এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ আমলা দালালপুঁজি বিরোধী নেতা, সিলেট ল’কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রবীণ রাজনীতিবিদ এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ এর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী ২ মে। 

আজ থেকে তিন বছর আগে ২০১৯ সালের ২ মে তারিখে তিনি আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন। এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ শুধুমাত্র একজন আইনজীবীই ছিলেন না; তিনি ছিলেন শিক্ষক, শিক্ষাবিদ এবং সর্বোপরি শ্রমিক-কৃষক দরদী একজন প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ। তিনি তাঁর দীর্ঘ জীবনের অধিকাংশ সময় চা শ্রমিক ও ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি শ্রমিকসহ বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিক, কৃষক ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাদের সংগঠন সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী যুদ্ধ তৎপরতার জটিল পরিস্থিতি ও পরিবেশের মধ্যে প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ এর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা নিবেদন হিসেবে তাঁরই জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে এই লেখার অবতারণা করছি।


সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ মুক্ত শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজ কায়েমের জন্য আজীবন লালিত স্বপ্নদ্রষ্টা মনির উদ্দিন আহমদ ১৯২৩ সালের ১১ মার্চ তৎকালীন আসাম প্রদেশের কাছাড় জেলার হাইলাকান্দি মহকুমার তাঁর নানার মালিকানাধীন কুচিলা চা বাগানে জন্মগ্রহণ করেন। সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাদেপাশা ইউনিয়নের সতুনমর্দন গ্রামের ‘ডেপুটি বাড়ি’ তাঁর পৈতৃক নিবাস। মনির উদ্দিন আহমদ ‘ডেপুটি বাড়ি’ সংলগ্ন ডেপুটি বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। ১৯৪৫ সালে শিলচর গুরুচরণ কলেজ থেকে বিএ পাশ করার পর এমএ পড়ার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাজনিত পরিস্থিতির কারণে পড়ালেখা শেষ না করেই কলকাতা থেকে চলে আসেন। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে ইতিহাস বিষয়ে এমএ এবং একই বছর এলএল বি ডিগ্রি লাভ করেন। সনদ প্রাপ্ত হয়ে তিনি ১৯৫০ সালের ১৭ জানুয়ারি সিলেট জেলা বারে যোগদান করে আইন পেশায় নিয়োজিত হন।
আইন পেশায় একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও সততার জন্য তরুণ আইনজীবী হিসেবে তিনি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। তিনি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমল মিলিয়ে অর্ধ-শতাব্দীরও অধিক সময় একনিষ্ঠভাবে আইন পেশায় অতুলনীয় অবদান রাখেন। আইন পেশার সাথে সাথে তিনি আইনজীবীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে সব সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করাসহ একাধিকবার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। 

তিনি ১৯৭২-১৯৮৩ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সততার সাথে সিলেট জেলার পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আইন পেশার পাশাপাশি সিলেট ল’কলেজে শিক্ষকতা করেন। তিনি ১৯৮২-১৯৮৭ সাল পর্যন্ত সিলেট ল’কলেজের উপাধ্যক্ষ এবং ১৯৮৭ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৯ বছর সিলেট ল’কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে সম্মানের সাথে দায়িত্ব পালন করে উক্ত কলেজটিকে দেশের একটি অন্যতম আইন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। এছাড়াও তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের পরীক্ষক ও মডারেশন কমিটির সদস্য এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি গোলাপগঞ্জ কুশিয়ারা কলেজ, পল্লীমঙ্গল হাসপাতাল, সিলেট শহরের চালিবন্দরে অবস্থিত বসন্ত মেমোরিয়াল শিশু একাডেমি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালনসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে এক অনন্য সৃষ্টিশীল কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন।

ছাত্রজীবনেই মনির উদ্দিন আহমদ রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪০ সালে তিনি তৎকালীন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ‘মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন’ এ যোগ দেন এবং ঐ বছরই উক্ত ছাত্র সংগঠনের হাইলাকান্দি মহকুমা কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কাছাড় জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তৎকালীন রাজনৈতিক উত্তাল সময়ে ১৯৪৬ সালে তিনি সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং অনুধাবন করেন সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ব্যাতীত জনগণের মুক্তি আসবে না। এসব ভাবনায় তাঁর জীবনের মোড় পরিবর্তন হয় এবং ১৯৫০ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। তখনকার সময়ে কমিউনিস্ট পাটির নেতৃত্বে প্রদেশব্যাপী তেভাগা কৃষক আন্দোলন এবং সিলেট অঞ্চলে কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা কমরেড অজয় ভট্টাচর্য এর নেতৃত্বে নানকার প্রথা বিরোধী কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে তিনি অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখেন। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৯ নভেম্বর ‘সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ’র প্রথম সভা এবং ১৯৪৮ সালের ৮ মার্চ গোবিন্দ পার্কের (হাসান মার্কেট) জনসভায় তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। 

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময়েও তরুণ আইনজীবী হিসেবে এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রখেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় হতাহতের ঘটনার খবর সিলেটে পৌঁছলে তিনিসহ আইনজীবীরা আদালত ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসে ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীদেরকে নিয়ে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করেন। উক্ত সমাবেশ থেকে ধর্মঘট আহবান করা হয় এবং সিলেটের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০-২৫ দিন ধর্মঘট পালিত হয়।

সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট ভারত ও পাকিস্তানে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে মনির উদ্দিন আহমদ দাঙ্গার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং মাহমুদ আলী’র নেতৃত্বাধীন সিলেট জেলা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিরোধী শান্তি কমিটির সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ কমিটির নেতৃত্বে ৬/৭ শত হিন্দু মুসলিম ছাত্র যুবকদের সমন্বয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের প্রতিহত করে। এমনি এক পরিস্থিতিতে মুসলীম লীগ সরকারের নানাবিধ জনবিরোধী কাজ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মোকাবিলায় একটি প্রগতিশীল অসাম্প্রাদায়িক ছাত্র সংগঠন গঠন করার নিমিত্তে ছাত্রদেরকে সংগঠিত করে ১৯৫১ সালের ১৬ নভেম্বর প্রশাসনের ১৪৪ ধারা জারিসহ বিভিন্ন বাধাঁ উপেক্ষা করে সিলেট শহর থেকে ১৮ মাইল দূরে ফেঞ্চুগঞ্জ থানাধীন বড় দুইটি টিলার আড়ালে সভা করে সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ‘সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়ন’ গঠন করার ক্ষেত্রে এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন। এর ৫ মাস পর ঢাকায় প্রগতিশীল ছাত্রদর নিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ইউনিয়ন’ গঠিত হলে সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়ন এর শাখা হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হয়। সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়ন গঠন প্রক্রিয়ায় অন্যান্যদের মধ্যে যাঁদের নাম জানা যায় তাঁরা হলেন আসাদ্দর আলী, তারা মিয়া, এডভোকেট জালাল উদ্দিন আহমদ, পীর হবিবুর রহমান, মওলানা শামসুল হক প্রমুখ।

১৯৫০ এর দশকে কমিউনিস্ট ভাবধারার প্রগতিশীল ছাত্র-যুব নেতারা ‘পূর্ব-পাকিস্তান যুব লীগ’ গঠন করেন। মনির উদ্দিন আহমদ ‘পূর্ব-পাকিস্তান যুব লীগ’ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন এবং সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সংগঠন সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেন। হাজী মোহাম্মদ দানেশ এর নেতৃত্বে ১৯৫৩ সালে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সংগঠন ‘গণতন্ত্রী দল’ গঠিত হলে কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে মনির উদ্দিন আহমদ গণতন্ত্রী দলে যোগ দেন। তিনি গণতন্ত্রী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ (ন্যাপ) গঠন প্রক্রিয়ায় এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ সম্পৃক্ত থাকেন। তিনি ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ (ন্যাপ) এর প্রাদেশিক কমিটির সদস্য এবং সিলেট জেলা শাখার প্রথম কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন এর প্রেসিডেন্ট মহামতি কমরেড স্ট্যালিন এর মৃত্যুর পর ক্রুশ্চেভ ক্ষমতায় এসে মার্কসবাদী-লেলিনবাদী তত্ত্বের বিপরীতে সামনে আনে ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’, ‘শান্তিপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা’ ও ‘শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ’ এর সংশোধনবাদী তত্ত্ব। এই আকস্মিক বক্তব্যে বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণি ও পার্টিতে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে মনি সিংহ, বারীন দত্তের নেতৃত্বে পার্টির একাংশ ক্রুশ্চেভের নীতি সমর্থন করেন। কমরেড আবদুল হক, মোহাম্মদ তোহা, সুখেন্দু দস্তিদারের নেতৃত্বে পার্টির অপর অংশ মনি সিংহ এর বক্তব্যের বিরুদ্ধে থিসিস দাখিল করেন। এ নিয়ে মতাদর্শিক প্রশ্নে কমিউনিস্ট পার্টি ও পার্টি প্রভাবাধীন ন্যাপসহ সকল গণ-সংগঠন দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। মনির উদ্দিন আহমদ কমরেড আবদুল হকদের বিপ্লবী লাইনকে সমর্থন করে সংগঠন সংগ্রামে ভূমিকা রাখেন। পরবর্তীতে গত শতকের আশির দশকে মাও সেতুং এর ‘তিনবিশ্ব তত্ত্ব’ কে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিতর্ক শুরু হলে কমরেড আবদুল হক এর নেতৃত্বে ‘মার্কসবাদ-লেলিনবাদ’কে উর্ধ্বে তুলে ধরে মাও সেতুং চিন্তাধারা তথা ‘তিনবিশ্ব তত্ত্ব’কে সংশোধনবাদী শ্রেণি সমন্বয়ের প্রতিবিপ্লবী তত্ত্ব হিসেবে যে মূল্যায়ন উপস্থাপন করেন মনির উদ্দিন আহমদ এর সাথে একাত্ম থাকেন।

এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ আইন পেশা ও রাজনীতির পাশাপশি বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলনেও আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি লেবার ইউনিয়ন, সিলেট ইলেকট্রিক সাপ্লাই শ্রমিক ইউনিয়ন, আজিজ গ্লাস ফ্যাক্টরি শ্রমিক ইউনিয়ন, সিলেট জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি প্রভৃতি সংগঠনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত চা শ্রমিকদের প্রতি তিনি বিশেষ আন্তরিক ছিলেন। অবহেলিত চা শ্রমিকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে জননেতা মফিজ আলী’র সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে ভূমিকা রাখেন এবং ‘পূর্ব-পাকিস্তান চা শ্রমিক সংঘ’ এর কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশের সকল শ্রমিক সংগঠনকে একত্রিত করে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সম্মেলনে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি শ্রমিক, চা শ্রমিকসহ বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিকদের সংগঠিত করে সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনের মাধ্যমে সকল শ্রমিক সংগঠনকে একত্রিত করে ‘পূর্ব-পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন’ গঠিত হলে এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ এর সহসভাপতি নির্বাচিত হন। উক্ত সম্মেলনের আলোচনাসভা ও সাবজেক্ট কমিটির সভায় মনির উদ্দিন আহমদ সভাপতিত্ব করেন। এদেশের সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ আমলা মুৎসুদ্দিপুঁজি বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা কমরেড আবদুল হকের সাথে তাঁর ছিল গভীর আদর্শিক সখ্যতা। আমৃত্যু তিনি সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অবিচল থেকে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের সাথে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রেখে গেছেন। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট এবং এর সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ, চা শ্রমিক সংঘ, জাতীয় ছাত্রদল আয়োজিত বিভিন্ন কাউন্সিল উদ্বোধনসহ সভা-সমাবেশে বক্তব্য প্রদান করেন।

সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে আন্দোলন সংগ্রামের জন্য মনির উদ্দিন আহমদকে বিভিন্ন সময় কারাবরণ করতে হয়। গণতন্ত্রী দল করার সময় ১৯৫৩ সালে তিনি প্রথম কারাগারে যান এবং ২১ দিন কারাভোগ করেন। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ৯২(ক) ধারা জারির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল করে গভর্নরের শাসন জারি করেন। তখনকার সময় যুক্তফ্রন্ট ও প্রগতিশীল কর্মীদেরকে গণহারে গ্রেফতার করা হয়। তিনি আবারো গ্রেফতার হন। এসময় জেলের মধ্যে রাজবন্দীদেরকে ‘সফ্ট ক্যাম্প’ ও ‘হার্ড ক্যাম্প’ দুই ভাগে আলাদা করে রাখা হতো। আওয়ামীলীগার কর্মীদেরকে সফ্ট ক্যাম্পে আর কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পর্কিত প্রগতিশীল কর্মীদেরকে হার্ড ক্যাম্পে রাখা হতো। সফ্ট ক্যাম্পের বন্দীদেরকে কয়েক মাস পরেই ছেড়ে দিত আর হার্ড ক্যাম্পের বন্দীদেরকে দীর্ঘ সময় কারাগারে থাকতে হতো। মনির উদ্দিন আহমদ হার্ড ক্যাম্পের কারাবন্দী হিসেবে প্রথমে সিলেট ও পরে স্থানান্তরিত হয়ে ঢাকা কারাগারে এক বছর কারাভোগ করেন। ১৯৬৯ সালে ভাসানী ন্যাপের সিলেট জেলার সভাপতি হিসেবে গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থানের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য তিনি আবারো গ্রেফতার হন এবং এক মাস কারাভোগ করেন। ঘটনাচক্রে দেখা যায়, তাঁর বাবা যে জেলের জেলার রাজনৈতিক কারণে সেই জেলেই তিনি তিনবার জেল খাটেন।

আজ এমন এক সময় এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদকে স্মরণ করছি যখন সমগ্র বিশ্বে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তোলপাড় চলছে। ইউক্রেনে সংঘটিত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ তীব্রতর হয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপদ এমনকি পারমাণবিক যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার বিপদ সামনে আসছে। পুঁজিবাদের অসম বিকাশের নিয়মে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যে পুঁজি ও শক্তির অনুপাত পরিবর্তিত হওয়ায় বাজার ও প্রভাব বলয় পুনর্বন্টন নিয়ে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মুদ্রাযুদ্ধ-বাণিজ্যযুদ্ধ, স্থানিক ও আঞ্চলিক যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ সামনে এসে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার বিপদ আরো সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। একদিকে রয়েছে একক পরাশক্তি মার্কিনের নেতৃত্বে ইউরোপের ন্যাটোভুক্ত সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো, অন্যদিকে প্রতিপক্ষ সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া ও বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে অগ্রসরমান পুঁজিবাদী চীন।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯৯১ সালে দুই পরাশক্তির অন্যতম সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন কারণে পতন ঘটে খন্ড-বিখন্ড হয়ে ১৫টি দেশে পরিণত হয় এবং রুশ ফেডারেশন সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসেবে কার্যকরী থাকে। একক পরাশক্তি হিসেবে সামনে আসে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী শক্তি সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়ায় মার্কিন নেতৃত্বে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের প্রাক্তন প্রভাব বলয়ভুক্ত পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউরোপীয় কয়েকটি প্রজাতন্ত্রকে ধাপে ধাপে ন্যাটোভুক্ত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত করে চলে। তারা জর্জিয়া ও ইউক্রেনকেও ন্যাটোভুক্ত করার পাঁয়তারা চালাতে থাকে। মার্কিন আগ্রাসী যুদ্ধ পরিকল্পনায় মার্কিন নেতৃত্বে ইউরোপের সমন্বিত ভূমিকা; আইএস পরিকল্পনায় ইউরোপের সক্রিয় ভূমিকা পালন; রাশিয়াকে মোকাবিলা করার লক্ষ্যে ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ এবং ইউরোপের মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অব্যাহত ভূমিকা রাখা; ২০১৪ সালে ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বে ন্যাটোতে সম্পৃক্ত থাকা; রুমানিয়া ও পোল্যান্ডে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা; পূর্ব ইউরোপে এবং বাল্টিক দেশগুলোর রুশ সীমান্তে চলমান সামরিক মহড়ায় সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করা; মার্কিন নেতৃত্বে ন্যাটো তথা ইউরোপের রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন রূপের ধারাবাহিক সামরিক মহড়া ও তৎপরতা অব্যাহত রাখে।

মার্কিন নেতৃত্বে পাশ্চাত্য তাদের অনুগত পেট্রো পেরোশেঙ্ক সরকারের ধারাবাহিকতায় ভলোডিমির জেলনস্কি সরকারকে ক্ষমতায় এনে ইউক্রেনকে ব্যাপক অস্ত্রসজ্জিত ও প্রশিক্ষিত করে ন্যাটোভুক্ত করার তৎপরতা জোরদার করে। সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া এটা তার জন্য বিরাট হুমকি বিবেচনা করে ন্যাটোর সাথে আলোচনা প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনকে "বেসামরিকীকরণ ও নাৎসিমুক্ত করা"র কথা বলে বিশেষ সামরিক অভিযানের কথা বলে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে। রাশিয়া এতদ্বঞ্চলে তার হারানো প্রভাব বলয় পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার প্রেক্ষিতে এই যুদ্ধ শুরু করে। এই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে আড়াল করে বিশ্ব জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য মার্কিনের নেতৃত্বে পাশ্চাত্য রাশিয়াকে আগ্রাসী শক্তি হিসেবে এবং নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক, শান্তিবাদী, মানবতাবাদী চিহ্নিত করে ব্যাপক প্রচার তৎপরতা চালায়। অথচ তারা আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ায় আগ্রাসন চালিয়ে লক্ষ লক্ষ জনগণকে হত্যা করে। আর রাশিয়া মার্কিন নেতৃত্বে ন্যাটোর সামগ্রিক তৎপরতা তার নিরাপত্তার জন্য বিরাট হুমকি বিবেচনা করে তা মোকাবিলার কথা বলে তার আক্রমণের সাফাই গায়। রাশিয়া তার পারমাণবিক শক্তিকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে অস্তিত্বের সংকটে পড়লে তা ব্যবহার করতে পারে বলে ঘোষণা দেয়। রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় রাশিয়া চীনের সহযোগিতায় অগ্রসর হচ্ছে। উভয়পক্ষই উগ্রজাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। এই যুদ্ধে ইউক্রেনের জনগণকে কামানের খোরাক ও লক্ষ লক্ষ নারী-শিশু-বৃদ্ধকে শরণার্থী করে এবং জ্বালানি, খাদ্য মূল্য বৃদ্ধিসহ চলমান বৈশ্বিক মন্দার বোঝা বিশ্ব জনগণের উপর চাপিয়ে বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণের দুঃখ-কষ্ট, দুর্দশা-দুর্ভোগ বৃদ্ধি করে চলেছে। পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের অংশ হিসেবে ২০০৮ সালে সূচিত এ পর্যায়ের বৈশ্বিক মন্দা করোনার প্রভাবে আরো তীব্রতর হয়ে মহামন্দার দিকে ধাবিত হওয়ায় সাম্রাজ্যবাদীরা এ থেকে বের হতে আগ্রাসী যুদ্ধের পথে অগ্রসর হয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপদ ও সম্ভাবনাকে আরো সামনে এনেছে, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে।

জাতীয় ও আন্তার্জাতিক এক জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা অগ্রসর হচ্ছি। সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের মধ্যে সবচেয়ে বড় মন্দা ও সংকটে নিমজ্জিত। ২০০৮ সাল থেকে সৃষ্ট এ সংকট সাম্রাজ্যবাদের ব্যবস্থাজনিত অন্তর্নিহিত অতি উৎপাদনজনিত সংকট। করোনা পরিস্থিতি যাকে আরো বিপর্যস্ত করেছে। দীর্ঘস্থায়ী বৈশ্বিক মন্দায় ২য় শীতলযুদ্ধ, তৃতীয় শীতলযুদ্ধ ইত্যাদি প্রসঙ্গ সামনে আসছে। অসম বিকাশের নিয়মে পুঁজি ও শক্তির অনুপাত পরিবর্তিত হওয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটেন উডস সম্মেলনে গঠিত সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, গ্যাট, জি-৭, জি-৮ ইত্যাদির কার্যকারিতা হারাতে থাকলে আন্তর্জাতিক শক্তি সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়ায় গঠিত হয় জি-২০। তাতেও মন্দা পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ মিলছে না। বাজার ও প্রভাব বলয় বৃদ্ধির প্রশ্নে বাজার পুন:বণ্টনের জন্য মুদ্রাযুদ্ধ, বাণিজ্যযুদ্ধ, স্থানীয়যুদ্ধ, আঞ্চলিকযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় তারা বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বে যার প্রতিফলন ঘটছে এবং বর্তমানে যা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। তাদের এই যুদ্ধ প্রস্তুতি থেকে আমাদের দেশও মুক্ত নয়। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থল সংযোগ সেতু, তিন দিকে আধা-সামন্তবাদী ভারত ও উত্তরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্যে দ্রুত অগ্রসরমান পুঁজিবাদী চীন, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও মালাক্কা প্রণালী থাকায় বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের ভৌগোলিক গুরুত্ব বিবেচনায় এতদ্বাঞ্চলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে ইন্দো-প্যাসিফিক পরিকল্পনা এবং চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) পরিকল্পনা কার্যকরী করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে। তাছাড়া এতদ্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান-অষ্ট্রেলিয়া-ভারতকে নিয়ে চতুষ্ঠয় জোট গঠনসহ বিভিন্ন তৎপরতা চালাচ্ছে। বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে দ্রুত অগ্রসরমান পুঁজিবাদী চীন এতদ্বাঞ্চলে তার অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য বাংলাদেশে তার প্রভাব আরো বৃদ্ধি করে নিয়ন্ত্রণ ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ধারাবাহিক তৎপরতার প্রেক্ষিতে সরকারি ও বেসরকারি উভয় রূপে বিনিয়োগ ও ঋণচুক্তি স্বাক্ষর, সমুদ্রসীমা সুরক্ষা উন্নয়ন, পায়রা সমুদ্র বন্দর নির্মাণের আংশিক কাজের প্রাথমিক চুক্তি, চীনের সাথে দু’দেশের স্বরাষ্ট্র বিষয়ক ৩টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর ইত্যাদি পদক্ষেপ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। চীনের ষ্ট্রিং অব পার্লস, বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই‘), সিল্ক রোড, বিসিম (বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মায়ানমার) ইকোনোমিক করিডোর এবং জাপান ইন্দো-প্যাসিফিক করিডোর ইত্যাদি পদক্ষেপ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। ভূ-রাজনৈতিক ও রণনীতিগত গুরুত্বের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব চলমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে সংঘাত ও যুদ্ধের বিপদ বৃদ্ধি করছে।

বিশ্ব শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণকে এই অন্যায় সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। দেশে দেশে বিপ্লব তথা বিপ্লবী যুদ্ধকে তীব্রতর করে এর মোকাবিলা করতে হবে। যুদ্ধ তথা অশান্তির উৎস সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেই কেবল স্থায়ী বিশ্বশান্তি স্থাপন সম্ভব। সাম্রাজ্যবাদী সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকেই বিরোধিতা করতে হবে, দুই পক্ষের কোন পক্ষকেই সমর্থন করা যাবে না। ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে উভয়পক্ষের গণবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী স্বরূপ উন্মোচিত হয়ে চলেছে। সংশ্লিষ্ট সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে শ্রমিক শ্রেণীর করণীয় হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা এবং সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব বিপ্লবের পথে অগ্রসর হওয়া। ইউক্রেনের শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণের করণীয় হচ্ছে সকল সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব জয়যুক্ত করা। আমাদের দেশের শ্রমিক-কৃষক-জনগণকেও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের শোষণ-লুন্ঠন এবং দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি দেশ ও সমাজকে নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাজনীতি বিমুখ করার কাজে এরা নিয়োজিত। যুব সমাজের শক্তিকে হীনবল করতে মাদক, অস্ত্রবাজী, নারী নিগ্রহ এ সকল পথ বেছে নিয়েছে। এই প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আজ প্রগতিশীল শক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে। এই দেশের কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-যুবসমাজ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে জীবন দিয়েছে, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের কর্মকান্ডকে বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেয়নি। নতুন করে বর্তমানেও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সকল প্রগতিশীল শক্তিকে সম্মিলিতভাবে হায়েনাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাদের সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্তকে রুখতে হবে। ঐক্যবদ্ধ প্রগতিশীল শক্তি আমাদের দেশে অতীতেও এমন অনেক স্বৈরাচার, স্বৈরাচারের দোসরদের পতন ঘটিয়েছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ আমলা দালালপুঁজি বিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অনন্য ব্যক্তি এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ এর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছি। এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ স্বপ্ন দেখতেন এদেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ ও আমলা দালালপুঁজিকে উচ্ছেদ করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করার। তাঁর প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকার ছিল একটি নতুন বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার। এ লক্ষ্যে তিনি ছাত্রাবস্থা থেকে জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় দ্বিধাহীন চিত্তে লড়ে গেছেন তাঁর আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। সমাজতন্ত্রই মানব মুক্তির একমাত্র পথ- এ ছিল তাঁর দৃঢ় উপলব্ধি। এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ এর এই মতাদর্শ ও আজীবন লালিত স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার মাধ্যমেই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব।

 


লেখক: সভাপতি, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, সিলেট জেলা শাখা।