সৌর পরিক্রমায় দিন যায়, আসে রাত, আবার দিন। উনিশ শ’ একাত্তর সালের ২৫শে মার্চ, বৃহস্পতিবার। দিন পেরিয়ে এক মর্মন্তুদ রাত এসেছিল বাঙালির জাতীয় জীবনে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সেদিন চালিয়েছিলো এক বিভীষিকাময় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। বাঙালি জাতির অতি বিষাদের এক দুঃখের দিন। 

 


হিরোশিমাবাসী যেমন জানতে পারেনি ‘লিটল বয়’ এর মত আদুরে নামধারী ভয়ংকর আর বিধ্বংসী এক মারণাস্ত্র তেড়ে আসছে তাদের ধ্বংস করে দিতে, তেমনি সেদিন ঢাকাবাসী তথা বাঙালি জাতি কল্পনা করেনি, কি দুঃখ-বেদনা-নিধনযজ্ঞের কালোরাত্রি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে চালায় এক নারকীয় হত্যাকান্ড, আর সেই হত্যাযজ্ঞের নাম দিয়েছিলো তারা ‘অপারেশন সার্চলাইট’।

বিশ্বের ইতিহাসে অনেক গনহত্যার উদাহরণ রয়েছে, কিন্তু এরকম আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী নিজ দেশের নিরীহ-নিদ্রিত-নিরপরাধ জনগোষ্ঠির উপর নির্বিচারে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানোর উদাহরন আর দ্বিতীয়টি খুজে পাওয়া যাবে না।

পঁচিশে মার্চ রাতে সমগ্র ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করা হয় এবং সুসজ্জিত সেনাবাহিনী ঢাকার রাস্তায় নামে। একে একে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষককে হত্যা করা হয়। তৎকালীন  হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাত্রদের আবাস জগন্নাথ হল আক্রমনের সময় হল-প্রভোস্টের বাসাও আক্রমন করা হয়। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জনপ্রিয় শিক্ষক, দর্শন শস্ত্রের অধ্যাপক জি সি দেব ও তাঁর মুসলিম দত্তক কন্যার স্বামীকে। হত্যা করা হয় পরিসংখ্যান বিভাগের আধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান, তাঁর পুত্র ও এক আত্মীয়কে। মারাত্মক আহত হন তৎকালীন হল-প্রভোস্ট অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, যিনি পরবর্তিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় হাউজ টিউটর অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকে।

অসহযোগ আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সার্জেন্ট জহরুল হক হল, যেখানে গঠিত হয় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলন পরিষদ’। সেখানে সে রাতে প্রায় ২০০ ছাত্র পাকবাহিনীর হাতে নিহত হয়। রাত বারোটার পর পাকসেনারা জগন্নাথ হলে প্রবেশ করে, মর্টার আক্রমন চালায় এবং নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। হলের ভেতর ঢুকে নির্বিচারে ছাত্রদের হত্যা করতে থাকে। ছাত্রদের কাছে বেড়াতে আসা অনেক অতিথিও সে রাতে প্রাণ হারান এবং রাত থেকে সকাল পর্যন্ত চলে এই হত্যাযজ্ঞ। আর্চার কে ব্লাড রচিত বই ‘দ্যা ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ’ থেকে জানা যায়, পাকবাহিনী এক পর্যায়ে রোকেয়া হলে আগুন ধরিয়ে দেয়। ছাত্রীরা সেই আগুন থেকে বাঁচার চেষ্টায় বাইরে আসতে শুরু করলে সৈন্যরা তাদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায় এবং প্রায় ৩০০ ছাত্রী সে রাতে নিহত হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীও পাকবাহিনীর হাতে সে রাতে নিহত হয়। বিশ^বিদ্যালয় চত্ত্বরে অবস্থিত ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ও সে রাতে রক্ষা পায়নি। তন্মধ্যে রয়েছে কলাভবন সংলগ্ন গুরুদুয়ারা নানকশাহী, রমনা কালী মন্দির ও শহীদ মিনার সংলগ্ন রমনা শিব মন্দির।


শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, পুরো ঢাকা শহরে হানাদারবাহিনী সে রাতে হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে পুরো ঢাকাকে মৃত্যুপুরীতে রূপান্তরিত করে। ব্রিটিশ পত্রিকা ডেইলি টেলিগ্রাফের তৎকালীন সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের মতে, ২৫শে মার্চ রাতে ইকবাল হলের ২০০ ছাত্র, বিশ^বিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার শিক্ষক ও তাদের পরিবারের  ১২ জন নিহত হবার খবর প্রকাশিত হয়। পুরোনো ঢাকায় পুড়িয়ে মারা হয় ৭০০ জনকে। দেশি-বিদেশী বিভিন্ন সূত্র থেকে যে বিবরণ পাওয়া যায়, সে অনুযায়ী এ রাতে শুধু ঢাকায় ৭ হাজার বাঙালি নিহত হয়।


সেই ভয়াল কালোরাতে কত বাঙালিকে প্রাণ দিতে হয়েছিল, এনিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকার ভাষ্যমতে শুধুমাত্র ২৫ শে মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রয় এক লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল যা ইতিহাসে এক জঘন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা। পরবর্তী নয় মাস একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার লক্ষ্যে ৩০ লক্ষ নিরপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যার মধ্য দিয়ে হানাদারবাহিনী পূর্ণতা দিয়েছিল সেই বর্বর ইতিহাসকে। প্রখ্যাত সাংবাদিক এন্থনী মাসকারেনহাস তাঁর ‘রেইপ অব বাংলাদেশ’ বইতে কালোরাত্রির ধ্বংসযজ্ঞ বর্ননা করেছেন এভাবে, ‘ঢাকার রাস্তাঘাট জনশূন্য, বিশাল এলাকা জুড়ে আগুনে পোড়ানোর চিহ্ন, দেকানপাট বন্ধ, গোলার গর্তের চিহ্ন, বুলেটের দাগ, ঘন কালোধোয়ার কুন্ডলী উপরে উঠছে, বাতাস ভারাক্রান্ত। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নারকীয় গনহত্যা সংগঠনের গাঁ কাপানো রূপ দেখেছি। যা দেখেছি তাতে শিউরে উঠেছিলাম। পূর্ব বাংলায় আমি যা দেখেছি, হিটলার বা নাৎসীদের অমানবিক অত্যাচার যা পড়েছি, তার চেয়েও ভয়াবহ মনে হয়েছে। পূর্ববাংলার এই দুর্বিসহ যন্ত্রণার কথা বিশ্ববাসীকে জানাতে হবে’।


মুক্তিযুদ্ধ একদিকে যেমন এনে দিয়েছে দেশের স্বাধীনতা, তেমনি দেশ হারিয়েছে অগণিত প্রাণ, শত-সহস্র শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী, আত্মার আত্মীয়দের। অসংখ্য নারী স্বামী-সন্তান হারিয়েছেন, হয়েছেন বীরাঙ্গনা। রাষ্ট্রীয় সম্পদের হয়েছে অপূরণীয় ক্ষতি। সমগ্র বাঙালি জাতির কাছেই ২৫ শে মার্চের সেই রাতের স্মৃতি আবির্ভুত হয়েছিল তমসাচ্ছন্ন, ভয়াল ও বিভিষীকাময় এক কালোরাত হিসেবে।

লেখক: ড. পীযুষ কান্তি সরকার, অধ্যাপক, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।