই শুনতেন না। তাঁর হলে আসা-যাওয়া-অবস্থান ছিল খুব অনিয়মিত। সহকারি প্রভোষ্টদেরকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে তিনি নাকি ছিলেন সিম্পলি অদক্ষ/ব্যর্থ, যার ফলে, সহকারি প্রভোষ্টগণ আরও জুনিয়র হওয়ায় হল যেন আল্লাহই চালাতেন। ওয়াশরুমসমূহ, ডায়েনিং, কোরিডোর, ক্যান্টিন- সবই থাকত ঘেন্না ধরার মত অপরিচ্ছন্ন। খালা/মাসি/মামারা নিয়মানুবর্তীতার পরিবর্তে থাকতেন উদাসীন। তাদের আসা-যাওয়া, নিজ নিজ কর্ম সম্পাদন করা- সবই ছিল তাদের মর্জিমত। তার কারণঃ হলটির সর্বোচ্চ অভিভাবক চলতেন তার মর্জিমত।

হলে নাকি দাপ্তরিক দায়িত্বে আছেন এক ভদ্রমহিলা, যার ভাষা এবং ছাত্রীদের সাথে ব্যবহার বরাবরই অত্যন্ত কর্কশ ও রূঢ়, কখনো কখনো অশ্লীল। তার ব্যবহারে অনেক মেয়ে নাকি কাঁদ্ত, ফেলত চোখের পানি। প্রভোষ্ট বডির কাছে অভিযোগের জন্য তাঁদেরকে সময় মত পাওয়াই যেত না, আর পেলেও উল্টো খেতে হত বকুনি। ওয়াইফাই নাকি খুবই দুর্বল আর খাবারের মান আশাতীতরকম খারাপ। ছাত্রীদের নাকি এমনও বলা হত ‘থাকতে চাইলে এরকমই থাকবা, নতুবা যেখানে ভাল, সেখানে চলে যাও’।
 
এ সমস্থ হাজারো ভোগান্তিতে মেয়েরা হয়ে উঠে পুরো অভিভাবকহীন, স্ফুলিঙ্গের মত হয়ে ওঠে তারা। এক রাতে তারা প্রোভোষ্টকে নাকি ফোন করে বলে- ম্যাম, আমরা বেরিয়ে যাচ্ছি। উত্তর পায়- কোথায় যাবা এত রাতে? যাও, যেখানে ইচ্ছা  যাও। আর তখনই আরম্ভ হয় শ্লোগান আর মহড়া।

আমার ব্যক্তিগত অবজারভেশন, ভিসিকে ইচ্ছায়, অনিচ্ছায়, উদাসীনতায় রাখা হয়েছে সম্পূর্ণ অন্ধকারে। পরদিন যখন ছাত্রীরা দল বেঁধে ভিসির কাছে যায়, সাথেই সাথেই নাকি ভিসি তাদেরকে প্রভোষ্ট অপসারনসহ সকল দাবি মেনে নিয়ে দ্রুততম সময়ে যাবতীয় সমস্যা ইলেকিট্রক গতিতে সমাধানের সমূহ আশ্বাস দেন। ছাত্রীরা পুরো কন্ভিন্সড্ হয়ে নিচে নামে। কিন্তু ডিজিটাল যুগের মোবাইলের আশির্বাদে ছাত্রীদের পূর্ব-রাতের শ্লোগান ও মহড়ার সাথে স্বাভাবিকভাবেই কোমলমতি ছাত্রীদের কোমলমতি অনেক বন্ধুরা সঙ্গে-সঙ্গেই একাত্বতা প্রকাশ করে ইতিমধ্যেই ভিসি-বিল্ডিং এর নিচে এসে জড়ো হয়ে পড়েছে এবং ছাত্রীদের মুখ থেকে কিছু শুনুক আর না শুনুক, গরম রক্তের কারণে সাথে-সাথেই তারা ভিসি-বিরোধী শ্লোগান আরম্ভ করে এবং মহড়ায় নেমে পড়ে। কারণ, প্রাকৃতিক নিয়মই হচ্ছেঃ তুফান আসলে সর্বোচ্চ গাছেই আগে লাগে, যদিও ঐ গাছের কোন দোষ থাকে না। আমি ছাত্র হলে ঠিক এরকমই করতাম, কারণ, আমাদের ছাত্রজীবনে বরাবরই আমরা দেখেছি আমাদের হল প্রভোষ্ট প্রায়দিনই হল অফিসে আসতেন সকাল ৮.০০ টায়।

তৎপরবর্তীতে যা হবার, তা-ই হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ভিসির রয়েছেন হাজারো ভক্ত। যে ভাবেই খবর ছড়াক, এসে গেল পুলিশ, উদ্ধার করল ভিসিকে। অধিকন্তু, পুলিশ ভাল করেই জানে, এ ক্যাম্পাসে তাদের উপস্থিতি নৈমিত্তিক ব্যাপার, কারণ, এক সময় এই পুলিশই শান্তিরক্ষার জন্য দীর্ঘ ১০/১১ মাস সকল ভবনকে ব্যারেক বানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে এ্যকশনে যাওয়ার তো কথা নয়? আমার গবেষণা আমাকে শিখিয়েছেঃ তিনটি জিনিষকে বদলাতে বা কন্ট্রোল করতে যেও না, পারবে না, পড়বে বৃহত্তর বিপদে। এগুলো হচ্ছে-  অতীত, প্রকৃতির খেয়াল, এবং ক্রাউড, অর্থাৎ জনতা বা জনতার ঢল। পুলিশ শিক্ষার্থীদের উপর চড়াও হবে, এ্যকশনে যাবে- এটা মেনে নেয়া যায় না। ফলশ্রুতিতি অনশন, ভিসি হটাও আন্দোলন, লাগল ‘নঠ’=‘গ্যাঁট’ যেটাকে কোন না কোন অর্থে স্বাভাবিকই বলতে হবে।

এবার আসা যাক, ঐ ‘নঠ’ বা ‘গ্যাঁঠ’ খোলার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলদের ভূমিকায়। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী অল থ্রো ঢাকা থেকে সরাসরি কানেক্টেড ছিলেন নেটে, পুরো চলমান দিনরাতগুলোতে। ছিলেন সমভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী । কিন্তু শাহজালালের বর্তমান শিক্ষকগণ অনশন-আন্দোলনকারিদের উঠিয়ে আনতে বা আশ্বস্থ করতে কতটুকু পেরেছিলেন? আমি বলব, “না, আদপেই পারেন নি”।

এমন একজন ভিসি সরকার দিল, এমন কি, টানা দ্বিতীয় মেয়াদের জন্যও। আর, এখন যদি সরকার তার দেয়া ভিসিকে গার্ডিয়ানশীপ দিতে না পারে বা ব্যর্থ হয়, আর কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে সমুজ দিতে না পারে, তবে সরকারকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, উনারা ভিসি নিয়োগে ভুল করেছেন এবং করেছিলেন।

এ আন্দোলন থামাবার জন্য শাবিপ্রবির বর্তমান শিক্ষকগণই যথেষ্ট ছিলেন। আমি নিজে তো সকল আন্দোলন স্বচক্ষে দেখেছি। এমন কি কোন বিভাগেও যখন কোন আন্দোলন হত, দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকর্মিদের কেউ কারো পাশে মন থেকে দাঁড়াতেন না; হেঁ, দাঁড়াতেন যার যার পদবী থেকে। আর পদবী থেকে এসে যা যা উনারা করতেন, সবই হত “দায়সারা আই-ওয়াসশমাত্র”। বিভিন্ন ভিসিদের বেলায়ও হয়েছে তা-ই।

সাম্প্রতিক আন্দোলনে যে সকল কোমলমতি শিক্ষার্থী বিশেষভাবে জড়িত ছিল, তারা সকলেই অন্য সকলের মত ভাল করেই ওয়াকিফহাল ছিল এবং আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নের ব্যাপারে, বিশেষ করে, এ ভিসির মেয়াদকালে ও বিশেষ করে তাদের নিজেদের শিক্ষাজীবনের তড়িৎ-অগ্রযাত্রায়। কিন্তু একটিমাত্র হলের কষ্টে ও জ্বালায় তারা হয়ে উঠেছিল মরনপণ। কিন্তু তারা সবাই-ই এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই কোন না কোন বিভাগের শিক্ষার্থী। তাই, তাদেরকে আদর করে বুঝিয়ে,  উঠিয়ে নেয়া খুবই সহজ ছিল।

প্রত্যেকটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং বিভাগের ছাত্র-উপদেষ্ঠা, মাত্র এ দু’জন করে মোট হতেন ৫৬ জন (বিভাগ ২৮টি)। তাঁরা যদি যৌথভাবে শিক্ষার্থীদেরকে সোহাগ করে বলতেন, “বাবা-মায়েরা, পুলিশি এ্যক্শনসহ সবকিছুতেই আমরা তোমদের সাথে আছি, আমরা দেখে ছাড়ব পুলিশের ক্ষমতা। এখন “আমরা” যেহেতু এসে গেছি, তোমাদের শিক্ষজীবনের স্বার্থে তোমাদেরকে এখান থেকে উঠিয়ে না নিয়ে আমরা ফিরছি না, তোমাদের কষ্ট ও ক্ষতি আমরা মানব না, হতে দেব না, তোমরা অন্তত তোমাদের শিক্ষকদের উপরে আস্থা রাখতে পার। আমরা তোমাদের কাছে এসেছি তোমাদের শিক্ষকদের জায়গা থেকে, কোন পদবী নিয়ে নয়, তোমাদের শিক্ষক হয়ে আমরা তোমাদের সকল অভিযোগ ষোল আনা আদায় করে ছাড়ব”।  

আমরা সকলে জানি, পদবীর চাইতে শিক্ষকের মর্যাদা বেশি। আর, অন্ততঃ আমাদের বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা আজও ততটুকু পচে যায় নাই। ওটা করতে পারলে নিশ্চয় শিক্ষার্থীগুলোর এত কষ্ট হত না, আর তাদের মূল্যবান সময়ের এত এত লস্ হত না। তারা পদবীকে সম্মান না দিলেও শিক্ষককে অবশ্যই ১০০% সম্মান দিত।

আর, শেষ কথা, যে যেভাবেই নিন, প্রকৃতপক্ষে, এটা মূলত হলে বসবাসকারি ছাত্রীদের কোন আন্দোলনও ছিল না; এটা ছিল সিম্পলি প্রভোষ্টের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ – তার  ফলাফল প্রভোষ্ট-রিমোভেল বা পদত্যাগ, যেটাই হোক। এটা ভিসি-র কাছে যাওয়ার মত শুধুই ছিল ছাত্রীদের একটি এস.এম. এস, - যাতে করে ভিসি তাদের কষ্টের/ভোগান্তির ব্যাপারে সম্পূর্ণ অবগত হন। এটাকে স্বয়ং ভিসি-র বিরুদ্ধে কোন আন্দোলন হিসেবে কখনো আখ্যা দেয়া যেতে পারে না। ভিসি কি ব্যবস্থা নিতেন, ছাত্রীদের কাছে মূখ্য ছিল ওটা। কারণ, সকল ছাত্র-ছাত্রী এক বাক্যে, অভিন্ন বাক্যে, এটা স্বীকার করবে যে, এ ভিসির আমলে শাহজালাল সার্বিক দিক থেকে তার ইতিহাসের এক সোনলী অধ্যায় পার করছে। কিন্তু একবার যে কোন ছুঁতোয় আন্দোলনে নেমে গেলে ছাত্র-ছাত্রীদেরও তো একটা মান-সম্মান আছে, যতই সেটা স্রেফ আবেগের ব্যাপারই হোক না কেন। এ ক্ষেত্রে ‘বাইরের কারো ইন্ধন আছে’, এটা সম্পূর্ণ একটা ঔপনিবেশ-রাজনৈতিক কথামাত্র, দেশনৈতিক কথা নয়।

আর, সব শেষে আমি সরকারকে একটি বিশেষ অনুরোধ করছি, সেটা হল, যত দ্রুত সম্ভব, মহামান্য আচার্যের সদয় অনুমতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেকে এ সুউচ্চ বিদ্যাপীটটি খোলে দিতে তড়িৎ সহায়তা করুন, যাতে আর কোন কাল-ক্ষেপন না করে শিক্ষার্থীদের ক্লাশ-পরীক্ষাসহ বিশ্ববিদ্যালটির যাবতীয় অফিস- এবং উন্নয়ন-কার্যক্রম পুনরায় আরম্ভ হয়।

লেখক : ইংরেজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাকালীনসহ প্রায় ২৪ বছরের সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শাবিপ্রবি, সিলেট।