সিলেটি ভাষার একটা নিজস্ব গ্রামার আছে এটা আমি জেনেছি সিলেটে আমার চৌদ্দ বছর জীবন অতিবাহিত করার পর। আমি আমার ছোট্ট  শৈশবে উপকূলীয় উপজেলা সুবর্ণচর থেকে ফেঞ্চুগঞ্জ চলে যাই এবং সেখানেই আমার বেড়ে ওঠা। জীবনের নানা পর্বে ও পর্যায়ে এই বিকাশমান আমি- এর ভিত্তিভূমি সিলেটে। আমার বন্ধুর সংখ্যা অসংখ্য, তার সিংহভাগই সিলেটের। এবং এটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, কারণ তারা আমার শৈশব কৈশোর এবং যৌবনের ঊষালগ্নের বন্ধু। নাগরীলিপিতে লেখা সাহিত্যের ঝাণ্ডাবাহক মোস্তফা সেলিম আমার অনুজ লেখক-বন্ধু। সেটাও হয়তো সিলেটি বলে।

এবার সিলেটি ভাষার 'নিজস্ব গ্রামারের' কথাটা বলি। আমি তখন এমসি কলেজে ফিজিক্স অনার্সে পড়ি, ২য় বর্ষে। আমাদের কলেজ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নুরুল হক মনজু আমার সিনিয়র ভাই। দুজনেই আমরা হোস্টেলে থাকি, ফার্স্ট বøকে। আমি মনজুকে চাচা ডাকি। ঘনিষ্ঠতা এমন যে সপ্তাহান্তের ছুটির দিনটা কাটাবার জন্য ওদের গ্রামের বাড়ি তাজপুরের কাশিকাফন যাই। ওর বাবা-মা’কে আমি দাদা-দাদি ডাকি। ওরা অনেক আদর করেন আমাকে।


মনজু চাচার বোন থাকেন শহরে স্বামীর সঙ্গে। তাদের ছেলে-মেয়ে সুবল ও বুলবুল থাকে নানির কাছে। নানি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। তারা নানির সঙ্গেই স্কুলে যাওয়া-আসা করে। সুবলের বয়স নয়, বুলবুলের সাত। বৃহস্পতিবার বিকেলেই আমরা হোস্টেল থেকে মনজুদের বাড়ি চলে এসেছি। তার পরদিনই ঘটে পনেরো আগস্ট। আমাদের মন খুব খারাপ। আমি মনজুর ঘরে একা শুয়ে আছি হাতের কব্জি দিয়ে চোখ ঢেকে। এমন সময় সেখানে বুলবুল এলো।
বলল, মনি ভাই, উটো, তুমারে এখটা জিনিস দেখাইতাম।
আমি কথা বলি না।
এ্যই মনি ভাই, উটো।
বুলবুল বারবারই আমাকে ডাকছে। কথা বলিনা দেখে আমাকে ধাক্কা দিচ্ছে।
এবার আমি সত্যিই বিরক্ত হই।
বলি, ছাতাইছ না।
মুই কিতা তুমারে ছাতাইরাম নি?
তুই ইনতাকি যা। যাছ না।
আমি চোখে হাতের আড়াল দিয়ে রাখি। বুলবুল যায় না।
বলি, যাছ না বে।
বুলবুলের অভিমানী কান্না শুনতে পাই।
চোখ মেলে দেখি, ঠোঁট ফুলিয়ে ফুলিয়ে সে কাঁদছে।
বলি, কীতা অইছে বে? কান্দস কিয়র লাগি?
বুলবুলের কান্না আরো বাড়ল।
বুলবুলের কান্নার কারণ আমি বুঝতে পারি না। শোয়া থেকে উঠে বসে কিছুটা নরম কন্ঠে বলি, কিতা অইছে। কান্দস কেনে?
বুলবুল কান্না থামায়। কিন্তু অভিমানে তার ঠোঁট বারবারই ফুলে ফুলে ওঠে। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, তুমি মোরে 'বে' খইয়া মাতলায় কেনে?
'বে' খইয়া মাতলাম, তে কিতা অইছে?
তুমি বুঝবায় কেমনে! তুমি নোয়াখালী ব্যাটা, বুঝবায় কিলাখান!
আমার 'ইগো'তে লাগে। সামলে নিলাম। ছোট মানুষ। সে যা বুঝেছে, সরলভাবে সেটাই প্রকাশ করেছে।
বললাম, ঠিক আছে। বুঝাইয়া খ'।
বুলবুল আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে,তুমি কিতা মোরে শাফিয়ার মা  (বাড়ির গৃহকর্মী) ফাইলায়নি, আমার লগে তুমি 'বে' খইয়া মাতলায়। আমার নানা,আমার নানি,আমার মামা তুমার লগে কিলাখান মাতে? তুমারে খয়,মনিরে বো,বালা আছনি? তারা তুমার লগে 'বো' খইয়া মাতে। হিরবার, আমার মামার বন্ধুহকলে তুমারে খইন, কিতারে বা, বালা নি! আমার নানা, নানি আর মামা শাফিয়ার মা,তান ফুড়ি শাফিয়া, তারার লগে 'বে' খইয়া মাতইন।


বুলবুলকে আর বলতে হয় না। আমি বুঝে যাই,সিলেটি ভাষাতে আছে ' আপনি-তুমি-তুই' এর ব্যবহার যা 'বো-বা-বে'র এর মাধ্যমে প্রকাশ হয়। বাষট্টি থেকে পঁচাত্তর- চৌদ্দ বছর ধরে আমার শেকড় বিস্তার করা শৈশব কৈশোর এবং এই যুব-তারুণ্যে এই ভাষায় কথা বলতে বলতে বড় হয়েছি, আমিও 'বা- বো- বে' এর ব্যবহারে অভ্যস্থ ছিলাম, কিন্তু আজ সাত বছরের একটি ছোট্ট বালিকা আমাকে এই ভাষার নিজস্ব ব্যাকরণ শিক্ষা দিল।


আমি লুপ্তপ্রায় নাগরীলিপি সাহিত্যের ঐতিহ্য অনুসন্ধান এবং রচিত সাহিত্যের ভাষান্তর কর্মকাণ্ডে নিবেদিত মোস্তফা সেলিম সম্পর্কে কিছু কথা বলতে গিয়ে ছোট্ট বুলবুলের ঘটনাটা আগে উল্লেখ করেছি। করেছি এ-কারণে যে সিলেটি ভাষার নিজস্বতা ও গুরুত্ব সম্পর্কে প্রথমেই একটা ধারণা দিতে চেষ্টা করা।


মোস্তফা সেলিমের সঙ্গে পরিচয় একুশে গ্রন্থমেলায়, ঢাকায়। উনি পেশায় প্রকাশক, খ্যাতনামা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান উৎস প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী। আমিও জীবনের অনেক পথ পার হয়ে এসেছি, ঢাকায় থাকি। চাকরির কর্মস্থল ঢাকায়, পাশাপাশি লেখালিখি করি। বাংলাদেশ টেলিভিশনে গ্রন্থ ও প্রকাশনা বিষয়ক অনুষ্ঠান 'বইপত্র'র গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা করি। বই ও প্রকাশনা নিয়ে আমার প্রোগ্রাম। মোস্তফা সেলিমের সঙ্গে পরিচয় সে সূত্রে।


একজন প্রকাশক প্রথমতঃ একজন ব্যবসায়ী। জ্ঞান ও সৃজনশীল সাহিত্যের বই প্রকাশ করেন বলে তিনি মহৎ ব্যবসায়ী। কিন্তু সেলিমের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বইয়ের তালিকা দেখে আমি বিস্মিত হয়ে যাই। সিলেটের প্রাচীন ইতিহাস, সাহিত্য-সংষ্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে লেখা বর্তমানে প্রায় দুষ্প্রাপ্য পুস্তকসমুহ পুর্নপ্রকাশ করে উৎস সংষ্করণ প্রকাশ করা হয়েছে। একইভাবে সিলেট অঞ্চলের প্রধান লেখক যারা ইতিমধ্যে প্রয়াত হয়েছেন তাঁদের বইও তার পুস্তক তালিকায় সংযুক্ত হয়েছে।


সেলিম বললেন তিনি নাগরীলিপিতে লেখা সাহিত্যের লুপ্তপ্রায় গ্রন্থগুলোর প্রকাশনার কাজে হাত দিয়েছেন। আমরা যারা বাংলা ভাষার পাঠক ও লেখক, আমাদের পক্ষে এর পাঠ সম্ভব নয়।  সেলিম বললেন, তিনি পাশাপাশি বাংলা ভাষায় তার লিপ্যন্তর করে ছাপবেন।


নাগরীলিপিতে লেখা সাহিত্য সম্পর্কে আমার নিজেরই কোনো ধারণা  নেই। বাংলা ভাষা-সাহিত্যর যে ইতিহাস আমাদের জানা, চর্যাপদ থেকে শুরু করে আধুনিক কালের যে ইতিহাস বর্ণিত আছে, তাতে নাগরীলিপি সাহিত্যের উল্লেখ নেই। কিন্তু নাগরীলিপি সাহিত্য  বাংলা ভাষার পাশাপাশি  ইষৎ পরিবর্তিত বাংলা লিপিরই এতদঞ্চলের একটি পরিশীলিত সাহিত্যরূপ।


মোস্তফা সেলিমের কাছ থেকেই জানলাম সিলেটি নাগরীলিপির বইগুলো সিলেটি ভাষার উচ্চারণে পড়া হয়। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, এই লিপিটাই সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার বর্ণমালা। আমার তখন বুলবুলের কথা মনে পড়ে। বুলবুল আমাকে সিলেটি ভাষার ব্যাকরণ সম্পর্কে শিখিয়েছিল, আর এখন বুঝলাম, সিলেটি ভাষার নিজস্ব এক লিখিতরূপও আছে, যেটাকে আমরা নাগরীলিপি বলছি।


সিলেটি ভাষার প্রচলন কেবল বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলেই নয়, আসামের বরাক উপত্যকা, মেঘালয়, ত্রিপুরা, করিমগঞ্জের বিশাল অঞ্চলেও। ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই এইসব অঞ্চলে নাগরীলিপিতে লেখা সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছিল।


সেলিম জানালেন, নাগরীলিপি অনেকগুলো নামেই পরিচিত ছিল।  যেমন সিলেটি নাগরী, জালালাবাদী নাগরী, ফুল নাগরী, মুসলমানি নাগরী,  মোহাম্মদী নাগরী। হজরত শাহজালাল (র.) সিলেট আগমনের পর সুফি-দরবেশগণ যখন ইসলাম প্রচার শুরু করলেন, তখন স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে ভাষার দূরত্ব কমানোর লক্ষ্যে সংষ্কৃত-প্রধান বাংলা বর্ণমালার বিকল্প হিসেবে আরবি-ফারসি-বাংলার মিশেলে ৩৩টা বর্ণমালার আলাদা একটা লিপি তৈরি করে, যা নাগরীলিপি হিসেবে পরিচিত হয়। আরেকটা মতের কথাও বললেন, 'স্রষ্টা ব্রহ্মা'র ভাষা 'ব্রাহ্মী' ভাষা। মুসলমান লেখকরা যারা ধর্মীয়  কথা-উপকথা  নিয়ে সাহিত্য রচনা করতে চাইলেন, তারা ব্রাহ্মী লিপি বাদ দিয়ে নাগরীলিপিতে সাহিত্য রচনা শুরু করেন।


মোস্তফা সেলিমের কাছ থেকে এইসব কথা শোনার পর আমি নিজেই আগ্রহী হয়ে উঠি। আমি তাঁকে বিটিভির 'বইপত্র' অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাই।

সাক্ষাৎকার পর্বে সেলিম জানালেন নাগরীলিপিতে এ-পর্যন্ত প্রায় ১৪০টি গ্রন্থের নাম তিনি পেয়েছেন। সেগুলো দুষ্প্রাপ্য। কলকাতা, বাংলাদেশ, আসামসহ বিভিন্ন জায়গায় বইগুলো ছড়িয়ে আছে। তিনি সেগুলো সংগ্রহ করবেন এবং পর্যায়েক্রমে পুনরায় বাংলা ভার্সনসহ প্রকাশ করবেন। তখন পর্যন্ত তিনি হালতুননবী, জঙ্গনামা, নুর পরিচয়, মহব্বতনামাসহ ৫/৬টি বই প্রকাশ করেছেন। নাগরীলিপির বই ও কবিতাগুলো প্রধানত ইসলামের ইতিহাস, মানবপ্রেম, মারেফত, ফানাহফিল্লাহ, মরমি ও আধ্যাত্মিক জগতের নানা কথা নিয়ে রচিত হয়েছে।


সেলিম সাক্ষাৎকারে জানালেন, সিলেটের ইসলামিয়া প্রেস, সারদা প্রেস এবং কলকাতার হামিদিয়া প্রেসে এই লিপির বই ছাপা হতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় সিলেটের প্রেসগুলো পাকিস্তানি সৈন্যরা জ্বালিয়ে দেয়। ফলে টাইপ ও সংরক্ষিত বইগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেলিম জানালেন, ৮০-র দশকের শেষ দিকে বৃটেনে বসবাসরত কয়েকজন উদ্যমী ব্যক্তির প্রচেষ্টায় নাগরীলিপির কম্পিউটার ফন্টও তৈরি হয়ে গেছে। কাজেই এনিয়ে কাজ করতে, অগ্রসর হতে আর কোনো বাধা নেই। সেলিমের কথা থেকেই জানলাম, পৃথিবীতে বহু ভাষা আছে যার বর্ণলিপি নেই। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে সিলেটি ভাষা নিঃসন্দেহে একটি সমৃদ্ধ ভাষা।


সেলিমের সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময়ই বুঝে গিয়েছিলাম, তিনি ইতোমধ্যেই নাগরীলিপি ও সাহিত্যের একজন বোদ্ধা পাঠক ও গবেষক হিসেবে একটা স্থায়ী আসন করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলেছেন।


পরবর্তীতে আমরা লক্ষ্য করি, তাঁর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে নাগরী সাহিত্যের লুপ্তপ্রায় বহু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। নাগরীলিপি ও সাহিত্য নিয়ে তাঁর নিজের লেখা বই বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়েছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তাঁর অনেকগুলো লেখা ও সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে এবং বিষয়টি ব্যাপক প্রচারণা পায়। দেশে ও বিদেশে সিলেটি ভাষাভাষী মানুষ নিজেদের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য সংরক্ষণে নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। একই অনুপ্রেরণায় সিলেট শহরে একটা সুদৃশ্য 'নাগরী চত্বর' প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আবেগতাড়িত ব্যক্তিবর্গ তাদের দোকানের নাম, বিবাহের কার্ড নাগরীলিপির মাধ্যমে করার ঘটনাও ঘটেছে।


এই যে এতসব ঘটনাবলি, সবকিছুর প্রেরণার মূলে রয়েছেন মোস্তফা সেলিম। এ এক অভূতপূর্ব বিপ্লব আর এই বিপ্লবের নায়ক মোস্তফা সেলিম। তাকে ৫৪তম জন্মদিনে জানাই প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।


লেখক: সিরাজুল ইসলাম মুনির : কথাসাহিত্যিক।