মুহিত ভাইয়ের তিরোধান আকস্মিক, তা বলা যাবে না। কিন্তু এই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি যে অপরিহার্য। মন তা কিছুতেই মেনে নিতে চায় না। আমার (এবং আরও অনেকেরই) জীবনের একটি বিরাট অংশজুড়ে তাঁর উপস্থিতি, তাই তাঁর অবর্তমানের জীবন তো কিছুটা অকল্পনীয়ই বটে।

জীবিতাবস্থায় ‘লিজেন্ড’ হওয়ার সৌভাগ্য খুব কম মানুষের জীবনেই হয়। তবে মুহিত ভাইয়ের ৮৮ বছরের সফল সম্পূর্ণ জীবনে সেই ব্যতিক্রম আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।


মুহিত ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা—একাধিক স্তরের পারিবারিক পর্যায়ে। তদুপরি বড় ভাই মরহুম ফারুক চৌধুরীর একজন অন্তরঙ্গতম আবাল্য-সুহৃদ ছিলেন তিনি। তবে বেদনাবিধুর এই মুহূর্তে আমার সংক্ষিপ্ত এই সশ্রদ্ধ স্মৃতিচারণা শুধু ব্যক্তিগত অনুভূতি ও অভিজ্ঞানসজ্জাত।
বিজ্ঞাপন

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-অবসানে ১৯৪৬ সালে শিলংয়ে অধ্যয়নরত আমাদের (ভাইবোনকে) সংক্ষিপ্তকালের জন্য সিলেট রেখে বাবা উত্তর-আসামে চাকরি ব্যাপদেশে যান। তখন জিন্নাহ সাহেব দু-এক দিনের জন্য একবার সিলেট এসেছিলেন। যদিও আমরা তখন স্কুলের ছাত্র, তা আমাদের মধ্যে দারুণ উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। মুহিত ভাইয়ের বাবা আইনজীবী মরহুম আবু আহমদ আবদুল হাফিজ তখন সিলেট মুসলিম লীগের একজন শীর্ষ নেতা। আমার মামা মরহুম আবদুল মতিন চৌধুরী ছিলেন আসাম মুসলিম লীগের একজন কর্ণধার, প্রাদেশিক সরকারের অর্থমন্ত্রী। দেশের সম্ভাব্য রাজনৈতিক বিবর্তনে সচেতনতা তখন প্রায় সর্বজনীন। স্কুল-কলেজের ছাত্ররা টিলাগড়ে এমসি কলেজ মোড়ে জিন্নাহ সাহেবের মোটরবহর থামিয়ে একটি স্বতঃপ্রণোদিত সংবর্ধনা জানিয়েছিল। ওই সময়ই মুহিত ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। তার বছরখানেকের মধ্যেই সিলেটে গণভোট হয়, যার ফলে সিলেট আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তদানীন্তন পাকিস্তানের (এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের) সঙ্গে যুক্ত হয়। সেই কৈশোরকাল থেকে মুহিত ভাইয়ের রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল পরিদৃশ্যমান।

১৯৫৪ সালে যখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি, তখন থেকেই মুহিত ভাইয়ের নিকট-সান্নিধ্যে আসি। ১৯৫২-৫৩ সালে আমি ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলাম ও রাষ্ট্রভাষাসংক্রান্ত আন্দোলনে বহিষ্কৃতও হয়েছিলাম। মুহিত ভাই ছিলেন একজন ভাষাসৈনিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসমাজে একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। ১৯৫৪-৫৫ সালের এসএম হলের সংসদ নির্বাচনে মুহিত ভাই, মরহুম মহবুব আনাম এবং আমি যথাক্রমে ভাইস প্রেসিডেন্ট, জেনারেল সেক্রেটারি এবং জয়েন্ট সেক্রেটারি নির্বাচিত হই। ওই সময়ের প্রচলিত বাক্-বিধি অনুযায়ী তাঁর পরিচিতি ছিল মুহিত-ক্যাবিনেট। ওই ছাত্রসংসদ তখনকার কর্মচঞ্চল ছাত্রজীবনে, বিশেষ করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে একটি অগ্রণী ভূমিকা নিতে পেরেছিল।

ওই সময়ের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। আমরা নির্বাচন মেনিফেস্টোতে ওয়াদা করেছিলাম, হলে পরিবেশিত খাবারের মানোন্নয়ন করা হবে। কিন্তু তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন খাবারের মাসিক ‘ফি’ বৃদ্ধিকরণ। মুহিত ভাই সিদ্ধান্ত নিলেন, তা করতে হলে ছাত্র-সমর্থনের প্রয়োজন। একদিন তাই একটি সাধারণ সভা আহ্বান করা হলো এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে। সে সভায় ফি বাড়ানোর প্রস্তাব গৃহীত হলো না। এটাকে স্বতঃপ্রণোদিতভাবেই অনাস্থা প্রকাশ বিবেচনা করে ‘মুহিত ক্যাবিনেট’ একযোগে পদত্যাগপত্র দাখিল করল। যাহোক, সংসদের প্রেসিডেন্ট (হলের প্রভোস্ট) ড. এম এ গণির নির্দেশে এবং ছাত্রদের অনুরোধে আমরা পরিপূর্ণ টার্ম পর্যন্তই কার্যক্রম চালিয়ে গেলাম। ব্যাপারটি ক্ষুদ্র, তবে তা যৌবনকালেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রতি মুহিত ভাইয়ের আস্থার একটি প্রকাশ বলে ধরা যেতে পারে। পরবর্তী জীবনেও মুহিত ভাই তা প্রদর্শন করেছেন। স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ করার পর তদানীন্তন সামরিক প্রেসিডেন্ট এরশাদ তাঁকে অর্থমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করেন। মুহিত ভাই স্বল্পকালীন এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন শর্ত সাপেক্ষে। কথা ছিল প্রেসিডেন্ট দ্রুত একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করবেন। তা হলো না দেখে মুহিত ভাই অর্থমন্ত্রীর পদ থেকেই পদত্যাগ করেন।

মুহিত ভাই একজন সমাজসচেতন মেধাবী ছাত্রই ছিলেন না, ক্রীড়া এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ছিল তাঁর প্রবল উৎসাহ। তিনি একবার যুগ্মভাবে ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে ডাবলস টেনিস চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন হল টেনিস টুর্নামেন্টের। পরবর্তী জীবনে বাবা (মরহুম গিয়াস উদ্দীন আহমদ চৌধুরী) যখন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট, মুহিত ভাই ছিলেন তার সক্রিয় জেনারেল সেক্রেটারি। তাঁরা ক্রীড়ার ক্ষেত্রে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ সংরক্ষণে খুবই সচেষ্ট ছিলেন। এই সম্পর্কে প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মূসা এবং মুহিত ভাই আলাদাভাবে লিখেছেন। জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকাণ্ডে ছিল মুহিত ভাইয়ের সোৎসাহ অংশগ্রহণ, বাবা ছিলেন ওই অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এই দুই ভূমিকায় মুহিত ভাইয়ের প্রশংসনীয় দায়িত্ব সম্পাদনের ভালো কথা বাবার কাছ থেকে বহু শুনেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবেও আমরা মুহিত ভাইয়ের যথাযথ নেতৃত্ব প্রত্যাশা করেছি।

মুহিত ভাই ছিলেন এ বহুগুণের অধিকারী একজন সম্পূর্ণ মানুষ। ১৯৫৬ সালে তিনি সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে যোগদান করেন এবং মুক্তিযুদ্ধপূর্ব কাল পর্যন্ত অতীব দক্ষতার সঙ্গে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদে কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব সম্পাদন করেন। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হলো, ওয়াশিংটন দূতাবাসে তখন তিনি ইকোনমিক কাউন্সেলর। ’৭১-এর জুন মাসেই তিনি পাকিস্তান সরকারের দায়িত্ব পরিত্যাগ করে দূতাবাসে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিকদের মধ্যে প্রথমেই মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সমর্থনে জোরালো ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে তিনি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব এবং বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি এবং আইডিবিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে কঠিন দায়িত্ব পালন করেন।

আমার মনে আছে, দেশের আরেকজন কৃতী সন্তান মরহুম এস এ এম এস কিবরিয়া যখন জাতিসংঘ এসকাপের নির্বাহী সচিব, আমি তখন ব্যাংককস্থ কমিশনের সচিব, তখন মুহিত ভাই একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্ষিক অধিবেশনে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিতে এসেছিলেন। তখন দেখেছি তাঁর দৃপ্ত ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। তখনই তিনি পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে জাতিসংঘে সম্ভাব্য জোরালো ভূমিকার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি, তিনি হয়েছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

অর্থনীতি, ইতিহাস ও সাহিত্যে ছিল তাঁর তুমুল আগ্রহ, গভীর জ্ঞান ও তা প্রদর্শনে তাঁর অতুলনীয় পারদর্শিতা। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৪০। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনিই সর্বাধিক বাজেট পেশ করেন। বাজেটের আকৃতি ও প্রকৃতিতে প্রভূত উন্নয়ন ও বিস্তৃতি বিধান করে ক্রমান্বয়ে একটি উঁচু মাত্রায় তিনি বাজেটকে নিয়ে যান। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে ‘সভেরেন বন্ড’ ইস্যু না করা তাঁর একটি সঠিক ও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত ছিল, যা সম্ভবত শ্রীলঙ্কার পর্যায়ে বাংলাদেশের স্খলনকে প্রতিহত করেছে।

নির্দ্বিধায় বলা যায়, জীবনের যে ক্ষেত্রেই এ এম এ মুহিত পদচারণা করেছেন, সেখানে পেয়েছেন সাফল্য ও স্বীকৃতি। সিভিল সার্জেন্ট হিসেবে, কূটনীতিক হিসেবে, অর্থনীতিবিদ হিসেবে, মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদ হিসেবে, লেখক হিসেবে, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবে—সর্বক্ষেত্রেই তিনি হয়েছেন সুপ্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে তো বিশ্ব ইতিহাসের ওপর একটি প্রামাণ্য পুস্তক রচনায় তিনি ব্যাপৃত ছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, তাঁর তিরোধান সেই প্রচেষ্টায় ইতি টেনে দিল।

একটি সম্ভ্রান্ত এবং পুরুষানুক্রমে শিক্ষিত পরিবারে নন্দিত পিতা-মাতার ১৪ সন্তানের মধ্যে মুহিত ভাই ছিলেন তৃতীয়। তাঁর সব ভাইবোন এবং দুই পুত্র-এক কন্যা আপন আপন ক্ষেত্রে নিজ গুণেই সুপ্রতিষ্ঠিত। মুহিত ভাইয়ের একটি বড় গুণ ছিল মানুষ হিসেবে সবার কাছেই তাঁর গ্রহণযোগ্যতা, তাঁর নেতৃত্ব ছিল স্বভাবজাত। তাঁর মাঙ্গালিক জীবন যাকেই স্পর্শ করেছে, তাকেই করেছে ঐশ্বর্যবান। সর্বশ্রেণির মানুষের পরম শ্রদ্ধাভাজন একজন অতীব প্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি। দেশকে-মানুষকে-জীবনকে আয়ুষ্কালের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গভীরভাবে ভালোবেসে গেছেন তিনি।

একটি অতিসাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে তিনি ‘প্রথম আলো’ সম্পাদক মতিউর রহমানকে বলেছিলেন, ‘আমি আবার সিলেট যাব।’ বস্তুতপক্ষে খ্যাতি ও ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করেও তাঁর শিকড়ের প্রতি আকর্ষণ কোনো কালেই হ্রাস পায়নি। ধ্রুবতারার মতো তাঁর জীবনের দিকনির্দেশনা দিয়েছে দেশ ও মানুষের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম তীব্র ভালোবাসা এবং আকর্ষণ।

মানুষ সশ্রদ্ধ প্রীতিতে চিরকাল তাঁকে মনে রাখবে। এমন মানুষের মৃত্যু নেই।

 

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে


সূত্র : প্রথম আলো