বিশ্বজুড়ে করোনার ভয়াবহ প্রকোপে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছিলো। সেই অবস্থা থেকে এখনো পুরোপুরি পরিত্রাণ মেলেনি। এর মধ্যেই মাঙ্কিপক্স রোগের বিস্তার পৃথিবীজুড়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।

১৯৭০ সালে জায়ারে বর্তমানে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে প্রথম মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়। এ রোগে প্রথম আক্রান্ত হয় ৯ বছর বয়সী এক শিশু। ১৯৭০ সালের পর থেকে আফ্রিকার ১১টি দেশে মাঙ্কিপক্স ছড়িয়ে পড়ে। আর ২০০৩ সালে আফ্রিকার বাইরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম এই রোগ শনাক্ত হয়।


সম্প্রতি নতুনভাবে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপসহ বেশ কিছু দেশে কয়েক ডজনের বেশি মাঙ্কিপক্সের রোগী শনাক্ত হয়েছে। চলতি মাসের শুরু থেকে এ রোগে সংক্রমণের সংখ্যা ক্রমাগত উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই রোগ সমকামী পুরুষদের ক্ষেত্রে বেশি ছড়াচ্ছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

মাঙ্কিপক্স সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের গবেষকদের মতে, মাঙ্কিপক্সকে আগে যৌনবাহিত রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (সিডিসি) বলছে, ‘যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে’ বেশির ভাগ মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে।

বিশ্বে আরও তিনটি দেশে নতুন করে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বর্তমানে মোট ২১টি দেশে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়েছে।

বিবিসি জানায়, গতকাল মঙ্গলবার আরব বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়েছে। একই দিনে ইউরোপের চেক প্রজাতন্ত্র ও স্লোভেনিয়াতেও মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়েছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের এক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, তাদের দেশে এক নাগরিকের শরীরে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়েছে। ওই ব্যক্তি সম্প্রতি পশ্চিম আফ্রিকা ভ্রমণে গিয়েছিলেন। তাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। যেকোনো প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় পূর্ণ প্রস্তুতি আছে তাদের। রোগটি শনাক্ত করতে আগাম নজরদারির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

মাঙ্কিপক্স হচ্ছে একটি ভাইরাস। এটি পশু থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। জ্বর, গায়ে ব্যথা, আকারে বড় বসন্তের মতো গায়ে গুটি ওঠাকে আপাতত মাঙ্কিপক্সের উপসর্গ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

আফ্রিকায় দড়ি কাঠবিড়ালি, গাছ কাঠবিড়ালি, গাম্বিয়ান ইঁদুর, ডর্মিসের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির বানর এবং অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে মাঙ্কিপক্স পাওয়া গেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ ঘটলেও তা সীমিত সংখ্যায় হয়ে থাকে।

রক্ত, শারীরিক তরল ও সংক্রমিত প্রাণীর শ্লেষ্মার সরাসরি সংস্পর্শে এলে মানুষের শরীরে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ ঘটতে পারে। এ ছাড়া, শ্বাস-প্রশ্বাস, সংক্রমিত ব্যক্তির ত্বকের ক্ষত বা তার ব্যবহৃত জিনিসপত্রের সংস্পর্শে এলে মানুষে মানুষে সংক্রমণ ঘটতে পারে।

গত সোমবার বিশ্ব স্বাস্থ্য জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যে কিছু ক্ষেত্রে পুরুষ থেকে পুরুষে শারীরিক সংসর্গে এই রোগ ছড়ানোর ঘটনা ঘটেছে। তবে এ বিষয়ে এখনও স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

মাঙ্কিপক্স সাধারণত উপসর্গ দেখা দেওয়ার দুই থেকে চার সপ্তাহ স্থায়ী হয়। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এই সময় বেশি হয়। এই ভাইরাসে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যান। এ রোগে মৃত্যুর সংখ্যা খুবই কম।

তবে এ রোগ ছড়ানোর মাত্রা, রোগীর শারীরিক অবস্থা ও কী কী জটিলতা তৈরি হয়েছে, তার ওপর এর ভয়াবহতা নির্ভর করে।

এ রোগের একটি ধরন এতটাই ভয়ংকর যে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ১০ শতাংশ এ রোগে মারা যেতে পারেন।

এ রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। তবে গুটিবসন্তের টিকা মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে ৮৫ শতাংশ কার্যকর। কিন্তু বিশ্বজুড়ে গুটিবসন্তে আক্রান্তের সংখ্যা নিম্নমুখী হওয়ায় বর্তমানে এ রোগের টিকা পাওয়া খুবই কঠিন।

সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এরিক ফিগেল-ডিং বলেন, গুটিবসন্তের টিকা মাঙ্কিপক্সের বিরুদ্ধে কার্যকর এটা ভালো সংবাদ। কিন্তু খারাপ সংবাদ হচ্ছে, ৪৫ বছরের নিচে অনেকেরই এই টিকা দেওয়া নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঙ্কিপক্স নিয়ে এখনও বাংলাদেশের ভয়ের কোনো কারণ নেই। এছাড়া করোনাভাইরাসের মতো এটি এতোটা সংক্রামকও নয়। তাই এই ভাইরাস নিয়ে এতোটা উদ্বিগ্ন না হয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সতর্কতার পরামর্শ তাদের।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে মাঙ্কিপক্স আসবে কি না এটি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এজন্য আমাদের কিছু বিষয় বুঝতে হবে, এর মধ্যে একটি হলো উৎস। এক্ষেত্রে মাঙ্কিপক্সের প্রধান উৎস হলো মধ্য এবং পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে এটি এনডেমিক ডিজিজ। আর দ্বিতীয়ত এই রোগের উৎস হলো, ইদানিং ১২/১৪টি দেশে এই রোগে আক্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে সে দেশগুলোতে কিন্তু এখনও প্রমাণিত হয়নি যে রোগটির কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হচ্ছে। তার মানে আমাদের দেশে রোগটি আসার ক্ষেত্রে আমরা ধরতে পারি, মূল সোর্স হলো পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকা।

তিনি বলেন, আফ্রিকার এসব দেশ থেকে যদি রোগটির বাংলাদেশে আসতে হয়, আসতে হবে ব্যক্তির মাধ্যমে। সেটি হতে পারে বাংলাদেশি কেউ যদি ওখানে থাকেন এবং এই সময়ে দেশে আসেন, তাহলে তার মাধ্যমে ভাইরাসটি আসতে পারে। এর বাইরে যদি আফ্রিকার কোনো নাগরিক বাংলাদেশে আসে, তার মাধ্যমেও ভাইরাসটি আসতে পারে। এক্ষেত্রে আমাদের খুব বেশি লোক যে আফ্রিকায় থাকে সেটি বলা যাবে না, এমনকি বাংলাদেশেও যে ওইদেশের লোকজন বেশি আসে তাও না। তারমানে এই দাঁড়ায় যে, ভাইরাসটি বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার আশঙ্কা খুব বেশি নেই। এরপরও আসতে পারে, সেক্ষেত্রে আমাদেরকে নিজেদের অবস্থান থেকে সতর্ক থাকতে হবে।

 

সিলেটভিউ২৪ডটকম/টিএস-০৮


সূত্র : ঢাকাটাইমস