বন্ধু গো ! আমি বনে গেছি এক মহা আহম্মক ! অথচ, দেশে-বিদেশে আমি ৪৫ বছরের (রানিং) বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যায়ের ইংরেজি ভাষা ও ইংরেজি সাহিত্যের একজন অধ্যাপক।

আজ মাত্র ১৩ মে, এসেছে ২০২২ সালের প্রথম বন্যা। শুনুন দয়া করে, একটি ভাংগা-চোরা ছোট্ট কার-গাড়ির অবস্থা। উরু-পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে আমার উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মৌলানা গোলাম আম্বিয়া (কয়েস) ড্রাইভারকে* হাতের ইশারায় সিগনাল দিচ্ছেন, “আর এগুবেন না, আর এগুবেন না”। নিজ বুকের উপরে হাত লাগিয়ে দূর থেকে দেখাচ্ছেন, সামনে ঐ পর্যন্ত ভাসান পানি, গুলা আর স্রোৎ, অর্থাৎ, আগালে আপনার পুরো গাড়িই তলিয়ে যাবে। 


কিন্তু এক্সপার্ট ড্রাইভার ভাবলেন, এই অবস্থায় ড্রাইভ করে পেছনে ফেলে এসেছেন পানিতে ডুবে যাওয়া, গুলা আর স্রোতের মাইলখানেক হাইওয়ে ! এখন আবার ডুবন্ত মাইলখানেক রাস্থা পেছন দিকে ড্রাইভ করে যাওয়াটা মোটেই সহজ কাজ নয়, বা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, কারণ, পেছন তো পেছন-ই। ড্রাইভার দেখলেন, সামনে একটা উঁচু পাকা ব্রীজ আছে। তিনি মনে করলেন, পেছনে যাওয়ার রিস্ক থেকে সামনে এগুনোটা-ই উত্তম হবে, অন্ততঃ, সামন দেখা তো যাবে।

কিন্তু, হাত দশেক এগুতেই গাড়ির সীট পর্যন্ত, অর্থাৎ ড্রাইভিং সীটে বসা ড্রাইভারের কোমর পর্যন্ত পানিতে ভিজে গেল। ড্রাইভার ভাবলেন, কোনমতে পেন্টের পকেট থেকে বের করে মোবাইলটা বাঁচাই, কিন্তু, ইতিমধ্যেই ভিজে যাওয়া মোবাইলটি পকেট থেকে টানাটানি করার এক পর্যায়ে হাত ফস্কে তাঁর ঐ যন্ত্রটি গাড়ির ভেতরেই টপাস করে পড়ে গেল। ড্রাইভার ভাবলেন, গাড়ির ভেতরে হাঁটু পানি, ঢেউ আর স্রোতেরে মধ্যে ওটি খোঁজতে গেলে পাওয়াও যাবে না, আর এই ফাঁকে ছোট্ট এ গাড়িটি গুলায়-স্রোতে ভেসেও যেতে পারে। 

তাই বিজ্ঞ ড্রাইভার কোনমতে প্রথম গিয়ার লাগিয়ে সামনেই চললেন। কিন্তু আর মাত্র তিন/চার হাত এগুতেই গাড়ির আর এগুনো সম্ভব হলো না। উরু-পানিতেই ৭/৮ জন লোক হেঁটে যাচ্ছিলেন। মিঃ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যন সমূহ বিপদ আঁচ করতে পেরে সবাইকে ডেকে বললেন, “অইছে না, আও রে ভাই-ওখল, হখলে এখলগে জোরে ধাক্কা দেও, গাড়িটা কোনমতে ব্রীজো গিয়া উঠুক। কাজ তা-ই হলো। ড্রাইভার গাড়িটি ব্রীজের উপর ফেলে রেখে একটা নৌকা ভাড়া করে হাতিরপাড়া সড়কে গিয়ে একটি সিএনজিতে উঠলেন, এবং ঐ পাকা সড়কেও প্রায় মাইলখানেক সিএনজির সীট পর্যন্ত পানি ভেঙ্গে হাকুরবাজার নামক বাজারে গিয়ে আর একটি সিএনজিতে উঠে প্রায় ৫ ঘন্টা পর সিলেট শহরে নিজ বাসায় এসে পৌঁছলেন। অথচ, দূরত্ব মাত্র ২৯ মাইল বা ৪৫ কিলোমিটারের মত, লাগার কথা দেড়-ঘন্টা-খানেক।

 প্রিয় পাঠক/পাঠিকাবৃন্দ,
স্থানটা আর কোথাও নয়, এটি সিলেটের বৃহত্তম উপজেলা গোয়াইনঘাট। আমাদের অজস্র পাথর-কোয়ারি- সহ সবই আছে। আমাদের আছেন সিভিল ইন্জিনিয়ারগণ, আছেন সর্বমাননীয় উপজেলা উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, এমপি, এবং উচ্চপর্যায়ের মাননীয় মন্ত্রী !
এবার এ মহা দুর্দশার কথাগুলো/কারণগুলো আমি একে একে বলিঃ
১/ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ও দায়িত্বশীলদের মুখ থেকে প্রায়ই শুনা যায়, এত এত কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে এই রাস্তার জন্য, এত এত কেটি টাকা ঐ রাস্তার জন্য। কিন্তু প্রত্যেকটি রাস্তার বেহাল দশার ৩২টা বাজার পর একেকটি রাস্তার কাজ একবার হয় ৫/৭ বছর পর পর। এজন্যই পত্রিকান্তরে পাওয়া যায়, ভাঙ্গা রাস্তার ধাক্কাধাক্কি খাইয়া, ভাঙ্গা রাস্তার বিরাট বিরাট গর্তের ঢেউ খেলাইয়া ও নাচানাচিতে পথিমধ্যেই আমাদের মা-বোনদের বাচ্চাও প্রসব হয়, কোন ডাক্তার-নার্স ব্যতিরেকেই, কত ভাগ্যবান আমরা ! 

২/ কোন দুর্নীতির কথা আমি এখানে আনব না, আর আনতে পারলেও কোন লাভ হবে না, যদিও শোনা যায় বিভিন্ন সেক্টরে দূর্নীতি হয় বিভিন্ন পন্থায়, কারণ, আমি মূলতঃ আপাদমস্তক একজন শিক্ষক, কোন প্রমান হাজির করতে আমি পারব না, যেহেতু আমি ঐ সেক্টরের কেউ নই, অধিকন্তু, আমি আমার অধ্যয়ন, গবেষণা, লেখালেখি ইত্যাদিতেই মশগুল, ঐ সমস্ত খবর নেবার মূহুর্ত-ফুরসত/সময়ও আমার আদপেই নেই। কিন্তু টাকা কি ভাবে খরচ হয় জানেন?

৩/ উদাহরণস্বরূপঃ একটি রাস্তার একটি অংশের কাজ ধরা হলো। প্রথমেই বিজ্ঞ (?) ইন্জিনিয়ারগণ ঐ অংশের সকল চাকলা-বাকলা, আগেরবারের সকল কংক্রীট-মাটি সব উঠিয়ে ফেলেন। ফলে রাস্তার ঐ অংশ প্রারম্ভেই হয়ে যায় পূর্বের চাইতে এক হাত নিচু। মাশাল্লাহ্, তারপর, আবার ফেলা হয়, হয়ত পচা ইটের গুড়া ও কিছু ইটের ভাঙ্গা টুকরা-সম্বলিত মাটি, আর না হয়, মরা পাথরের কংক্রীট-সম্বলিত বালু-মাটি, তারপর উপরে দেয়া হয় পাতলা পীচ-ঢালাই। দেখভাল করার মত তো কেউ নেই। তাই/অর্থাৎ, নব-নির্মিত রাস্তা শেষশেষ হয়ে যায় পূর্বেকার রাস্তার চাইতে আরো আধ হাত নিচু, উচুঁ হওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না। আর, ঐ রাস্তাটি টিকে মাত্র বছর দেড়েক। ৫/৬ বছরের জন্য আবার পূর্বেকার ঐ দুরবস্থা। অর্থাৎ, যত শীঘ্র পারে, সরকার আবার টাকা দেক। হায়, রে, আমাদের দেশপ্রেম, ফুসলাইয়া উঠিতেছে, আর কি ?

৪/ আমাদের মহাজ্ঞানী-মহাকন্সট্রাকটিভ (?) ইন্জিনিয়ারগণের পানির উচ্চতা-জ্ঞান যে কতটুকু, তা ৫০০% প্রশ্নবিদ্ধ। উত্তর হবে যীরো। তা না হলে, বেনিয়া-ঔপনিবেশিক বৃটিশদের করা রাস্তা আজ অবধি একটিও ডুবায় না কেন ?

৫/ এলাকার সবার জানা আছে, প্রায় ৬ বছর খানা-খন্দে চলাচল করার পর মাত্র দু-দেড় বছর আগে পুনঃকার্পেটিং করা হয়েছিল গোয়াইনঘাট-সালুটিকর রাস্তাটি। মাশাল্লাহ, দেড় বছরের মধ্যেই ওটি আবারও পরিনত হয়েছে একটি মরন-ফাঁদে।

৬/ আজও শুনলাম, গোয়াইনঘাট-সালুটিকর ভাঙ্গা রাস্তাটিও প্রায় অংশই ডুবন্ত। গোয়াইনঘাট-রাধানগর রাস্থাটিও ডুবন্ত।

৭/ সারি-গোয়াইনঘাট রাস্তাটি সর্বপ্রথম সিমেন্ট-পাকা হয়েছিল ১৯৬৫টি সালের দিকে। এটির আজকের উচ্চতার চাইতে তখনকার উচ্চতা ছিল অন্ততঃ দেড়-দুই হাত বেশি। অর্থাৎ, যতবারই পুনঃকার্পেটিং হয়েছে, ততবারই এটি নিচু হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, আজ ১৩ মে, ২০২২-এর প্রথম বন্যাতেই ‘বার্কিপুর’ হইতে ‘বেখ- রার পুল’ পর্যন্ত প্রায় ২ মাইল রাস্থা পায়ের ঘন্টা পানি হইতে উরু পানিতে ডুবন্ত। এর পর ‘লাফনাউট’ এলাকায় হবে আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত গলা পানি। আজ রাতেই হয়তো ‘বরোহাল’ এলাকাও ডুববে। আর পানির যা বাড়ন্তি দেখে এসেছি, আগামিকাল হয়তো এই ‘হাইওয়ে‘-র উপর দিয়ে লঞ্চ-স্টীমারও চলবে !

৮/ আসার পথেই শুনেছি, ‘ডৌবাড়ি’ এলাকার বেশি-অর্ধেক রাস্তাই নাকি অলরেডি ডুবে গেছে। 

৯/ এখন একটিবার দূরের কথা বাদ দিলাম। আসি একটু সিলেট মহানগরে। নগরের প্রানকেন্দ্রের হাওয়াপাড়া-বাসী অতিষ্ট হয়ে নাকি কয়েকবছর পূর্বে পীচ-ঢালা জনপথের পরিবর্তে নৌকা চেয়েছিলেন !

১০/ আম্বরখানা সাপ্লাই গেইটের আমার আত্মীয়-বাড়ির অবস্থা, তাদের মহল্লাবাসীর অবস্থা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। একটু বৃষ্টি হলেই ‘গু-মুতর’ পানির সেচকার্য করার জন্য ‘খান্জা হিসার হেওত’ লাগত, শুনছি, এখনও নাকি লাগে।

১১/ কত এলাকার ব্যাপারে আমি এ ক্ষুদ্র শিক্ষক কত লিখা যে লিখেছি। সবই বৃথা।

১২/ দুই বছর মদিনামার্কেট-পাঠানটুলা এলাকার ‘গু-মুতর’ পানি ছানতে ছানতে আমি একটি পত্রিকায় কলাম লিখেছিলাম “পাঠানটুলার পোড়া কপাল” শিরোনামে। 

অবশেষে, জাতীয় কবিকে স্মরন করতেই হয়ঃ

“বন্ধু গো ! বড় বিষজ্বালা এই বুকে.
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি,
তাই, যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা,
তাই লিখে যাই, এ রক্ত লেখা,
বড় কথা, বড় ভাব, আসে নাকো মাথায়,
বন্ধু ! বড় দুঃখে,
অমর কাব্য লিখিও তোমরা বন্ধু,
যাহারা আছ সুখে”।

* ড্রাইভার=স্বয়ং আমি (৬৮+) ।

লেখক : ইংরেজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও ২৪ বছরের সাবেক বিভাগীয় প্রধান, বিভাগের সাবেক জ্যেষ্ঠতম অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, ও দেশে-বিদেশে ৪৫ বছরের ইংরেজি ভাষা ও ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক।