পীর হাবিব যুগে যুগে জন্মায় না। পীর হাবিবরা ধ্রুব নক্ষত্রের মতো। আমাদের সৌভাগ্য যে তিনি সুনামগঞ্জে জন্মেছিলেন। সুনামগঞ্জকে কতটুকু তুলে ধরেছিলেন তা এখন টের পাচ্ছি আমরা।

তিনি রাজনীতিবিদ হতে চেয়েছিলেন, হন নি। ব্যাংকার হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। উপন্যাস লিখেছেন, গল্প লিখেছেন। নাটক লিখতে চেয়েছেন। রিপোর্ট করেছেন কবিতার মতো। তাঁর হাতে শব্দ বাজতো ঘুঙ্গুরের মতো। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে রিপোর্টিং এর জীবন বেছে নিয়েছেন।সাংবাদিকতাই ছিল পেশা এবং নেশা।


বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে পীর হাবিব আপস করেন নি। তিনি বলতেন, 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের সন্তান আমি, মহাত্মাগান্ধী আমার আত্মার আত্মীয়। কৈশোরে প্রেমে পড়েছিলাম ইন্ধিরাগান্ধীর। আলেন্দের মৃত্যুশোক সইতে না পারা নেরুদার চিরবিদায়ে কেঁদেছিলাম নিভৃতে। চে গুয়েভারার মৃত্যু আমার বাউল মনকে বিপ্লবী করেছিল। ক্যাস্টোর বিপ্লবী জীবন এখনো আমাকে অভিভূত করে। '

তিনি কখনো শেকড় বিচ্ছিন্ন হন নি। সুনামগঞ্জকে কখনো ভুলেন নি। কবিতায়,গানে, স্লোগানে,লেখায়, টকশোতে বারবার সুনামগঞ্জের কথাই বলেছেন। তাকে হাওর টানতো। টানতো আসমান ভাইঙ্গা নেমে আসা জোছনার সঙ্গে জলতরঙ্গের অপূর্ব দৃশ্য।

দেশ বিদেশের স্বজন বন্ধুদের কাছে তিনি সুনামগঞ্জকে বর্ননা করেছেন এভাবে- ' ভরা বর্ষায় এ শহর হাতছানি দিয়ে ডাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা কাজী নজরুল ইসলামের দেখা হয় নি এই ভরা পূর্ণিমার সঙ্গে দেখার হাওর বা টাংগুয়ার হাওরের জলতরঙ্গের রুপ। সিলেট এলেও এখানে না আসার আফসোস নিয়ে ফিরেছেন তারা। কবি- রাজনীতিবিদ  সরোজিনী নাইডু এই শহরের রুপ দেখে অভিভূত হয়েছিলেন। মানুষের উঞ্চ ভালোবাসার টানে বারবার এসেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। টাউন হলের এক চিলতে জায়গায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। এখানে আসেন নি ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাঙ কিংবা নেপোলিয়ন। আসেন নি মহাত্মা গান্ধী। কোনো পাঠান যোদ্ধার স্মৃতিচিন্হও নেই এই শহরে। তবু ভরা বর্ষার ভরা পুর্ণিমা রাতের জন্য এ এক অনন্যসাধারণ শহর। এটাই আমাদের নান্দনিক সুনামগঞ্জ।'

সুনামগঞ্জের অনেক অখ্যাত ব্যাক্তিদের তিনি মিডিয়ায় এনে পরিচিত করেছেন কিন্তু কৃতজ্ঞতাটুকু তারা প্রকাশ করেন নি। তিনি মনে করেছেন ঘরেইতো আমার গর্ব করার জায়গা আছে। তাঁর সহোদর অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান পীর ৭৫ পরবর্তী সুনামগঞ্জ ছাত্রলীগে একাধিকবার নেতৃত্ব দিয়েছেন। ক' জনের এ গৌরবময় ইতিহাস আছে?

পীর হাবিব বার বার বলেছেন, এ শহর কবিতার শহর, এ শহর গানের শহর, এ শহর প্রেমের শহর, এ শহর আড্ডার। এ শহরবাসীকে জোছনা দেখাতে বাতি নিভিয়েছিলেন অকাল প্রয়াত কবি মমিনুল মউজদীন। এ শহর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শহর। ঈদের সময় বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংখ্যালঘু স্বজনদের নিমন্ত্রণ করা পারিবারিক দায়িত্ব ছিল। অক্ষয়কুমার আাসাম প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। অনেক মুসলমান পরিবারে তিনি ইফতার পাঠাতেন।

নান্দনিক সৌন্দর্যের এই শহরে এখন টিনের বাংলো ধরনের বাড়িঘর ভেঙ্গে দালানকোটা উঠেছে। বানের স্রোতের মতো বসতি গড়তে আসা মানুষজন হাওর,বাঁওর ভরাট করে বসতি করছে।

এক সময় গভীর রাতে মরাটিলায় কবরস্থানে বসে বাঁশিতে সুর তুলতেন কুতুব উদ্দিন। কবরস্থানের চারদিকে জ্বলতো জোনাকি। এখন বাঁশির সুর নেই। মানুষের কোলাহলে জোনাকিও জ্বলে না। প্রতি শীতে যাত্রাপালা হতো,বাউলের আসর বসতো, কবিয়াল লড়াই হতো। ক্রিকেট লীগ হতো, ফুটবলের আসর বসতো। এখন আর এসব নেই। সর্বশেষ নন্দিত নেতা ও কবি মমিনুল মউজদীনের অকাল মৃত্যুতে শহরে নেমে এসেছে চরম সাংস্কৃতিক বন্ধাত্ব। কেউ দাঁড়ায় না, কেউ এগিয়ে আসে না।

সারাদেশের মতো এখানেও মানুষের হ্রদয়ে ঠাঁই না পাওয়া তথাকথিত রাজনৈতিক কর্মীরা ডিজিটাল ব্যানারে ছবি টানিয়ে অশ্লিল সব দৃশ্য উপহার দিচ্ছেন। যার নামে পোস্টার দেওয়া হয় তাকেও কেউ চিনে না, যে দেয় তাকেও কেউ চিনে না। অবৈধ টাকার জোরে মানুষের কাছে পরিচিত হওয়ার এমন নির্লজ্জ চিত্র শুধু আমার প্রেমের শহরেই নয়, সারা দেশে দেখা যায়। দেশে রাজনীতি আছে,দল আছে, কর্মিও আছে। নেই শুধু জননেতা, ছাত্রনেতা ও রাজবন্দি। এসব এখন নির্বাসিত। মোসাহেব, কর্মচারি, ধান্দাবাজ,দালাল,লুটেরাচক্রের সিন্ডিকেটের ফাঁদে রাজনীতি। সৃজনশীল নেতাকর্মিরা মুখ ঘুরিয়ে ঘরে উঠে যাচ্ছেন।

রাজনীতির অশুভ ছায়ায় তারুণ্যকে কবিতার পান্ডুলিপি,ক্রিকেট ব্যাট বা দোতরা এগিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। কলেজ সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় ছাত্ররা এখন আর ছাত্র রাজনীতি করে না। এমনি সৃজনশীল প্রেমিকও শহরে দেখা যায় না। তারপরও মনে হয় এখনো সময় আছে শহরকে বাঁচানোর।

পীর হাবিব দুই হাতে লিখে গেছেন। সংবাদ ও সাংবাদিকতায় কখনো ক্লান্তি আসেনি। তাঁর বিভিন্ন লেখা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু বই। অফ দ্যা রেকর্ড, এক্সক্লুসিভ, টক অফ দ্যা প্রেস, ভিউজ আনকাট, রাজননীতির অন্দরমহল, পাঠক হ্যদয়ে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা পোয়েট অব পলিটিক্স স্বাধীনতার অন্যতম দলিল।

এর মধ্যে তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। মন্দিরা, লজ্জাবতী, বুনোকে লেখা প্রেমপত্র, জেনারেল ও কালো সুন্দরীরা, পাঠক নন্দিত হয়েছে।

তিনি আত্মজীবনী লেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হয় নি। এ ছাড়া হাছন রাজাকে নিয়ে বড় একটি উপন্যাসের কাজ শুরুও করেছিলেন কিন্তু মরনব্যাধী ক্যান্সারের কারনে সে কাজ আর এগোয়নি। একটি বেসরকারী টেলিভিশনে ' একুশের রাত' উপস্থাপনা করে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

সাংবাদিকতায় অসামান্য অবদান ও উল্লেখযোগ্য কাজ নিয়ে পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে প্রকাশিত হয় 'প্রামাণ্য পীর হাবিবুর রহমান'।  

পীর হাবিব তাঁর লেখনীর মাধ্যমে যুগ যুগান্তর বেঁচে থাকবেন সুনামগঞ্জের মানুষের অন্তরে

লেখক : সাংবাদিক