ছবি: মোজাম্মেল হক।

সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক ইন্টার্ন চিকিৎসকের শ্লীলতাহানি ও দুই শিক্ষার্থীর ওপর হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে দুটি। মামলায় আসামিসংখ্যা আটজন। তন্মধ্যে দুজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি, মূল হোতাসহ সবাইকে গ্রেফতার করতে হবে। আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশের ‘রেসপন্স ও অ্যাকশন’ দেখতে চান ওসমানী মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। এদিকে, নিজেদের দাবিতে আন্দোলনে অনড় রয়েছেন তারা।

আজ বুধবার দুপুরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভুঁইয়া। তিনি বলেন, ‘একদম সর্বোচ্চ লেভেল থেকে তাদের সাথে কথা হচ্ছে এবং এটার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আইজিপি থেকে এবং আমাদের অনেক উপরের লেভেল থেকে এটার ব্যাপারে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। একটাই দাবি আপনারা জানেন যে, অন্তত একজন বা দুইজন হলেও যেন আসামি ধরা পড়ে। ওরা (শিক্ষার্থীরা) পুলিশের রেসপন্স দেখতে চাচ্ছে, অ্যাকশন দেখতে চাচ্ছে। এখানকার পুলিশ কমিশনারের সাথে রাতে ও সকালে আমার কথা হয়েছে। র‌্যাব, পুলিশ ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা সবাই (আসামি গ্রেফতারে) কাজ করছে। আশা করি এটার সমাধান হবে।’


তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও বিষয়টি জানে। তাঁরা উপর থেকে কাজ করছেন। এখানকার ডিজি স্বাস্থ্য এবং ডিজি স্বাস্থ্য-শিক্ষাও খোঁজ রাখছেন।’

হাসপাতাল পরিচালক আরও বলেন, ‘ইন্টার্ন চিকিৎসকরা বড় একটা রোল প্লে করে। এটা সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতেই। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি (সমাধান) হবে। অবশ্যই (স্বাভাবিক কাজে) কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। আমাদের আশা আসামিরা তাড়াতাড়ি গ্রেফতার হবে এবং আমরা স্বাভাবিক কাজে ফিরে যাবো।’

বর্তমানে অন্যান্য ডাক্তার ও স্টাফ যারা আছেন, তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও জানান তিনি।

সার্বিক নিরাপত্তাবৃদ্ধি প্রসঙ্গে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভুঁইয়া বলেন, ‘ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিরাপত্তার জন্য পুলিশের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্যাম্পের জন্য একটা জায়গা দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে পুলিশ ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। পুলিশের টহল বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আনসার বাহিনীর সদস্যদেরও বৃদ্ধি করার চেষ্টা চলছে। পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সমন্বয়ে আশা করি নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে।’

আন্দোলন অব্যাহত>>
এদিকে, নিজেদের দাবি নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তারা ধর্মঘট পালন করছেন। তবে জরুরি বিভাগ, নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র ও হৃদরোগ বিভাগকে ধর্মঘটের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।

আজ বুধবার থেকে ক্যাম্পাসে দফায় দফায় বিক্ষোভ করেছেন আন্দোলনরতরা। তারা সব আসামিকে দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানাচ্ছেন। আজ দুপুরে হাসপাতালের মূল ফটকের সামনের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে তাদের। এতে সড়কের উভয়পাশে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এ ছাড়া হাসপাতালের মূল ফটক বন্ধ করে দিয়েছে শিক্ষার্থীরা।

ওসমানী মেডিকেলের ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও ইন্টার্ন চিকিৎসকদের নিরাপত্তার জন্য দৃশ্যমান উদ্যোগ না নেওয়া পর্যন্ত এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সবাইকে গ্রেফতারের আগপর্যন্ত ধর্মঘট কর্মসূচি চলবে।

আন্দোলনের শুরু যেভাবে>>
জানা গেছে, ওসমানী মেডিকেল কলেজের এক ইন্টার্ন চিকিৎসকের সঙ্গে গত রোববার রাতে বাগবিতণ্ডা হয় এক রোগীর দুই স্বজনের। ইন্টার্ন চিকিৎসকদের অভিযোগ, বহিরাগতরা নারী চিকিৎসকের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। ইন্টার্ন চিকিৎসকরা সংঘবদ্ধ হয়ে ওই দুজনকে পুলিশে সোপর্দ করেন। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিষয়টির মীমাংসা হয়।

ওই ঘটনার জের ধরে গত সোমবার রাত ৯টার দিকে ওসমানী মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র ইমন আহমদ (২৪) ও তৃতীয় বর্ষের ছাত্র রুদ্র নাথ (২২) এর ওপর কলেজের পেছনে হামলার ঘটনা ঘটে। পরে সহপাঠীরা তাদেরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন।

এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ধর্মঘটের ডাক দেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। তারা হাসপাতালের সব বিভাগে চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেন। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন অসুস্থরা। এ ছাড়া কলেজের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে অবরোধ করেন ইন্টার্নরা। এতে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। এদিকে, সোমবার দিবাগত রাত ১টার দিকে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভুঁইয়াকে নিজ কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। প্রায় ঘন্টাখানেক অবরুদ্ধ ছিলেন তিনি।

গত রাতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী শাহ অসিম ক্যানেডি বলেন, ‘রোববার এক ইন্টার্ন চিকিৎসকের সঙ্গে রোগীর দুই স্বজন খারাপ ব্যবহার করেন। তাদেরকে আমরা পুলিশের হাতে তুলে দেই। এ ঘটনার জেরে সোমবার রাত ৮টার দিকে কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকে বহিরাগতরা আমাদের কয়েক শিক্ষার্থীকে মারধর করে। এতে দুজন গুরুতর আহত হন। এর আগেও অনেকবার এমন ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি।’

ধর্মঘট ও অবরোধের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান এসএমপির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। এ ছাড়া হাসপাতালে যান সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন। হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে বসে বৈঠক। রাজনীতিবিদ, প্রশাসনের কর্মকর্তা, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন বৈঠকে।

শিক্ষার্থীরা মেডিকেল কলেজে স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, হামলাকারীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা, হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মেডিকেল প্রশাসনের মামলা করাসহ পাঁচ দাবি জানান। তাদের দাবিগুলো বাস্তবায়নের আশ্বাস দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। এরপর মঙ্গলবার ২টা পর্যন্ত ধর্মঘট ও অবরোধ প্রত্যাহার করেন আন্দোলনরতরা। তবে তাদের দাবি আদায় না হওয়ায় কাল মঙ্গলবার ২টার পর থেকে ফের আন্দোলন শুরু হয়।

গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল, পুলিশ প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের নেতারা বৈঠকে বসেন। বৈঠকে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নাসির উদ্দিন খানও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে আন্দোলনকারীদের দাবিগুলো মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু সব আসামিকে গ্রেফতার না হওয়া অবধি আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তারা।

দুই মামলা>>
গতকাল মঙ্গলবার বিকালে নগরীর কোতোয়ালী থানায় দুটি মামলা হয়। পৃথক দুই মামলায় আসামি করা হয় ৮ জনকে। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ হানিফ ও ওসমানী মেডিকেল কলেজের পিএ-টু প্রিন্সিপাল ও সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মাহমুদুল রশিদ বাদী হয়ে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন।

মামলার আসামিরা হলেন- দিব্য, আব্দুল্লাহ, এহসান আহমদ, মামুন, সাজন, সুজন, সামি ও সাঈদ হাসান রাব্বি।

এদের মধ্যে নগরীর মুন্সিপাড়ার মৃত রানা আহমদের ছেলে সাঈদ হাসান রাব্বি (২৭) ও কাজলশাহ এলাকার আব্দুল হান্নানের ছেলে এহসান আহমদকে (২২) গত সোমবার দিবাগত রাত ১টার দিকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। এ দুজনই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত। তন্মধ্যে সাঈদ হাসান রাব্বি সিলেট মহানগরীর ৩ নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক।

বাকি ছয় আসামির পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা দায়েরকৃত মামলার প্রাথমিক তথ্যবিবরণীতে পাওয়া যায়নি।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে