বহুল আলোচিত বরগুনার চাঞ্চল্যকর শাহনেওয়াজ শরীফ রিফাত হত্যাকাণ্ডের তিন বছর হলো আজ। ২০১৯ সালের এই দিনে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির সামনে প্রকাশ্যে রিফাতকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে কিশোর গ্যাং ‘বন্ড বাহিনী’। পরে বিকেলে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রিফাত।

 


এ ঘটনায় রিফাতের বাবা আব্দুল হালিম দুলাল শরীফ মামলায় প্রথমে পুত্রবধূ আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে প্রধান সাক্ষী করেন। পরে মামলার পুলিশি তদন্তে মিন্নি হয়ে যান হত্যাকাণ্ডের প্রধান পরিকল্পনাকারী। এ জন্য পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে দীর্ঘ তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট জমা দেয়।

 

এ মামলায় বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালত মিন্নিসহ ছয়জনকে ফাঁসির আদেশ দেন। এরপর বরগুনা জেলা কারাগার থেকে মিন্নিকে গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে এখন মিন্নি কনডেম সেলে আছেন।

জানা যায়, ২০২০ সালের ৪ অক্টোবর ছয় আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে পৌঁছায়। পরে ৬ অক্টোবর মিন্নিসহ অন্য আসামিরা আপিল করেন।

করোনাভাইরাসে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর চলতি বছরের ৩০ মে বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেছেন। বিচারপতি মোস্তফা জামানের বেঞ্চে এ আবেদন করা হয়।

এ ঘটনায় দুই পরিবার দুটি রায়ের অপেক্ষার প্রহর গুনছে। ফাঁসির আসামি মিন্নির বাবা উচ্চ আদালত থেকে মেয়েকে মুক্তির জন্য লড়াই করছেন। বিপরীতে রিফাত শরীফের মা-বাবা অপেক্ষায় আছেন ছেলে হত্যার রায় কার্যকর দেখতে।

 

বরগুনা জেলা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মুজিবুল হক কিসলু বলেন, নিহত রিফাতের স্ত্রী মিন্নিসহ দণ্ডপ্রাপ্ত প্রাপ্তবয়স্ক আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করেছে। তবে তাদের কারও জামিন মঞ্জুর করেননি আদালত। অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ আসামির মধ্যে পাঁচ বছরের চারজন ও তিন বছরের একজনকে জামিন দিয়েছেন আদালত। তাদের মধ্যে কারাগারে আছে ছয়জন। বাকি তিনজনকে খালাস দিয়েছেন উচ্চ আদালত।

যা ঘটেছিল সেদিন
২০১৯ সালের ২৬ জুন ভরদুপুরে বরগুনা জেলা শহরের কলেজ রোডে প্রকাশ্যে কোপানোর ঘটনার একটি রোমহর্ষক ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ভিডিওতে দেখা যায়, ২৬ জুন সকাল ১০টার দিকে স্ত্রী মিন্নিকে আনতে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে যান রিফাত। কিছুক্ষণ পর কলেজগেটে বন্ড বাহিনীর সদস্যরা তাকে প্রকাশ্যে কোপানো শুরু করে। দুই যুবক রামদা হাতে রিফাতকে একের পর এক আঘাত করে চলেছেন। আর তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি এসে স্বামীকে বাঁচানোর জন্য হামলাকারীদের ঠেকানোর চেষ্টা করছেন।

 

পরে রিফাতকে উদ্ধার করে বরগুনা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে তার অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে ওই দিন বিকেলে মৃত্যু হয় তার।

 

এদিকে রিফাতের মৃত্যুর পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে তা ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর দেশ-বিদেশ থেকে প্রকাশ্যে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিতে সরব হয় সবাই।

ঘটনার পরদিন ২৭ জুন নিহত রিফাতের বাবা আব্দুল হালিম দুলাল শরীফ বরগুনা সদর থানায় নয়ন বন্ডকে প্রধান আসামি করে ১২ জনের নামে ও অজ্ঞাতনামা আরও ১০ থেকে ১২ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলায় রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে মামলায় ১ নম্বর সাক্ষী করা হয়।

 

এ ঘটনার পর বরগুনা শহরে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য ও অপকর্মের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এসব বাহিনীর কিশোর ও তরুণরা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকা পেয়ে অরাজকতা শুরু করেছে, এমন খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে হত্যা রহস্য নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।

 

নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ছয় দিন পর ২ জুলাই এ মামলার প্রধান আসামি ‘বন্ড বাহিনী’ প্রধান সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড (২৫) পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। সেদিন ভোররাত সোয়া চারটার দিকে বরগুনা সদরের বুড়িরচর ইউনিয়নের পূর্ব বুড়িরচর গ্রামে ওই ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া এ মামলার তদন্ত করতে গিয়ে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রিফাতের স্ত্রী ও মামলার প্রধান সাক্ষী মিন্নির জড়িত থাকার প্রমাণ পায় পুলিশ।

এ ঘটনায় রিফাত শরীফের বাবা ৬ জুলাই মিন্নিকে আসামি করার জন্য বরুগুনা থানায় আবেদন করেন। পরে পুলিশের তখনকার তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির ১৬ জুলাই প্রধান সাক্ষী মিন্নিকে গ্রেপ্তার করেন।

দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক দুই ভাগে ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। এতে ১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক ও ১৪ জন অপ্রাপ্তবয়স্ককে আসামি করা হয়।

 

এরপর ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির মধ্যে নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করে ছয় আসামিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আদালত। আর বাকি চারজনকে খালাস দেওয়া হয়।

ওই বছরের ২৭ অক্টোবর অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ জনের ছয়জনকে ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন শিশু আদালত। এ ছাড়া চারজনকে পাঁচ বছর এবং একজনকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়ে বাকি তিনজনকে খালাস দেওয়া হয়। পরে নিম্ন আদালতের এ রায়ের পর উচ্চ আদালতে আপিল করেন দণ্ডপ্রাপ্ত সবাই। তাদের মধ্যে পাঁচজন জামিনে আছেন। বাকিদের শুনানি এখনো হয়নি।

এদিকে, পরিবারের একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় নিহত রিফাত শরীফের মা ডেইজি আক্তার। ছেলের কথা মনে করে এখনো মূর্ছা যান তিনি।

 

ডেইজি বলেন, আমার কলিজার টুকরা বাবারে ওরা মেরে ফেলল। আল্লাহ যেন এমন পরিস্থিতিতে আর কোনো মা-বাবাকে না ফেলে। আমরা আদালতের রায়ে সন্তুষ্ট। এখন শুধু দ্রুত দণ্ড কার্যকরের দাবি রইল।

 

সিলেটভিউ২৪ডটকম/ডেস্ক/এসডি-৩৮
 


সূত্র : ঢাকাপোষ্ট