সুরমা নদী বাংলাদেশের প্রধান নদীসমূহের অন্যতম। এটি সুরমা-মেঘনা নদী ব্যবস্থার একটি অংশ। উত্তর পূর্ব ভারতের বরাক নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করার সময় সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে বিভক্ত হয়ে; সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনায় মিশেছে। যার দৈর্ঘ্য ৯০০ কিমি।

আসামের নাগা মণিপুর অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে নদীটি দুইটি শাখায় বিভক্ত হয়ে জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, বিয়ানীবাজার, সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সিলেট জেলায় প্রবেশ করেছে। এক সময় এই নদীটি সিলেট অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকার মূল উৎস ছিল।


এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে সিলেটের সংস্কৃতি ও সভ্যতা। সিলেটের প্রকৃতি ও জীবনের সাথে এই নদী অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িত। সুরমা সিলেটকে মাতৃছায়ার মতো জড়িয়ে রেখেছে আষ্টেপৃষ্টে। নদীটিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে আজকের বাংলাদেশের অন্যতম নগরী সিলেট। এই অপবাহিকার কারণেই সিলেট অঞ্চল শিল্প বানিজ্যে সমৃদ্ধি লাভ করেছে, তার জলন্ত উদাহরণ লাপাজ সিমেন্ট কোম্পানি।

বিশ্বমানচিত্রে সিলেটকে নিপুণ ভাবে তুলে ধরে চা ও সুরমা নদী।হেমাঙ্গ বিশ্বাসের লেখা একটি কাল জয়ী গান;
হবিগঞ্জের জালালী কইতর
সুনামগঞ্জের কুড়া,
সুরমা নদীর গাংচিল আমি
শূইন্যে
শূইন্যে
দিলাম উড়া।

গানটিতে বুঝা যায় কি গভীরভাবে সুরমা নিজেকে, সাহিত্যে ও নান্দনিকতায় মিশিয়ে নিয়েছে।অথচ এ-নদী রক্ষায় আমাদের আচরণ হিংস্র থেকে হিংস্রতর হচ্ছে।তাহলে কি নান্দনিকতা আমাদের ধাতে ও অভ্যেসে নেই?

একটি জনজাতি নদীর উপর কতটুকু নির্ভরশীল তা বলাবাহুল্য।প্রাচীনকালে পৃথিবীর যেখানে যতো বড় বড় সভ্যতা গড়ে উঠেছে তার অধিকাংশই নদীকেন্দ্রিক।সিলেটকে আলোকিত করা এই সুরমা বর্তমানে মুমূর্ষু ও মৃতপ্রায়।ময়লার ভাগাড় ও নর্দমার পর্যায়ক্রমিক স্তরবিন্যস্ত সুরমার বুকে আর্তনাদের চিত্র লিখছে প্রতিনিয়ত।

সিলেট বাসীর এই সুরমার ঐতিহ্য সংরক্ষণে তেমন কোনো গ্রহণযোগ্য উদ্যোগ নেই। অথচ একটু সচেতন হলেই সুরমাকে নবপ্রাণে সাজানো যায়— নাব্যতা ফেরানো যায় ও তার চঞ্চলতাকে ফেরানো যায় পুরোনো ঐতিহ্যে। মনুষ্যসৃষ্ট জঞ্জাল সুরমাকে জীর্ণ করছে প্রতিদিন, প্রতি মুহুর্তে। কাজিরবাজার ব্রিজের নিচে প্রায় অর্ধ কিলোমিটারের মতো নদীর যা অবস্থা, মরা খাল বললেই চলে; নদীমাতৃকতা এখন আর খুব একটা খাপ খায়না। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নদীটি রক্ষা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত গ্রহণ করেনি।নাব্যতা ফেরানো তো ঢের দূর।এক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনও তাদের দায় এড়াতে পারে না।অদ্বৈত মল্লবর্মন, মানিকবাবু, সমরেশ বসু,হরিশংকর জলদাসেরা নদীকে যতটুকু বুঝেছেন তার ঠিক কতটুকু বাংলাভাষী মানুষদের বুঝাতে পেরেছেন তা এই সুরমাকে দেখলেই বুঝা যায়। নদীটিতে মাছ বিলুপ্তপ্রায় না হলেও বিলুপ্তির দিকেই হয়ত এগুচ্ছে।এ-দিন খুব বেশী দূরে নেই যে-দিন আমরা গল্প উপন্যাসে সুরমার সৌন্দর্য আর প্রাচুর্য নিয়ে সময়ের জাবর কাঠব।তবে এইটুকু কি আমরা বলব ভবিষ্যৎ প্রজন্মেকে— আসলে আমরাই সুরমার বিলুপ্তির কারিগর?


লেখক: সাংবাদিক।